হোটেলে আগুন লেগে ১৪ জনের মৃত্যু, এত আগুন কেন লাগে কলকাতায়?
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কলকাতায় বড়বাজারের হোটেলে আগুন লেগে ১৪ জন মারা গেছেন। কেন বারবার এত আগুন লাগে কলকাতায়?
বড়বাজারে হোটেলে আগুন
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় কলকাতার বড়বাজারের মেছুয়ায় একটি ছয়তলা হোটেলে ভয়াবহ আগুন লাগে। ঘটনায় ১৪ জন প্রাণ হারান। তারা প্রত্যেকেই হোটেলের আবাসিক। কেউ কলকাতায় ছুটি কাটাতে, কেউ কাজে ভিনরাজ্য থেকে কলকাতায় এসেছিলেন।
কী বলছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা
প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী, আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গেই কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যায় হোটেলের করিডোর। বন্ধ হোটেলের ঘরে, করিডোরে শ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যু ঘটে অনেকেরই। দুই ব্যক্তি প্রাণ ভয় কার্নিশ থেকে ঝাঁপ দেন। একজন গুরুতর আহত হয়েছেন। অপর জনের মাথায় চোট পেয়ে সঙ্গে সঙ্গেই মারা গেছেন।
প্রত্যক্ষদর্শী হাসনু যা বলেছেন
প্রত্যক্ষদর্শী মোহাম্মদ হাসনু বলেন, "আগুন লাগার মুহূর্তে আমি ছিলাম না। গাড়ি নিয়ে বাইরে গেছিলাম। ফিরে এসে দেখি অ্যাম্বুলেন্স যাচ্ছে আর আসছে এবং হোটেলে ভয়াবহ আগুন লেগেছে। অঞ্চলে পৌঁছে শুনি দুজন হোটেলের কার্নিশ থেকে ঝাঁপ দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। একজনের হাত-পা ভাঙে আর একজন মারা যান।"
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী মাফিজের বক্তব্য
মোহাম্মদ মফিজ এই হোটেলের পাশে পানের দোকান চালান। তিনি জানান, "আগুন লাগার পর আমি দেখি কিছু মানুষ দড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসছে আর কিছু মানুষ ভেতরে আটকে ছিল, এবং বহু মানুষ কার্নিশের উপর দাঁড়িয়ে ছিল প্রাণ রক্ষার জন্য। তারপর দমকল বাহিনীকে ফোন করা হয়। দমকল আসে, আস্তে আস্তে মানুষদের সিঁড়ির সাহায্যে নামানো হয় নিচে। এর মধ্যে হোটেলের তিনতলা থেকে নামতে গিয়ে একজন ব্যক্তির মৃত্যু হয়।"
আগুন নেভানোর ব্যবস্থা অকেজো
বুধবার ঘটনাস্থলে যান দমকলের ডিজি রনবীর কুমার। তিনি মিডিয়াকে জানান, ওই হোটেলের অগ্নিনির্বাপক লাইসেন্স তিন বছর আগে শেষ হয়ে গেছে। তার পর নবীকরণ করেনি হোটেল কর্তৃপক্ষ। এমনকী, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রগুলির অধিকাংশ বিকল ছিল বলে জানা গেছে। ছয়তলা এই হোটেলের অনেক জানলাই বন্ধ ছিল। আগুন লাগার পরেও খোলা যায়নি।
বেরনোর রাস্তা বন্ধ
হোটেলের দুটি সিঁড়ির মধ্যে একটি সিঁড়ি বন্ধ ছিল। একতলায় কাজ চলছিল। স্থানীয়দের মতে সেই কাজ বেআইনি। এই হোটেলে এমন অনেক বেআইনি নির্মাণ হয়েছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করেছে পুলিশ।
বারবার বড়বাজারে আগুন
বড়বাজারে প্রতিবছর ছোট বড় অগ্নিকাণ্ডের খবর পাওয়া যায়। জনবহুল এই এলাকায় ঘিঞ্জি বাড়িঘর। প্রায় প্রতিটি বাড়িতে দোকান। ২০১৮তে বড়বাজারের বাগড়ি মার্কেটে আগুন লাগে। তিনদিনের চেষ্টায় সেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। তার একবছর আগেই বাগড়ি মার্কেট অঞ্চলে অন্য একটি অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছিল। ২০২০তে ব্রেবোর্ন রোড ও ক্যানিং স্ট্রিটের মোড়ে ভয়বহ আগুন লাগে। ২০০৮এ নন্দরাম বাজারের অগ্নিকাণ্ডে প্রায় বারোশ' দোকান পুড়ে যায়।
কলকাতায় একের পর এক আগুন
গতবছর নভেম্বরে কলকাতায় ১৪ দিনে ২৫টি আগুন লাগে। নভেোম্বর ও ডিসেম্বরে একের পর এক বস্তিতে আগুন লাগে। দুই দিনের মধ্যে তপসিয়া ও নিউ আলিপুরের বস্তিতে আগুন লাগে। নন্দরাম মার্কেট, স্টিফেন কোর্ট, ঢাকুরিয়ার আমরি হাসপাতাল, নিউ কয়লাঘাট বিল্ডিং, ট্যাংরায় আগুন লাগে। বুধবারও ধাপায় আগুন লেগেছে।
'কারো হেলদোল নেই'
মাস দুই আগে বিহার থেকে কাজ খুঁজতে কলকাতায় এসে এই মেছুয়াতে ঘর ভাড়া নিয়েছেন শ্রাবণ কুমার। তিনি বলেছেন, "এখানে আসার একমাসের মধ্যেই এই পাড়ার আরেকটি বাড়িতে আগুন লাগে। সেই আগুন নেভাতে ঘণ্টা দুই সময় লাগে। একমাসের মধ্যে এই আগুন। এখানে ইলেকট্রিকের তার ঝুলে থাকে। বাজার অঞ্চল দাহ্য পদার্থে ভর্তি। কর্তৃপক্ষ, পুলিশ, পুরসভা, কারো কোনো হেলদোল নেই। প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে থাকতে পারব না। অন্য অঞ্চলে ঘর খুঁজছি।"
আগুন নেভানোর ব্যবস্থা নেই
স্থানীয় বাসিন্দা জগন্নাথ সাহনি মঙ্গলবারের এই ঘটনায় প্রাথমিকভাবে উদ্ধারের কাজ করেছিলেন। তিনি এই অঞ্চলের বহু দশকের বাসিন্দা। তিনি বলেন, "এখানে আগুন লেগে আরো বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। কোনো বাড়িতেই আগুন নেভানোর সঠিক ব্যবস্থা নেই। কিন্তু আগুন লাগতে পারে এমন জিনিসে বাড়িগুলি ভর্তি। এক একটা ঘটনা ঘটে। পুলিশ, পুরসভার আধিকারিকরা আসেন। সিট গঠিত হয়। তদন্ত হয়। আবার যে কে সেই। কোনো পরিবর্তন দেখি না।"