হামলার পর সক্রিয় প্রশাসন, মাঠে ফিরেছেন নারী ফুটবলাররা
৫ আগস্ট ২০২৩খুলনার বটিয়াঘাটায় নারী ফুটবলাররা অবশ্য আবার খেলায় ফিরেছেন। মাঠে পুলিশি নিরাপত্তা দেয়া হয়েছে, প্রশাসক তৎপর হয়েছে। একজন আসামি আটক হয়েছে। তারপরও আতঙ্ক পুরোপুরি কাটেনি। তিন জন আসামি আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন।
হামলার ঘটনায় গুরুতর আহত ফুটবলার মঙ্গলী বাগচী বৃহস্পতিবার হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। তার মাথায় রড দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল।
এই ঘটনায় জড়িত সবাইকে গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে খুলনা ও সাতক্ষীরায় মানববন্ধন হয়েছে। দেশের ৪৫ জন বিশিষ্ট নাগরিক নারী ফুটবলারদের নিরাপত্তা ও অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন।
গত ২৯ জুলাই খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার তেঁতুলতলা গ্রামে চার নারী ফুটবলারের ওপর হামলা চালায় স্থানীয় কয়েকজন। ফুটবলাররা স্থানীয় তেঁতুলতলা সুপার কুইন ফুটবল একাডেমির খেলোয়াড়। একাডেমির এক নারী ফুটবলারের ছবি তুলে বিভিন্ন জনকে দেখানোর প্রতিবাদ করলে তাদের মারধর করা হয়। এতে চার নারী ফুটবলার মঙ্গলী বাগচী, সাদিয়া নাসরিন, হাজেরা খাতুন ও জুঁই মন্ডল আহত হন।
ঘটনার পর ফুটলার সাদিয়া নাসরিন বাদী হয়ে হামলার অভিযোগে নুপুর খাতুন, তার বাবা নুর আলম, ভাই সালাউদ্দিন এবং মা রাজিয়া বেগমের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করেন। পুলিশ মূল আসামি নুর আলমকে গ্রেপ্তার করেছে। তবে মামলা করায় হামলার পরদিন ফুটবলার সাদিয়াকে মামলা তুলে নেয়ার হুমকি দেন নুপুর, তার ভাই ও মা। তারা সাদিয়াসহ ফুটবল একাডেমির নারী ফুটবলারদের শরীরে অ্যাসিড ছোড়ার হুমকি দেয় বলেও অভিযোগ।
মামলার বাদী ফুটবলার সাদিয়া নাসরিন বলেন, "একজন নারী ফুটবলারের ছবি তুলে বিভিন্ন জায়গায় দেখানো হচ্ছিল। আমরা যে খেলার পোশাক পরে ফুটবল খেলি, তা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে নেতিবাচক প্রচারণা চালানো হচ্ছিল। কটূক্তি করা হচ্ছিল। যারা এটা করেছে তাদের বাড়িতে গিয়ে প্রতিবাদ করলে প্রথমে আমাকে মারধর করা হয়। খবর পেয়ে অন্যরা গিয়ে আমাকে মারধরের প্রতিবাদ করলে তাদেরও মারধরকরা হয়। মঙ্গলী বাগচীর মাথায় রড দিয়ে আঘাত করা হয়।”
তিনি বলেন, "মামলা করলে পরের দিন আমাকে মামলা তুলে নেয়ার হুমকি দেয়া হয়। আমাদের শরীরে অ্যাসিড ছোড়ার হুমকি দেয়া হয়। এটা নিয়েও থানায় জিডি করেছি। পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করেছে, বাকিরা জামিন পেয়েছে বলে শুনেছি।”
সাদিয়া জানান পুলিশ এখন নিরাপত্তা দিচ্ছে, তবে তাতে সার্বিকভাবে আতঙ্ক এখনো কাটেনি "এখন আমরা নিরাপদ আছি। পুলিশ প্রশাসন সক্রিয় আছে আমাদের নিরাপত্তা দেয়ার কাজে। তারা আমাদের পাশে আছে। আমরা আবার মাঠে খেলা শুরু করেছি। তারপরও যেহেতু অ্যাসিড মারার হুমকি দেয়া হয়েছে, আমাদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করছে।”
বটিয়াঘাটা থানার ওসি শওকত কবীর বলেন, "আমরা ঘটনা জানার পরই আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছি। মূল আসামি নুর আলম, যে রড দিয়ে আঘাত করেছে তাকে গ্রেপ্তার করেছি। সে এখন কারাগারে আছে। বাকি তিনজন আদালত থেকে জামিন নিয়েছে। তারা এখন এলাকায় নেই। চার জন আসামি একই পরিবারের সদস্য।''
তিনি জানান, "তেঁতুলতলা স্কুল মাঠে নারী ফুটবলাররা খেলার সময় পুলিশ রাখছি। চিন্তা আছে ওই মাঠে সার্বক্ষণিক পুলিশের নিরাপত্তা দেয়ার। আর যাদের ওপর হামলা হয়েছে, তাদের ও তাদের পরিবারের সঙ্গেও আমরা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি।”
তিনি বলেন, "এই মাঠে গত ১২ বছর ধরে মেয়েরা ফুটবল খেলেন। তাদের অনেকে বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে সাফল্য পেয়েছেন। আর দেশের অন্য এলাকা থেকেও এই ক্লাবের সদস্য হয়ে এখানে ফুটবল খেলেন। তাদের থাকার ব্যবস্থাও আছে এখানে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, "নারীরা বাইরে খেলাধুলা করবে, সেটা নিয়ে আমাদের এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজে সব সময়ই একটা সমস্যা আছে। যদিও বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশের নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন। তারপরও নারীরা ব্যাডমিন্টন খেলবে, ফুটবল খেলবে, ফুটবলে বিশেষ ধরনের পোশাক পরতে হয়, স্বাচ্ছন্দ্যে খেলতে হয়— এটা নিয়ে কুসংস্কার সব সময়ই ছিল। এখানে পুলিশ তার দায়িত্ব পালন করবে; কিন্তু আমাদের সমাজ এবং পরিবারেও সমস্যা আছে।”
তার কথা, "অনেক সংকটের মধ্যেও নারীদের বড় বড় অর্জন আছে। তাদের পাশে তাদের পরিবার আছে, অনেকেই আছেন। তারপর আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আরো বদলাতে হবে। এজন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। এটা শুধু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একার কাজ নয়।”