স্বাধীন গণমাধ্যম: ভারত-বাংলাদেশে উগ্রবাদ, আরএসএফ-এর উদ্বেগ
২ মে ২০২৫রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স- আরএসএফ-এর প্রকাশ করা ২০২৫ সালের বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচকে সংবাদ অর্থনীতির ভয়াবহ অবস্থা ফুটে উঠেছে। এর ফলে সম্পাদকীয় স্বাধীনতা এবং গণমাধ্যমের বহুত্ববাদও মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে গণমাধ্যম নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক এই সংগঠন।
গণমাধ্যমের নাজুক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য অন্যতম প্রধান হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে বলে মনে করে আরএসএফ। ২০২৫ সালের বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচকের ফল অনুসারে, বিশ্বের অর্ধেক দেশে সাংবাদিকতা অনুশীলনের সামগ্রিক পরিস্থিতি খারাপ (‘কঠিন' বা ‘খুব গুরুতর' হিসাবে শ্রেণিবদ্ধ)।
অর্থনীতি ও সংবাদমাধ্যমে তার প্রভাব বিশ্লেষণ করে আরএসএফ গণমাধ্যমকে স্বাধীন করে তোলার জন্য সরকার, বেসরকারি সংস্থা এবং আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ১১টি সুপারিশ অনুসরণ করার আহ্বান জানিয়েছে। এসব সুপারিশের মধ্যে হয়েছে অর্থনৈতিক নজরদারির মাধ্যমে গণমাধ্যমে বহুত্ববাদের সুরক্ষা দেয়া, জার্নালিজম ট্রাস্ট ইনিশিয়েটিভ (জেটিআই)-এর নীতিমালা মেনে চলা, বিজ্ঞাপনদাতাদের গণতান্ত্রিক দায়িত্ববোধ নিশ্চিত করা, অনলাইনে তথ্য যাচাই-বাছাই করা, মানসম্মত তথ্যের জন্য বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের ওপর কর আরোপ করা ইত্যাদি।
শীর্ষে ও তলানিতে যেসব দেশ
বরাবরের মতো ১৮০টি দেশের তালিকায় শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে রয়েছে ইউরোপের একচেটিয়া আধিপত্য। ৯২ দশমিক ৩১ স্কোর নিয়ে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে নরওয়ে। এরপর ক্রমান্বয়ে রয়েছে এস্তোনিয়া, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, আয়ারল্যান্ড, পর্তুগাল, সুইজারল্যান্ড এবং চেক প্রজাতন্ত্র।
জার্মানির স্কোর আগের বছরের তুলনায় বাড়লেও অবস্থান ২০২৪ সালের তুলনায় পিছিয়েছে। ২০২৪ সালে জার্মানি ৮৩ দশমিক ৮৪ পয়েন্ট নিয়ে তালিকায় ১০ নম্বরে থাকলেও এবার ৮৩ দশমিক ৮৫ স্কোর নিয়ে রয়েছে ১১ নম্বরে।
জার্মানির যদিও সামগ্রিক আইনি পরিবেশ সাংবাদিকতার জন্য অনুকূল বলে উল্লেখ করেছে আরএসএফ, তবে সংগঠনটি এ-ও বলেছে যে, "নিরাপত্তা আইন সংস্কারের ফলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে আরো বিস্তৃত ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে, যা সাংবাদিকদের মৌলিক অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করে।" এছাড়া জার্মানিতে তথ্যের সরবরাহ খণ্ডিত, গণমাধ্যমে বহুত্ববাদ হুমকির সম্মুখীন এবং সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে উল্লেখ করেছে আরএসএফ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আগের বছরের চেয়ে দুই ধাপ পিছিয়ে নেমে গেছে তালিকার ৫৭ নম্বরে। যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়ে আরএসএফ বলেছে, দেশটিতে, "এক শতাব্দী ধরে ধীরে ধীরে সংবাদমাধ্যমের অধিকার সম্প্রসারণের পর এখন দেশটির আধুনিক ইতিহাসে সংবাদপত্রের স্বাধীনতায প্রথম উল্লেখযোগ্য এবং দীর্ঘস্থায়ী পতনের সম্মুখীন হচ্ছে এবং ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট পদে প্রত্যাবর্তন পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করে তুলছে।"
আগের বছরের অবস্থান ধরে রেখে ১৮০ দেশের তালিকায় সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে আফ্রিকার দেশ ইরিত্রিয়া। অন্যদিকে, ২০২৪ সালে ১৭৭ নম্বরে থাকলেও এবছর আবার দুই ধাপ পিছিয়ে ১৭৯তে চলে এসেছে উত্তর কোরিয়া। এর পরেই ১৭৮ নম্বরে রয়েছে চীন।
দক্ষিণ এশিয়ায় কার কী অবস্থান?
২০২৪ সালের সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৫, এ বছর এগিয়ে ১৪৯ তম অবস্থানে এসেছে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটি। অন্যদিকে ভারত ২০২৪ সালে ১৫৯ তম অবস্থান থেকে এবার আট ধাপ এগিয়ে এসেছে ১৫১ তম অবস্থানে। অর্থাৎ, ২০২৪ সালে ভারত বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে থাকলেও এবার গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বাংলাদেশ ভারতকে পেছনে ফেলেছে।
২০২৪ সালে শ্রীলঙ্কার অবস্থান ছিল ১৫০ নম্বরে। এ বছর ১১ ধাপ এগিয়ে দেশটি ১৩৯ তম অবস্থানে রয়েছে। ১০৬ নম্বর থেকে এগিয়ে ১০৪ এ এবার মালদ্বীপের অবস্থান। উন্নতি হয়েছে আফগানিস্তানেরও। ২০২৪ সালের সূচকে দেশটি ছিল ১৮০ দেশের মধ্যে ১৭৮ নম্বর। এবার তিন ধাপ এগিয়ে দেশটির অবস্থান ১৭৫ নম্বরে।
এবারও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে নেপাল। তবে আগের চেয়ে উল্লেখযোগ্য অবনতি হয়েছে দেশটির। ২০২৪ সালে ৭৪ নম্বরে থাকলেও এবার নেপাল ১৬ ধাপ পিছিয়ে ৯০ নম্বরে অবস্থান করছে।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান রয়েছে ১৫৮ নম্বরে। গত বছরের চেয়ে ছয় ধাপ পিছিয়েছে দেশটি। ১৪৭ তম অবস্থান থেকে পাঁচ ধাপ পিছিয়ে এবার ভুটান রয়েছে ১৫২ তম অবস্থানে।
ভারত-বাংলাদেশে 'ধর্মীয় উগ্রবাদ' নিয়ে উদ্বেগ
ভারতকে ‘বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র' উল্লেখ করলেও দেশটিতে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে ব্যাপক উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, "২০১৪ সাল থেকে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতা এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদী ডানপন্থার মূর্ত প্রতীক প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শাসনাধীন" দেশটিতে "সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, গণমাধ্যমের মালিকানা কেন্দ্রীভূত হওয়া এবং রাজনীতিকরণের ফলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সংকটে পড়েছে"।
প্রতি বছর ভারতে গড়ে দুই থেকে তিন জন সাংবাদিক তাদের কাজের কারণে মৃত্যুবরণ করেন। দেশটিকে গণমাধ্যমের জন্য 'বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশগুলোর একটি' বলে উল্লেখ করেছে আরএসএফ।
সূচকে ভারত বিষয়ক পর্যবেক্ষণের অংশে বলা হয়েছে, "ভারতীয় সমাজের বিশাল বৈচিত্র্য গণমাধ্যমের দৃশ্যপটে প্রতিফলিত হয় না। সাংবাদিকতা পেশা, বিশেষ করে পরিচালক পদে এখনো উচ্চ বর্ণের হিন্দু পুরুষদের অধিকারে রয়ে গেছে।" উদাহরণ হিসাবে সন্ধ্যার প্রধান টক শো-তে নারীদের প্রতিনিধিত্ব ১৫ শতাংশেরও কম।
আরএসএফ আরো বলেছে, "হিন্দু জাতীয়তাবাদী মতাদর্শের ক্ষমতায় উত্থান ঘটেছে। বেশিরভাগ টিভি, বিশেষ করে হিন্দিতে, তাদের সম্প্রচারের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ধর্মীয় সংবাদের জন্য ব্যয় করে, কখনো কখনো প্রকাশ্যে মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা প্রচার করে।"
তবে মূলধারার সংবাদমাধ্যমের বাইরে বিপরীত উদাহরণও তুলে ধরেছে আরএসএফ। খবর লহরিয়া নামের সংবাদমাধ্যমের উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে, যা সম্পূর্ণরূপে গ্রামীণ এলাকার নারী সাংবাদিক এবং জাতিগত বা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দ্বারা পরিচালিত।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনার শাসনামলে গণমাধ্যম তীব্র স্বাধীনতার সংকটে ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবাদলে শেখ হাসিনার সরকার উৎখাত হওয়ার পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের বাংলাদেশ বিষয়ক অংশে।
জনপ্রিয় কয়েকটি বেসরকারি টেলিভিশনের (যমুনা টিভি, সময় টিভি এবং একাত্তর টিভি) নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এসব টিভি চ্যানেল "সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনকে সমর্থন করেছে, কিন্তু এখন অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা থেকে বিরত থাকে। প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারের উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এই দুটি দৈনিক "একটি নির্দিষ্ট (পরিমাণ) সম্পাদকীয় স্বাধীনতা বজায় রাখতে সক্ষম" হয়েছে।
আরএসএফ বলেছে, "সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে সংজ্ঞায়িত হলেও, বাংলাদেশ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই অস্পষ্টতা গণমাধ্যমে প্রতিফলিত হয়, যেখানে ধর্মীয় বিষয় সম্পর্কিত যে-কোনো কিছু সীমাবদ্ধ নয়।" বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু এক কোটি হলেও "মূলধারার গণমাধ্যম কখনোই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে না" বলে মনে করে সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক এই সংগঠনটি।
গত দশকে উগ্র ইসলামপন্থিদের 'সহিংস প্রচারণায়' সাংবাদিকদের হত্যার ঘটনা ঘটার কথা উল্লেখ করেছে আরএসএফ। পাশাপাশি এই গোষ্ঠীগুলো এখন "ধর্মনিরপেক্ষতা, বিকল্প মতের অধিকার এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলা সাংবাদিকদের খুঁজে বের করতে এবং হয়রানি করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করছে" বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়৷
এডিকে/এসিবি (রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স)