স্বজনকে পথ চেনাতে গিয়ে মবের হাতে প্রাণ গেল রুপলাল ও প্রদীপের
১১ আগস্ট ২০২৫শনিবার রাতে রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুর এলাকার এই ঘটনা ঘটে৷ নিহত ব্যক্তিরা হলেন উপজেলার কুর্শা ইউনিয়নের ঘনিরামপুর এলাকার বাসিন্দা রুপলাল দাস এবং মিঠাপুকুর উপজেলার বালুয়াভাটা গ্রামের প্রদীপ দাস৷ প্রদীপ দাস সম্পর্কে রুপলাল দাসের ভাগনির স্বামী ছিলেন৷
বাবাকে হারিয়ে আর্তচিৎকার করেন দুই মেয়ে৷ বাকরুদ্ধ, দিশেহারা পরিবারটি৷
এই ঘটনায় রোববার একটি মামলা দায়ের করেন নিহত রুপলালের স্ত্রী ভারতী রানী৷ ভিডিও ফুটেজ দেখে এখন পর্যন্ত ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে চারজনকে আটক করেছে পুলিশ৷ এদিকে এই ঘটনাকে এই ঘটনাকে ‘বিপজ্জনক ও অগ্রহণযোগ্য' আখ্যা দিয়ে তীব্র নিন্দা জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)৷
রাস্তা না চেনায় স্বজনকে পথ দেখাতে গিয়েছিলেন
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম প্রথম আলোর খবরে বলা হয়, নিহত রুপলাল দাস জুতা সেলাইয়ের কাজ করতেন৷ আর প্রদীপ দাস ভ্যান চালাতেন৷
নিহত ব্যক্তিদের পরিবার, পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে প্রথম আলো জানায়, মিঠাপুকুর উপজেলার শ্যামপুর এলাকার এক তরুণের সঙ্গে রুপলাল দাসের মেয়ে নুপুর দাসের বিয়ে কথাবার্তা চলছিল৷ রোববার বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করার কথা ছিল৷ এ জন্য মিঠাপুকুর থেকে নিজের ভ্যান চালিয়ে আত্মীয় রুপলাল দাসের বাড়ির উদ্দেশে রওনা হন প্রদীপ দাস৷ কিন্তু গ্রামের ভেতর দিয়ে রাস্তা না চেনায় প্রদীপ দাস সয়ার ইউনিয়নের কাজীরহাট এলাকায় এসে রুপলালকে ফোন করেন৷ রুপলাল সেখানে যান৷ তারা দুজনে ভ্যানে চড়ে রুপলালের বাড়ি ঘনিরামপুর গ্রামের দিকে রওনা হন৷ রাত ৯টার দিকে তারাগঞ্জ-কাজীরহাট সড়কের বটতলা এলাকায় পৌঁছালে ভ্যানচোর সন্দেহে তাদের দুজনকে থামান স্থানীয় কয়েকজন৷ এরপর সেখানে লোক জড়ো হতে থাকে৷
পরিবার, পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে প্রথম আলো আরো জানায়, গত ২৮ জুলাই ওই এলাকায় এক শিশুকে হত্যা করে একটি ভ্যান চুরি করা হয়৷ এ ঘটনায় স্থানীয় লোকজন ক্ষুব্ধ ছিলেন৷ একপর্যায়ে স্থানীয় লোকজন প্রদীপ দাসের ভ্যানে থাকা বস্তা থেকে চারটি প্লাস্টিকের ছোট বোতল বের করেন৷ সেগুলোতে চোলাই মদ ছিল বলে পরিবারের ভাষ্য৷ একটি বোতল খুললে ভেতরে থাকা তরলের ঘ্রাণে সেখানকার দুই ব্যক্তি অসুস্থ বোধ করেন বলে জানান৷ এ ঘটনায় লোকজনের সন্দেহ আরও বাড়ে৷ অজ্ঞান করে ভ্যান চুরি সন্দেহে তাদের মারধর শুরু করেন৷ বটতলা থেকে মারতে মারতে বুড়িরহাট উচ্চবিদ্যালয় মাঠে নিয়ে আসা হয় তাদের৷ মারধরের একপর্যায়ে অচেতন হলে সেখানে ফেলে রাখা হয়৷ পরে রাত ১১টার দিকে তাদের উদ্ধার করে তারাগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায় পুলিশ৷
হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক রুপলাল দাসকে মৃত ঘোষণা করেন৷ প্রদীপ দাসকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে রোববার ভোরে তিনিও মারা যান৷
এলাকাবাসীর বিক্ষোভ
এদিকে গণপিটুনির ঘটনার পর রোববার সন্ধ্যায় মরদেহ নিয়ে রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে এলাকাবাসী৷
প্রায় এক ঘন্টার বিক্ষোভে সড়কের দুই দিকেই শত শত যানবাহন আটকে পড়ে৷
খবর পেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুবেল রানা ও সেনাবাহিনীর একটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আসামিদের গ্রেপ্তারের আশ্বাস দিলে বিক্ষোভকারীরা সড়ক থেকে সরে যান৷
দৈনিক প্রথম আলো জানায়, আজ সোমবার সকাল ১০টার দিকে ঘটনাস্থল বটতলা যাওয়ার পথে সড়কে সেনাবাহিনী ও পুলিশকে টহল দিতে দেখা গেছে৷
সন্দেহভাজন গ্রেপ্তার
গণপিটুনির ঘটনায় অজ্ঞাত পরিচয়ের ৭০০ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন নিহতের স্ত্রী ভারতী রানী৷
ঘটনার ভিডিও ফুটেজ দেখে পুলিশ সন্দেহভাজন চার ব্যক্তিকে আটক করেছে৷
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন উপজেলার সয়ার ইউনিয়নের বালাপুর এলাকার এবাদত হোসেন, বুড়িরহাট এলাকার আক্তারুল ইসলাম, রফিকুল ইসলাম ও রহিমাপুরের মিজানুর রহমান৷
এ বিষয়ে তারাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এমএ ফারুক বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি, ভিডিও বিশ্লেষণ ও স্থানীয় বাসিন্দাদের দেওয়া তথ্য মিলিয়ে ঘটনাটির সঙ্গে জড়িত চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ অন্যদের গ্রেপ্তারেও অভিযান চলছে৷
‘মানবাধিকার মানদণ্ডে অত্যন্ত বিপজ্জনক'
তারাগঞ্জে হিন্দু সম্প্রদায়ের দুই জনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও তীব্র নিন্দা জানিয়েছে মানবাধিকার সংস্থা আসক৷সোমবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে ঘটনার নিন্দা জানায় সংস্থাটি৷
বিবৃতিতে বলা হয়, রংপুরে তারাগঞ্জ উপজেলা এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের দুই জন নাগরিককে ভ্যান চুরির সন্দেহে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) গভীর উদ্বেগ ও তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে৷ এ ধরনের ঘটনা প্রচলিত আইন, সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের দৃষ্টিতে অত্যন্ত বিপদজনক ও অগ্রহণযোগ্য৷
আসক আরো বলেছে, সংবিধানের ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদে নাগরিকের জীবন ও আইনগত সুরক্ষার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে; যা এই ঘটনায় গুরুতরভাবে লঙ্ঘিত হয়৷ এ ধরনের ঘটনা বিচারহীনতার সংস্কৃতিকে দীর্ঘায়িত করছে; যা সামাজিক সম্প্রীতি ও আইনের শাসনের জন্য হুমকি৷
আরআর/এসিবি (প্রথম আলো, বাংলা ট্রিবিউন)