সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দিয়ে ধৃত অধ্যাপক
২০ মে ২০২৫অপারেশন সিঁদুর নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় মন্তব্যের অভিযোগে রবিবার গ্রেপ্তার হন হরিয়ানার অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আলি খান মাহমুদাবাদ। এই গ্রেপ্তারিকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছেন তিনি। তার আবেদন জরুরি ভিত্তিতে শুনতে রাজি হয়েছে আদালত। মঙ্গলবার বা বুধবার আবেদনে শুনানির সম্ভাবনা রয়েছে। অধ্যাপকের হয়ে আদালতে পিটিশন ফাইল করেন আইনজীবী কপিল সিব্বল।
অশোকা ইউনিভার্সিটি হরিয়ানার সোনিপতে। সেখানকার সহকারী অধ্যাপক আলি খান মাহমুদাবাদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান তিনি। রবিবার তাকে দিল্লি থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। অভিযোগ, অপারেশন সিঁদুর ও কর্নেল সোফিয়া কুরেশিকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় মাহমুদাবাদ যা লিখেছেন, তা দেশবিরোধী।
কী লিখেছিলেন এই অধ্যাপক? সম্প্রতি অপারেশন সিন্দুর নিয়ে ফেসবুকে মাহমুদাবাদ যা লেখেন, তার সার কথা, ‘অনেক ডানপন্থী কর্নেল সোফিয়া কুরেশির প্রশংসা করছেন। খুবই ভালো। তবে তারা যদি একই ভাবে গণপ্রহার, বুলডোজার বিচার, ঘৃণার রাজনীতির শিকার মুসলিম নাগরিকদেরও নিরাপত্তার দাবি করতেন...। দুই মহিলা সেনা আধিকারিককে প্রথম সারিতে তুলে আনা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সব ক্ষেত্রেই একই রকম হওয়া বাঞ্ছনীয়। না হলে তা হিপোক্রেসি।’
এই সোশ্যাল পোস্ট নিয়ে হরিয়ানার বিজেপির যুব মোর্চার সাধারণ সম্পাদক যোগেশ জাথেরি থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। তিনি জাথেরি গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান। একই সঙ্গে হরিয়ানার মহিলা কমিশনও অধ্যাপককে নোটিস দেয়। দাবি করে, এ ধরনের মন্তব্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিঘ্ন ঘটাতে পারে। মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন রেনু ভাটিয়া সমন জারি করলেও অধ্যাপক হাজিরা দেননি। বরং তিনি বলেন, এক্তিয়ার বহির্ভূত কাজ করেছে কমিশন। এর পরে সোনিপতের রাই থানায় অভিযোগ জানায় কমিশন। জোড়া অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হয় ৪২ বছর বয়সি মাহমুদাবাদকে। সোমবার এই গ্রেপ্তারিকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে আর্জি জানান অধ্যাপক।
অশোকা ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি কাউন্সিল গ্রেপ্তারির তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। তাদের বক্তব্য, সুপরিকল্পিত ভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে মাহমুদাবাদকে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ভিত্তিহীন ও ঠুনকো। তাকে দিল্লি থেকে গ্রেপ্তার করে সোনিপতে নিয়ে আসা হয়। ঘন্টাখানেক তাকে গাড়িতে ঘোরানো হয়, কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলা হয়নি।
ইতিহাসে এমফিল করার পরে কেমব্রিজ থেকে সোশ্যাল সায়েন্সে পিএইচডি করেন মাহমুদাবাদ। তার প্রতি সংহতি প্রকাশ করে তার সহকর্মীরা বিবৃতি দিয়েছেন, মাহমুদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন মূল্যবান সদস্য যিনি ছাত্রদরদি শিক্ষক। তিনি একজন দায়িত্বশীল নাগরিক। অধ্যাপক তার জ্ঞান ও চর্চাকে দেশের সম্প্রীতি এবং সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে প্রয়োগ করেছেন।
অনেকেই ধৃত অধ্যাপকের পাশে দাঁড়িয়েছেন। অনেকে আবার প্রশ্ন তুলেছেন তার মন্তব্যের সময় নিয়ে।
সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র ডিডাব্লিউকে বলেন, এটা মূলত বিজেপি সরকারের সমালোচনা। এখানে কোন দেশদ্রোহিতা বা মহিলাদের সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য নেই। সরকার অসহিষ্ণুতার কারণে অতীতেও অনেকের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়েছে। আমার ধারণা, শেষ পর্যন্ত এগুলো প্রমাণ করতে পারবে না। পশ্চিমবঙ্গে অম্বিকেশ মহাপাত্রকে নিয়ে এরকম ঘটনা ঘটেছিল। অন্যান্য রাজ্য লেখা বা টুইট করার জন্য এরকম বহু ঘটনা ঘটেছে, সুপ্রিম কোর্ট তাতে হস্তক্ষেপ করেছে। সম্প্রতি স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান কুণাল কামরাকে নিয়ে এরকম ঘটনা ঘটেছে।"
তার মতে, "সমালোচনা শুনতে প্রস্তুত নয় সরকার। অধ্যাপক বুলডোজার বা গনপিটুনি নিয়ে যে কথা বলেছে , সেটা সত্যি। সুপ্রিম কোর্ট বুলডোজার নিয়ে একাধিকবার বলেছে। গণপিটুনিতে ক্ষতিগ্রস্তদের দেখলেই বোঝা যাবে ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ কারা। অধ্যাপক সে কথাই বলেছেন।"
অধ্যাপকের সংখ্যালঘু পরিচয় কি তার গ্রেপ্তারের কারণ? শুভাশিস বলেন, "দৃষ্টান্তগুলি মানুষের এরকম ধারণার পক্ষেই যায়। খুবই আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন হরিয়ানার বিজেপি মন্ত্রী, মধ্যপ্রদেশের বিজেপি মন্ত্রী। তাদের ক্ষেত্রে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। আদালত বলা সত্ত্বেও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। দুর্বল করে এফআইআর লেখা হয়েছে মধ্যপ্রদেশের মন্ত্রীর ক্ষেত্রে, সুপ্রিম কোর্ট যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তাই মানুষের এরকম ধারণা তৈরি হতে পারে।"
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্রকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার গ্রেফর করেছিল কার্টুন কাণ্ডে। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, "এটা যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির পক্ষে বার্তা। কোনোভাবেই সেটা সংবিধানের বিরুদ্ধে নয়, আমাদের দেশের আইনের বিরুদ্ধে নয়। এটা তিনি নাগরিক অধিকার থেকে বলতেই পারেন। এর মধ্যে দেশদ্রোহিতার কোনো জায়গা নেই। হরিয়ানার শাসক দল বিষয়টাকে পছন্দ করছে না, তাই বিজেপি সরকার গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু দেশের আইন ও সংবিধান অনুযায়ী গ্রেপ্তার করার কোনো জায়গা নেই।"
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক শুভময় মৈত্র ডিডাব্লিউকে বলেন, "প্রথমত পড়শি দুটো দেশে যুদ্ধের জন্য ভারতের যে অশান্ত পরিস্থিতি, সেটা বুঝতে হবে। দ্বিতীয়ত, সাইবার আইন অনুযায়ী কোথাও লিখলে বা বললে সেগুলো বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। এটা আমাদের দেশে ঘটে যে, একই ধরনের দোষ শাসক দল করলে তাদের শাস্তি হয় না, বিরোধীরা শাস্তি পায়। এরকম উদাহরণ অনেক আছে। আবার অনেক সময় সঠিক বিচার হয়, এরকম উদাহরণও প্রচুর আছে। আইন অঙ্ক নয়, তার ব্যাখ্যার নিরিখে সেই জায়গার প্রশাসন এবং শাসক বিষয়টা ঠিক করে।"
তার মতে, "হরিয়ানায় ভোটে জিতেছে সদ্য বিজেপি। অশোকা বিশ্ববিদ্যালযের অধ্যাপকের মন্তব্য এই সময়ের নিরিখে হয়তো কিছুটা স্পর্শকাতর। যথারীতি ক্ষমতাসীন বিজেপির রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাধন করবে। সুতরাং এই ঘটনায় কাউকে ঠিক বা ভুল বলাটার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বজায় রাখার দায়িত্ব একদিকে শাসকের আছে, তাদেরও ভাবা উচিত তারা বিরোধী থাকলে কী হতে পারত। উল্টোদিকে এটাও বুঝতে হবে, দেশে যে পরিস্থিতি চলছে এখন, বুদ্ধিজীবী মানুষজন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার যে রাস্তাটা বুদ্ধি করে করছেন কিনা।"
তিনি বলেন, "সমাজ মাধ্যমে আমাদের ঝগড়াঝাঁটি প্রচণ্ড বেড়ে গিয়েছে। প্রতিটি কথা, তার প্রতিটি ব্যাখ্যার বিপরীতে কোন দল কী করবে, আগের থেকে নির্ধারিত হয় না। বুদ্ধিজীবীরা বক্তব্য রাখবেনই। কিন্তু সেই বক্তব্য রাখার জায়গাগুলো হওয়া উচিত সংবাদমাধ্যম, সাংবাদিক সম্মেলন, জার্নালে লেখা। যার মাধ্যমে একটা সঠিক পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে এগোনো যায়। চটজলদি কমেন্ট করে দেওয়া এবং তার পিছনে যদি কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থন না থাকে, তাহলে তাকে অনেক সময়ই তার প্রতিষ্ঠান বা বন্ধু-বান্ধবরা রক্ষা করতে পারবেন না। উল্টোদিকে এটাই যদি বিজেপির একজন নেতা কংগ্রেসের নেতার বিরুদ্ধে করতেন, কংগ্রেস এগিয়ে আসত। ফলে সাধারণ বুদ্ধিজীবী সমাজকেও বুঝতে হবে, প্রতিবাদের ধরন কেমন হবে।"
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ অ্যান্ড সাউথ ইস্ট এশিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রধান, অধ্যাপক রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী ডিডাব্লিউকে বলেন, "অধ্যাপককে গ্রেপ্তার করা সমর্থন করি না, তাকে এখনই ছেড়ে দেয়া উচিত। তবে দেশ যখন সম্মিলিতভাবে যুদ্ধের এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, দেশ যখন একটা সংকট মুহূর্তে তখন জাতির ঐক্যবদ্ধ থাকাটা খুব দরকার। সেই সময় যুদ্ধ বিরোধিতার এই কথাগুলো পোস্ট করে উনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, উনি সরকারের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সহমত নন। অনেকে ভাবতে পারেন, যারা আমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে, উনি তাদের সাপোর্ট করছেন, এটা ভাববার একটা সুযোগ উনি করে দিলেন।"
তার মতে, "সেনাবাহিনীর দুজন মহিলা অফিসার সাংবাদিক বৈঠক করেছেন বিদেশ সচিবের সঙ্গে, এটা নারীর ক্ষমতায়নকে ইঙ্গিত করেছিল। নিশ্চিতভাবেই এতে যে সব নারীর ক্ষমতায়ন ঘটেছে, এমনটা নয়। তবুও যুদ্ধের সময় এটা যদি বলা হয় যে মেয়েরা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই আছে, এটা অলংকার মাত্র। দেখানো হচ্ছে শুধু। মেয়েদের সম্মানের জায়গায় যে জাতীয় ঐক্য তৈরি হয়, সেখান থেকে দেশ এগিয়ে যাওয়ার কথা ভাবে, এই জায়গায় দাঁড়িয়ে সমালোচনা করা ওর মতো একজন অধ্যাপকের পক্ষে অসুবিধাজনক। কারণ অনেকেই মনে করতে পারেন, ওর বক্তব্য ঠিক, সরকারের বক্তব্য ভুল। অর্থাৎ যারা সন্ত্রাসবাদ ছড়াচ্ছে তারাই ঠিক। এরকম একটা ভাবনা এসে যেতে পারে। উনি যুদ্ধবিরোধী লেখা লিখুন, কত ক্ষতি হচ্ছে, কত অসুবিধা হচ্ছে, যুদ্ধের বিকল্প কী আছে, সেটাও লিখুন না। উনি পলিটিক্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক, কীভাবে পাকিস্তানকে ঠেকানো যায়, সন্ত্রাসবাদ দূর করা যায়, সেটাও বলুন।"
তিনি বলেন, 'সন্ত্রাসবাদ আটকাতে ভারতের এটা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। এই জায়গায় দাঁড়িয়ে অধ্যাপকের উচিত ছিল গঠনমূলক সমালোচনা বা সমাধানের কথা বলা। সেটা না করে উনি বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন।"
শুভময় বলেন, "দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে দুটো দিককেই সচেতন হতে হবে। শাসককে সাবধান হতে হবে, অকারণে গণতান্ত্রিক বক্তব্যকে রুখে দেওয়ার জন্য তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া চলবে না। এক্ষেত্রে বিজেপির উচ্চতর কর্তৃপক্ষকে দেখতে হবে, এমন কিছু বলা হয়েছিল কি না। পশ্চিমবঙ্গেও এমন ঘটনা ঘটেছিল অম্বিকেশ মহাপাত্রের ক্ষেত্রে। এই ধরনের সমস্যা সব রাজ্যেই আছে। উল্টোদিকে বুদ্ধিজীবীদের দেখতে হবে, উল্টোদিকের পক্ষ যে তার মতো করে ব্যাখ্যা করবে, এটা তিনি আটকাতে পারেন না। গণতন্ত্রে তিনি হয়তো যা খুশি বলতে পারেন। ফলে তার বিরুদ্ধে কেউ যদি বক্তব্য রাখে, তাকে সেটা সামলাতে হবে। এক্ষেত্রে তার প্রতিষ্ঠান সেটা সামলাতে পারেনি, সামলাতে পারলে তাকে জেলে যেতে হত না।"
তার মতে, "নিরবিচ্ছিন্ন এই দ্বন্দ্ব গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে চলবেই। এই দ্বন্দ্ব কোনোভাবেই দেশের উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত নয়। গণতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। অশোকা ইউনিভার্সিটি যে ধরনের পড়াশোনা করে বা গবেষণা করে তা দেশের উন্নয়নের কথা ভেবে। তার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। মূল রাজনীতির স্রোত থেকে এই বিষয়টা অনেক দূরে।"