সুরতহাল-ময়নাতদন্ত ছাড়াই গোপালগঞ্জে নিহতদের সৎকার, হয়নি মামলা
গোপালগঞ্জে ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ পদযাত্রাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে নিহত চারজনের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন-সৎকার সম্পন্ন হয়েছে৷ ৯০ জন গ্রেপ্তার হলেও মামলা হয়নি৷ মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচজনে৷
গুলিতে নিহত পাঁচজন
গোপালগঞ্জে এনসিপির পদযাত্রা ঘিরে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে পাঁচজনে৷ ১৬ জুলাই বুধবার আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের হামলা চলাকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়৷ এতে ঘটনার দিন মারা যান দীপ্ত সাহা (২৫), রমজান কাজী (১৮), সোহেল মোল্লা (৪১) ও ইমন (২৪)৷ গুলিবিদ্ধ রমজান মুন্সী (৩২) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার রাতে মারা গেছেন৷
সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করা হয়নি, হয়নি ময়নাতদন্ত
নিহত চারজনের দাফন ও সৎকার সম্পন্ন হলেও, তাদের কারও সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করা হয়নি, হয়নি ময়নাতদন্তও৷ স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, নিহতদের মধ্যে পোশাক ব্যবসায়ী দীপ্ত সাহাকে বুধবার রাতে পৌর শ্মশানে সৎকার এবং রমজান কাজীকে (বাদ এশা) দাফন করা হয়৷ বৃহস্পতিবার সকালে সোহেল রানা ও ইমন তালুকদারকে দাফন করা হয়েছে৷ পুলিশের গোয়েন্দা শাখার সদস্যরাও এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন৷
আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর বক্তব্য
গোপালগঞ্জ সদর থানার ওসি মীর মো. সাজেদুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘‘ময়নাতদন্ত ছাড়াই তিন জনের দাফন ও একজনের সৎকার হয়েছে৷’’ জেলা পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে জানান, নিহতদের সুরতহাল করা হয়নি এবং হাসপাতাল থেকে তাদের মৃত্যুসনদও দেওয়া হয়নি৷ গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক জীবিতেষ বিশ্বাস বলেন, ‘‘চারজনের মরদেহ হাসপাতালে এসেছিল৷ তাদের ময়নাতদন্ত হয়নি৷’’
গ্রেপ্তার হলেও হয়নি মামলা
এই ঘটনায় পুলিশ ৯০ জনকে আটক করলেও আজ বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি৷ ঢাকা রেঞ্জ পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) রেজাউল করিম মল্লিক সাংবাদিকদের এই তথ্য জানিয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘এ ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে৷ সদর থানায় এখন পর্যন্ত ৪৫ জন আটক আছেন। তাঁদের থানায় রাখা হয়েছে। এর আগে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত যৌথ বাহিনীর অভিযানে ২৫ জনকে আটক করা হয়েছিল। ’’
৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি
গোপালগঞ্জে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) জুলাই পদযাত্রা ঘিরে পুলিশের ওপর হামলা, গাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের জেলা সভাপতি নিউটন মোল্লা ও সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমানসহ ৭৫ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করা হয়েছে৷ মামলায় অজ্ঞাতনামা ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করা হয়েছে৷
রমজানের পরিবারে মাতম
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ নিহত রমজান কাজীর মা মর্জিনা বেগম৷ অভাবের সংসারে একমাত্র রোজগারের ব্যক্তি ছিলেন রমজান৷ তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না বলে দাবি মা মর্জিনা বেগমের৷
সংঘর্ষ-ভাংচুর-কারফিউ
১৬ জুলাই দিনভর দফায় দফায় গোপালগঞ্জে হামলা, ভাঙচুর, সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে৷ এতে অন্তত নয়জন গুলিবিদ্ধসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হন৷ ঘটনার পরপরই শহরে কারফিউ জারি করা হয়, যা চলে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত৷
এনসিপির জুলাই পদযাত্রা
সারা দেশে মাসব্যাপী জুলাই পদযাত্রা কর্মসূচির অংশ হিসেবে ‘মার্চ টু গোপালগঞ্জ’ ঘোষণা করে এনসিপি৷ এই কর্মসূচি ঘিরে চার দফায় হামলা চালায় কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগ ও নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা৷ পুলিশ সদস্য ও তাদের গাড়ি, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), শহরের পৌর পার্কে এনসিপির সমাবেশস্থল, জেলা প্রশাসকের বাসভবন ও জেলা কারাগার চত্বরসহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন স্থানে হামলার ঘটনা ঘটে৷
মঞ্চে হামলা
বেলা ২টা ৫ মিনিটে সমাবেশস্থলে পৌঁছান আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, সদস্যসচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ, মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমসহ নেতারা৷ এর আগে সমাবেশস্থলে মঞ্চ ভাঙচুর ও হামলা চালান আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা৷ পরে সমাবেশ শেষে হামলার শিকার হন এনসিপির নেতারা৷ বিকেল পাঁচটার দিকে সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির সহায়তায় গোপালগঞ্জ ত্যাগ করে এনসিপির নেতারা৷
গোপালগঞ্জের পরিস্থিতি
শহরে পুলিশ , র্যাব, সেনাবাহিনী, বিজিবি টহল দিচ্ছে৷ সেখানে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে৷
তদন্ত কমিটি গঠন
গোপালগঞ্জের ঘটনায় প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনির নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে৷ প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানিয়েছে, দু’সপ্তাহের মধ্যে পুরো ঘটনার তদন্ত করে প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টার কাছে জমা দিতে বলা হয়েছে৷ আরো বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকার দায়ীদের আইনের আওতায় আনার ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ৷ সরকার ন্যায় বিচার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ৷