সীমান্ত হত্যা বন্ধের পথ দেখাচ্ছে দুই দেশের নাগরিক সমাজ
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তকে বিশ্বের অন্যতম প্রাণঘাতী সীমান্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷ এই সীমান্ত হত্যা বন্ধের নানা উদ্যোগের কথা শোনা গেলেও তার কার্যকারিতা দেখা যাচ্ছে না৷ বাংলাদেশ ও ভারতের কয়েকজন নাগরিক জানিয়েছেন সমাধান৷
‘সীমান্তবাসীদের একে-অপরের দেশে আসা-যাওয়ার সহজ পন্থা দরকার’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষক সিলভিয়া নাজনীন মনে করেন, ‘‘বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বসবাস করা জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা ও ইতিহাস আমাদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন আছে৷ সীমান্ত মাত্রই এই মানুষদের দীর্ঘ ইতিহাস ও জীবনযাত্রার ধরন সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় না৷ ফলে সীমান্তের এই মানুষদের একে-অপরের দেশে আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে পাসপোর্টের বাইরেও আরো সহজ কোনো পন্থা ব্যবহার করা যেতে পারে৷’’
‘পারস্পরিক মর্যাদার ভিত্তিতে সম্পর্ক স্থাপন জরুরি’
ভারতীয় সাংবাদিক অর্ক ভাদুড়ি বলেন, ‘‘ফেলানি খাতুন থেকে স্বর্ণা দাস - পাখি শিকারের মতো মানুষ মারার এই ধারাবাহিকতা বন্ধ হওয়া জরুরি৷ সীমান্তে যদি কোনো বেআইনি কাজ হয়, তাহলে সম্পৃক্তদের গ্রেফতার করা যেতে পারে৷ দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী নিজ নিজ দেশ থেকে অন্য দেশে যাতে কেউ অবৈধভাবে ঢুকে না পড়ে তা নিশ্চিত করুক৷ দুই দেশের মধ্যে সমতার ভিত্তিতে, পারস্পরিক মর্যাদার ভিত্তিতে সম্পর্ক স্থাপন দরকার৷’’
‘শান্তিপূর্ণ সমাধানই একমাত্র পথ’
উদ্যোক্তা রুবাইয়া সুলতানা বলেন, ‘‘সীমান্ত হত্যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি গুরুতর বিষয়, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়৷ এটি বন্ধে কূটনৈতিক উদ্যোগ, শক্তিশালী সীমান্ত ব্যবস্থাপনা ও দুই দেশের পারস্পরিক সহযোগিতা জরুরি৷ শান্তিপূর্ণ সমাধানই হতে পারে একমাত্র পথ৷ আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সীমান্ত নজরদারিও বাড়ানো যেতে পারে৷ সবচেয়ে বেশি জরুরি হলো উভয় দেশের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করা৷’’
‘বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়তে হবে’
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না মনে করেন, ‘‘সীমান্তে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করতে হলে উভয় দেশেরই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে৷ আমরা তো কেউই প্রতিবেশী পাল্টাতে পারব না, তাই আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ এবং সমতার মাধ্যমে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হবে যেন এ ধরনের হত্যাযজ্ঞ না ঘটে৷ পাশাপাশি দুই সরকারের মধ্যে যে সকল আলোচনা হয় সেগুলোর যাতে মিনিংফুল ফলাফল আসে৷’’
‘সীমান্ত হত্যা রাজনৈতিক সমস্যা’
সংগীতশিল্পী ফারজানা ওয়াহিদ বলেন, ‘‘সীমান্ত হত্যা রাজনৈতিক সমস্যা, দুই রাষ্ট্রে যারা দায়িত্বে আছেন তাদের মধ্যে আলোচনা করতে হবে, দুই দেশের মোড়লরা যদি ঠিক থাকে তাহলে হয়তো হত্যাযজ্ঞ কমে আসবে৷ পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দুই দেশের নাগরিকদের মধ্যে বন্ধন তৈরি করতে হবে৷ তাহলে যে বন্ধন তৈরি হবে সে বন্ধনের কারণে হত্যা করাটা কঠিন হবে৷’’
‘মানুষ মারা পাপ’
ঢাকায় সিএনজি চালক মোহাম্মদ ইব্রাহিম সরদার মনে করেন, ‘‘সীমান্তে মানুষ মেরে ফেলা অন্যায়, অবৈধ কাজ৷ মানুষ মারা পাপ৷ এ ধরনের সমস্যা সমাধানের জন্য সাধারণ নাগরিকরা কিছুই করতে পারবে না৷ দুই দেশের সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে৷ সীমান্তে যদি কোনো দেশের নাগরিক অন্যায় করে তাহলে তাকে যেন না মেরে জেল-জরিমানা করা হয়, কোনোভাবে হত্যা করা না হয়৷ এ ব্যাপারে দুই দেশের সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে৷’’
‘প্রতিটি রাষ্ট্রকে ভূমিকা নিতে হবে’
ভারতীয় অভিনেত্রী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা অপরাজিতা ঘোষ বলেন, ‘‘আমি শুধু এটুকুই বলবো কোনোভাবে কোনো হত্যা, কোনো মৃত্যু কাম্য নয়৷ আমি কখনোই এ ধরনের হত্যা সমর্থন করি না এবং করবও না৷ কিন্তু এক্ষেত্রে যে-কোনো দেশের নিরাপত্তা যেহেতু নির্ভর করছে, সেখানে আমাদের প্রতিটা রাষ্ট্রকে ভূমিকা নিতে হবে যাতে এরকম হত্যা কমতে কমতে একেবারে শূন্যতে এসে পৌঁছায়৷’’
‘সীমান্ত হত্যা শত্রুতা তৈরির জন্য’
ঢাকায় হকার আবুল কাশেম বলেন, ‘‘সীমান্তে মানুষ মেরে ফেলা হচ্ছে এক ধরনের শত্রুতা তৈরি করার জন্য৷ এজন্য আমাদের দুই দেশের সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া উচিত যেন শত্রুতা না বাড়ে৷’’
‘জোরালো তৎপরতা প্রয়োজন’
গণমাধ্যম কর্মী নুসরাত জাহান জেরি বলেন, ‘‘সীমান্ত হত্যা শুধু রাজনৈতিক ইস্যু নয়, এটি মানবাধিকার, সার্বভৌমত্ব ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের নিষ্ঠুর উদাহরণ৷ জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা, প্রয়োজনে চাপ প্রয়োগ ও সীমান্ত চুক্তির কঠোর বাস্তবায়নই এ হত্যাকাণ্ড বন্ধের উপায়৷
‘প্রশাসন দুর্বল বলে এত মানুষ মারা যাচ্ছে সীমান্তে’
ঢাকায় অটোচালক মো. সোহান বলেন, ‘‘বাংলাদেশের প্রশাসন দুর্বল বলে আমাদের দেশের এত মানুষ সীমান্তে মারা যাচ্ছে৷ প্রশাসনকে এটা প্রতিরোধ করতে হবে৷ আমাদের সীমান্তে কোনো নাগরিক মারা গেলে প্রশাসন কোনো প্রতিবাদ করতে পারে না, কারণ আমাদের প্রশাসনে লোকবল কম, সীমান্তের নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য প্রশাসনের লোক বাড়াতে হবে৷ আমাদের সরকারের উচিত ১০০ শতাংশের উপরে উদ্যোগ নেয়া উচিত যাতে আমাদের দেশের জনগণ না মারা যায়৷’’
‘বাংলাদেশের উচিত আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়া’
ফটোসাংবাদিক পারভেজ আহমদ রনি বলেন, ‘‘ভারতের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেয়ার পরও যখন এই হত্যা বন্ধ হয় না তখন এটা একটা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি মনে হয়, আর এর পেছনে কোনো রাজনীতি আছে সেটা পরিষ্কার হয়৷ সীমান্ত হত্যা বন্ধে দুই দেশের সীমান্তের মানুষের জীবনকে ভেবে কোনো উদ্যোগ নেয়া জরুরি৷ এই বিচারবহির্ভূত সীমান্ত হত্যার বিচার চাওয়ার জন্য বাংলাদেশের উচিত আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়া৷’’