৩০ এপ্রিল দুপুরে এই লাইনটা মনে আসা অবশ্য অকারণ নয়। ময়মনসিংহের কবি শামীম আশরাফের ফেইসবুক লাইভ দেখতে আপনমনেই আওড়ালাম– "আমাদের কলাকেন্দ্রে, আমাদের সর্ব কারুকাজে/ অস্তিবাদী জিরাফেরা বাড়িয়েছে ব্যক্তিগত গলা।”
ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদের মুক্ত মঞ্চ, যেটি বীক্ষণ মঞ্চ নামেও পরিচিত, যেখানে প্রত্যেক শুক্রবার বীক্ষণ নামে একটি পাঠচক্র বসে, সেটি গুঁড়িয়ে দেওয়া নিয়ে ফেইসবুক লাইভে আক্ষেপ করছিলেন শামীম আশরাফ। শুরুতে ঠিকঠাক বুঝতে পারছিলাম না এই কলাকেন্দ্রটিতে কারা হামলা করেছেন? প্রথমে মনে হয়েছিল নিজেদের ‘তৌহিদী জনতা' বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন যারা এটাও তাদের কাণ্ড। একটুখানি শোনার পর বুঝতে পারলাম এটি সরকারি উচ্ছেদ অভিযান।
সরকার তো অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতেই পারে, তাই বলে না বলে-কয়ে সাহিত্য সংসদের মঞ্চ গুঁড়িয়ে দিতে হবে? যে মঞ্চটি আছে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে, যেখানে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ, হেলাল হাফিজ থেকে বাংলাদেশের সাহিত্য জগতের বহু গুণীজন, বহুবার ঘুরে এসেছেন।
মঞ্চটি সরকারি জায়গাতেই করা হয়েছে। সাহিত্য সংসদের লোকজন বলছেন, মঞ্চটি নির্মাণের সময় সেই সময়কার জেলা প্রশাসকের অনুমতি নেওয়া হয়েছিল। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম সেই অনুমোদন নেওয়ার দাবিটি সত্য নয়। তাই বলে চার দশক ধরে চলমান একটি মঞ্চ এক সকালে কাউকে কিছু না জানিয়ে ভেঙে দেওয়া যায়? জেলায় জেলায় এই রকম মঞ্চ তো সরকারের নির্মাণ করে দেওয়া উচিত। উচিত কাজটি কোনো সরকারই ঠিকঠাকভাবে সম্পাদন করেনি, করতে পারেনি। বরং সরকার বদলের পর লোক দেখানো উচ্ছেদ উচ্ছেদ খেলা শুরু হয়। সরকারি লোকজনের তো ভাবা উচিত ছিল, একটা পিঠার দোকান আর সাহিত্য মঞ্চের পার্থক্য আছে।
আমার বন্ধু আবুল কালাম আল আজাদ ঠিক বলেছেন, "শতশত একর জমি প্রশাসন এবং প্রভাবশালীরা নানাভাবে বেদখল করে রেখেছে। সেখানে কারো চোখ পড়ে না।”
ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার খিরু নদী নিয়ে একবার একটি প্রতিবেদন করেছিলাম। নদীটির অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেতে খুব বেশি দিন লাগবে বলে মনে হয় না। ময়মনসিংহের আরো অনেক নদনদীর কথা বলা যায়। খোদ ময়মনসিংহ শহরের পাশ দিয়ে বইয়ে যাওয়া ব্রহ্মপুত্রও দখল-দূষণে বিপণন। আবুল কালাম আল আজাদ এ ব্যাপারে আরো ভালো বলতে পারবেন, তিনি ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক। থাকেন ময়মনসিংহ শহরে। তাঁর ভালো করেই জানা আছে কোথায় কতটা দখল হয়েছে?
নিশ্চিহ্ন ‘শশীলজের পরি'
সংবাদ সংগ্রহের বারবার গিয়েছি ময়মনসিংহে। জেলার প্রত্যন্ত ঘুরেছি অনেক। আর ময়মনসিংহ শহরটাকে তো আমি আমার জন্ম শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মতো করেই চিনি। ময়মনসিংহবাসী নিজেদের শহরটাকে ‘শিক্ষা ও সংস্কৃতির নগরী' বলে দাবি করে থাকেন। আমার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লোকজন তো আমাদের শহরটাকে বাংলাদেশের ‘সাংস্কৃতিক রাজধানী' বলতে ভালোবাসে। এই সবই কানা ছেলের পদ্মলোচন নাম রাখার মতো। ময়মনসিংহ শহরে গৌরব করার মতো একটা বাড়ি আছে যার নাম শশী লজ। শশীলজের স্থাপত্য মুগ্ধ করার মতো। ওই বাড়ির সামনের সামনে গ্রিক দেবী ভেনাসের আদলে নির্মিত একটি ভাস্কর্য ছিল, যাকে ‘শশীলজের পরি' বলে ডাকা হতো। গত বছর ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও তাঁর দেশ ছাড়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে একদল হামলাকারী শশীলজে গিয়ে ভাস্কর্যটি ভেঙে টুকরো করে নিয়ে যায়।
৫ আগস্ট সম্প্রতি যেখানটায় সাহিত্য সংসদের মুক্তমঞ্চ ভাঙা হয়েছে, তার পাশে থাকা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আবক্ষ ভাস্কর্যও ভাঙা হয়েছিল। জয়নুলের ভাস্কর্যটি স্থানীয় শিল্পীরা সংস্কার করেছেন বলে শুনেছি। কিন্তু শশীলজের পরিটা তো পুননির্মাণ সম্ভব নয়। রাজা শশীকান্ত ওই নান্দনিক ভাস্কর্যটি ইতালি থেকে গড়িয়ে এনেছিলেন বলে শশীলজ জাদুঘর সূত্রে জানা যায়। ভাঙচুরের পরের দিন শশীলজ জাদুঘর কর্তৃপক্ষ একটি সাধারণ ডায়েরি করতে গিয়েছিলেন থানায়, সেই ডায়রিটি পুলিশ নেয়নি।
ঘটনা নতুন নয়
ভাস্কর্যসহ বিভিন্ন শিল্পস্থাপনা আক্রান্ত হওয়া, সাংস্কৃতিক সংগঠনে হামলা, পাঠাগারে ভাঙচুরের ঘটনা নতুন নয়। আগস্টের আগেও এমনটা বহুবার ঘটেছে। আমার শহর, সাংস্কৃতিক রাজধানীর দাবিদার ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে দু দুবার একটি গোষ্ঠীই ভাঙচুর করেছে ‘সুরসম্রাট দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন'। প্রথমবার ২০১৬ সালে এবার দ্বিতীয়বার ২০২১ সালে ভাঙচুর করা হয়। কোন হামলায় বেশি ক্ষতি হয়েছে নিরূপণ করা কঠিন। ২০১৬ সালে এখানকার জাদুঘরে রাখা সুরসম্রাটের ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র, হাতে লেখা চিঠিসহ যাবতীয় সামগ্রী পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। নিশ্চয়ই মরণ ওপাড় থেকে তিনি আর চিঠিগুলো লিখে দেওয়ার জন্য আসতে পারবেন না। বিশ্ববরেণ্য সংগীতজ্ঞ মাইহার ঘরানার শিল্পী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁয়ের নামে ১৯৫৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের কুমারশীল মোড়ে ৫৬ শতক জমির একটি বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘সুরসম্রাট দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন'।
সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ বিশ্বজয় করে ফিরে এসেছিলেন জন্মভিটায় শেষ জীবন কাটাবেন বলে। এখান যেটি সংগীতাঙ্গন, সেখানেই ছিল তাঁর বাড়ি। ছোটবেলায় প্রবীণদের কাছে শুনেছি কতিপয় ব্যক্তির নিত্যদিনকার কাজ হয়ে গিয়েছিল ওস্তাদের বাড়িতে ঢিল ছোঁড়া। ফলে তিনি ওই শহর ছেড়ে চলে গেলেন চিরতরে।
তবু ভাবতে ভালো লাগে আমার ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই নিঃশ্বাসের প্রথম বায়ুটুকু নিয়েছিলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ। বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ে লড়াই শুরু করা শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়িও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। পরে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁকে কুমিল্লা শহরের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি সেনারা। আরো আগে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অসামান্য ভূমিকা রেখেছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত। এক সরাইলেরই কত নাম বলা যায়। আমারই শহরে বড় ছিলেন আমার প্রিয় কথাসাহিত্যিক জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী। সরাইলে আছে সর্ব ধর্ম সমন্বয়বাদী আন্দোলনের পুরোধা আনন্দ স্বামীর আশ্রম। তাঁদের কারো ভিটেমাটি বেদখল হয়েছে, কারো কারো স্মৃতিচিহ্নও নিশ্চিহ্ন করা হচ্ছে। একটা গণঅভ্যুত্থানের পর পরিস্থিতি বদলাতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। বরং বেড়েছে যে এটা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই।
‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট'
গেল বছরের অগাস্টের ৫ তারিখ খবর পাচ্ছিলাম শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, শুধু তাই নয় তাকে দেশ থেকে বিতাড়নের প্রস্তুতি সম্পন্নপ্রায়। খবরটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচারের আগেই জেনে গিয়েছিল সাধারণ মানুষও। দুপুরের পর বেশ খুশি মনেই ঘর থেকে বের হয়েছিলাম। একজন সাংবাদিক হিসেবে ২০১৪ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত তিনটি নির্বাচন একেবারে মাঠ থেকে দেখেছি। ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচন হয় একতরফা, যেখানে বিরোধী দলগুলো অংশ নেয়নি। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। আগের রাতেই ব্যালটে সিল মারার ব্যাপক অভিযোহের কারণে এ নির্বাচন ‘রাতের ভোট' নামে পরিচিতি পায়। আর ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি আবার প্রধানমন্ত্রী হন। তবে এ নির্বাচনও বিতর্কিত। এতেও প্রধান বিরোধী দলগুলো অংশ নেয়নি। নিজদলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী করে ‘ডামি' প্রতিদ্বন্দ্বিতার আয়োজন করা হয়। এটিকে বলা হয় ‘আমি ও ডামির নির্বাচন'। তবে জুলাইয়ের কোটা বিরোধী আন্দোলনে যখন একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটছিল, তখন আর একেবারেই মেনে নিতে পারছিলাম না। এই আন্দোলনটিই পরে সরকার পতনের গণঅভ্যুত্থানে রূপ পায়। অভ্যুত্থানের দিনগুলো কর্ম ব্যস্ততায় কাটলেও রাতগুলো গেছে গভীর উৎকণ্ঠায়।
পথে পথে ভিড় ঠেলে এগোচ্ছিলাম রিকশায় করে। কিন্তু সংসদ ভবনের দিকটায় গিয়ে রিকশাও ছেড়ে দিতে হলো। কিছুদূর হেঁটে বিজয় সরণির কাছটায় গিয়ে দেখলাম ভাঙা হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই দেশজুড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বানানোর হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। অধিকাংশ ভাস্কর্যই ছিল অত্যন্ত কদর্য। কোনো কোনো ভাস্কর্য দেখে বন্ধুদের বলেছি, এর নিচে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম না লিখে দিলে তো চেনার উপায় নেই।
আমার বিবেচনায় ভাস্কর্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ভাস্কর্যটিই ছিল বিজয় সরণিতে এবং এটিকে আমি নিজের চোখে ভাঙতে দেখেছি। ২০২৩ সালে ১০ নভেম্বর ঢাকার বিজয় সরণিতে ‘মৃত্যুঞ্জয়ী প্রাঙ্গণ' নামে একটি চত্বর উদ্বোধন করেছিলেন শেখ হাসিনা। সেখানে স্থান পায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘মৃত্যুঞ্জয়' নামে একটি ভাস্কর্য এবং ভাস্কর্য চত্বরের সাতটি দেয়ালে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে অন্যান্য আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও অবদান চিত্রায়িত হয়েছিল।
৫ অগাস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর গণভবন ও সংসদ ভবনে ভাঙচুর করা হয়েছে। ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে আগুন দেওয়া হয়েছে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা স্তম্ভের ভূগর্ভে অবস্থিত স্বাধীনতা জাদুঘর। ভেবেছিলাম এগুলো জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের প্রকাশ। কিন্তু অন্তবর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরও থামেনি এই ধ্বংসযজ্ঞ।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট পরিবার-পরিজনসহ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। হাসিনা যখন ক্ষমতায় তখন এই ১৫ আগাস্টের আগের দিনগুলোতেই ঘরে টেকা দায় হয়ে যেত। বারবার বাজাতে বাজাতে সাতই মার্চের ভাষণেও মরচে ধরিয়ে দেওয়ার অবস্থা করা হয়েছিল। গত বছর ১৫ অগাস্ট হঠাৎ করেই সবকিছু থেমে গেল। আমার বাসা থেকে পশ্চিমে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক ওই বাড়িটির অবস্থান। তাই দিনের বেলা মনে হয়েছিল, ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট'। কিন্তু রাতটি আর শান্ত থাকেনি। রাতে সেখানে লুঙ্গি ড্যান্সের তাণ্ডব হয়েছে। অবশেষে এই বছর ফেব্রুয়ারিতে বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। টানা দুদিন ধরে তাণ্ডবের পর গরু জবাই করে জেয়াফত খাওয়া হয়েছে।
একুশের বইমেলা ও ঘৃণার ডাস্টবিন
একুশের বইমেলা ঘৃণা জানানোর ডাস্টবিন দিয়ে প্রথম দিনেই আলোচনায় চলে আসে। বইমেলায় একটি ডাস্টবিন রেখেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। মেলা চলাকালীন আদতে এটি বাংলা একাডেমির রাখা কিনা এ নিয়ে বিস্তর আলাপ হয়েছে। তবে যেহেতু এটি ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের স্টলের পাশে এবং তারা এমনটা করেনি বলে কোনো দাবি করেনি। তাই অধিকাংশ মানুষই মনে করেছে এটা তাদেরই করা এবং হাসিনার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নিহত ও নির্যাতিতদের সহযোদ্ধারা এটা করতেই পারে বলে মনে করেছে। বিগত বছরগুলোতে যেখানটায় থাকত ছাত্রলীগের স্টল, সেখানে এবার ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র সংগঠনটির স্টল। সেখানে রাখা ডাস্টবিনে সেঁটে দেওয়া হয়েছিল ‘শেখ হাসিনা ঘৃণা স্তম্ভে'র ছবি।
বইমেলার প্রথম দিনে এই ডাস্টবিনে ময়লা ফেলেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম এবং ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেজে এই ডাস্টবিনে কয়েকটি ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, "শনিবার বাংলা একাডেমিতে একুশে বইমেলার প্রথম দিনে বিনে জঞ্জাল নিক্ষেপ।”
ওইদিনই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফেইসবুক পেইজে এই ডাস্টবিনের একটি ছবি পোস্ট করে লেখা হয়, "আজ থেকে শুরু হয়েছে মাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলা-২০২৫। বইমেলায় এলে আপনার হাতের অপ্রয়োজনীয় ময়লা-আবর্জনা ডাস্টবিনে ফেলতে ভুলবেন না। মেলার অভ্যন্তরীণ পরিবেশ সুন্দর রাখুন, আবর্জনামুক্ত থাকুন।”
তসলিমা নাসরিনের বই রাখায় মেলার দশম দিন সন্ধ্যায় ‘তৌহিদী জনতা' পরিচয়ে একদল লোক ‘সব্যসাচী প্রকাশনা'র স্টলে গিয়ে প্রকাশককে ঘিরে ধরে স্লোগান দিতে শুরু করেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ সব্যসাচীর প্রকাশক শতাব্দী ভবকে বইমেলায় তাদের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে নিয়ে রক্ষা করে। পরে স্টলটি আর খোলা যায়নি। বরং সোহেল হাসান গালিবের বই প্রকাশের কারণে ‘তৌহিদী জনতা'র নামেই ভয় পাইয়ে দেওয়ায় উজান নামে অন্য একটি প্রকাশনাও নিজেদের স্টল বন্ধ করে রাখে। ১৩ ফেব্রুয়ারি রাতে কবিতায় ধর্ম অবমাননা করার অভিযোগ এনে গ্রেপ্তার কবি সোহেল হাসান গালিবের এখনও মুক্তি মেলেনি। বইটি ২০২৫ নয় ২০২৪ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান উজান থেকে প্রকাশিত বইয়ে গালিবের লেখা একটি কবিতা ঘিরে আলোচনা শুরু হয় এবং এই ঘটনায় ১১ ফেব্রুয়ারির পর বইমেলায় উজানের স্টল আর খোলা হয়নি।
বইমেলা এবার অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে খারাপ কেটেছে বলে প্রকাশকদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে। আড্ডা জমেনি, যারা মেলায় নিত্য দিন আড্ডা জমাতেন, তাদের অনেকেই যাননি। বেচাবিক্রিও হয়েছে কম।
মবের মুল্লুকে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা
সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করার কাজে সব সময় ‘তৌহিদী জনতা'র নাম ব্যবহার করা হয়নি। কখনও ছাত্রজনতা, কখনও আবার কতিপয় ব্যক্তির বাধার কথা বলা হয়েছে। তবে সব কিছুর দায় শেষ অবধি গিয়ে পড়েছে মবের নামে। এই মবের মুল্লুকে বহু মাজার ভাঙা হয়ে গিয়েছে। মেয়েদের খেলা বন্ধ করা হয়েছে। লালন স্মরণোৎসব পণ্ড হয়েছে।
সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়ার পরও ‘একদল ব্যক্তির হুমকির মুখে' গত ১৫ ফেব্রুয়ারি স্থগিত হয় ‘ঢাকা মহানগর নাট্য উৎসব'। বাধার মুখে বাতিল হয় উত্তরার বসন্ত উৎসব। চট্টগ্রামে অনুষ্ঠান চলাকালে অনুমতি বাতিল করায় বসন্ত উৎসব হয়েছে আংশিক। বসন্ত উৎসব আংশিক উদ্যাপন করা গেলেও চট্টগ্রামের ডিসি হিলে প্রতিবছর যে বর্ষবরণ হয়ে থাকে সেটা এবার পুরোই বাতিল করতে হয়েছে।
চট্টগ্রামে প্রথম বাংলা বর্ষবরণ উৎসব শুরু হয়েছিল ১৯৭৩ সালে নগরের সার্সন রোডের ইস্পাহানি পাহাড়ে। পল্লিকবি জসীমউদ্দীন প্রথম এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেছিলেন। তিন বছর ওখানেই ছোট পরিসরে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হয়। ১৯৭৮ সাল থেকে নন্দনকাননের ডিসি হিলে বাংলা বর্ষবরণ উৎসব শুরু হয়। আশির দশকের শেষ দিক থেকে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন অনেকবার এই উৎসবে গিয়েছি। বর্ষবরণের আগের দিন মিছিল নিয়ে এসে একদল লোক অনুষ্ঠান মঞ্চ ভাঙচুর করে চলে যায়। ফলে ৪৭ বছরে চট্টগ্রামবাসীর প্রাণের মেলায় রূপ পাওয়া ডিসি হিলের বর্ষবরণে ছেদ পড়েছে এবার।
ছায়ানটের বর্ষবরণেও বিঘ্ন ঘটাবার চেষ্টা হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসেই ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল পহেলা বৈশাখে ১০০ গরু জবাই করে জেয়াফত করা হবে। মঙ্গল শোভাযাত্রা তো হয়ে গেল আনন্দ শোভাযাত্রা। শুধু নাম পরিবর্তন নয় শোভাযাত্রাটিতে শেখ হাসিনার অবয়ব যোগ করে রীতিরও ব্যত্যয় ঘটানো হলো। এবার এই শোভযাত্রার মূল থিম করা হয়েছিল ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান'। শেখ হাসিনাকে ফ্যাসিবাদের প্রতীক বলে ভাবতে ব্যক্তিগতভাবে আমার আপত্তি নেই। তবে এই শোভাযাত্রায় অতীতে কখনও মানুষের মোটিফ রাখা হয়নি।
সরকারের একজন উপদেষ্টা শোভাযাত্রার কিছুদিন আগে নিজের ফেইসবুকে খালেদা জিয়ার একটি বীভৎস ধরনের মোটিফের ছবি দিয়ে পরিপ্রেক্ষিত তৈরিতে নামলেন। খালেদা জিয়ার ওই মোটিফটি তো নয়ই মঙ্গল শোভাযাত্রায় এবারের আগে কাউকেই মোটিফে রূপান্তর করা হয়। সর্বদাই প্রতীকী কিছুকে ব্যবহার করা হয়েছে এবং এবারও ফ্যাসিবাদের কোনো প্রতীকী মোটিফ বানানো যেত। নাম পরিবর্তন এবং বাঙালি ব্যতীত অন্য সব জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তির নামে একটি উৎসবের ঐতিহ্য বিসর্জন দেওয়া হয়েছে, যে আয়োজনটি ২০১৬ সালে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা অন পহেলা বৈশাখ' শিরোনামে অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কোর তালিকাভুক্ত হয়েছিল। মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন করে ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা' রাখায় ইউনেস্কোর স্বীকৃতি ধরে রাখতে নতুন করে আবেদন ও অনুমোদনের প্রয়োজন হবে।
মঙ্গল শোভাযাত্রায় এই সব পরিবর্তন আনায়সরকারের হস্তক্ষেপ যেমন আমরা টের পেয়েছি, তেমনি সাংস্কৃতিক অনেক আয়োজন যখন বিপণ্ন হয়েছে, তখন সরকারের নিষ্ক্রিয়তাও অনুভব করেছি। ফলে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ী উপজেলার অভয়ারণ্য পাঠাগার লুঠ হওয়া বই ফেরত পেলেও স্বস্তিতে নেই।