সরকারি খরচে দিঘার জগন্নাথ মন্দিরের প্রসাদ বিলি কেন?
২৪ জুন ২০২৫গত কয়েকদিন ধরে দিঘার মন্দিরের প্রসাদ পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। পৌঁছে দিচ্ছেন তৃণমূলের পুরসভা সদস্য, নেতা, কর্মীরা। এর জন্য রেশন দোকানগুলিতে তৈরি করা হয়েছে মহাপ্রসাদ বিতরণ কেন্দ্র। পোস্টারে লিখে রাখা হচ্ছে, মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায় প্রসাদ দেয়া হচ্ছে। সকলে যেন রেশন কার্ড সঙ্গে নিয়ে আসেন। এছাড়া কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেই প্রসাদ বিলি হচ্ছে।
তৃণমূলের মন্ত্রী, নেতা, পুরসভার সদস্যদের প্রসাদ বিলি করার ছবি টিভি চ্যানেলগুলিতে ঢালাও সম্প্রচার করা হচ্ছে। আলিপুরদুয়ারে তো তৃণমূলের পুরসভার চেয়ারম্যান সিপিএমের অফিসে পর্যন্ত গিয়ে প্রসাদ দিয়ে এসেছেন। বিজেপি-র নেত্রীর বাড়িতে গিয়েও দিয়েছেন। মিষ্টির বাক্সে একটা গজা ও একটা পেড়া দেয়া হচ্ছে। ২৭ জুন রথযাত্রার আগে এই প্রসাদ বিলি করে ফেলতে চায় তৃণমূল।
বিজেপি-র প্রশ্ন
পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি এভাবে জগন্নাথ মন্দিরের প্রসাদ বিলি নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে।
বিজেপি নেতা জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, ''হিডকো বলুক ৪২ কোটি টাকার গজা-পেড়া দেয়ার নির্দেশ ও অধিকার তাদের কে দিয়েছে?'' দুইদিন আগে তিনি বলেছেন, ''হিডকোর তরফে এখনো পর্যন্ত ৩২ কোটি টাকা বিভিন্ন জেলাশাসক ও কলকাতার পুর কমিশনারকে দেয়া হয়েছে। তারপর নবান্ন থেকে তাদের আরো ১০ কোটি টাকা দিতে বলা হয়েছে। তারা কোন অধিকারবলে এই অর্থ খরচ করেছে?''
হাউজিং ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভলাপমেন্ট কর্পোরেশন বা হিডকো রাজ্য সরকারের একটি সংস্থা। তারা বিভিন্ন পরিকাঠামো ও আবাসন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত।
তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষ বলেছেন, ''মুখ্যমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন এই প্রসাদ বিলি করার জন্য। সেখানে জনপ্রতিনিধিরা যদি নানাভাবে প্রসাদ পৌঁছে দেন, তার মধ্যে দোষ কোথায়? এর অপব্যাখ্যা হবে কেন জগন্নাথধামের প্রসাদ মানুষের কাছে যাতে পৌঁছায়, সর্বশক্তি দিয়ে সেই চেষ্টা করা হচ্ছে।''
সরকারি অর্থে প্রসাদ বিলি নিয়ে প্রশ্ন
তবে যে প্রশ্ন উঠেছে তা হলো, সরকারি অর্থে, করদাতাদের টাকায় কেন এইভাবে রাজ্যজুড়ে প্রসাদ বিলি করা হবে? রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''এটা হলো জনমোহিনী রাজনীতির অঙ্গ। বিজেপি-র দিকে যাতে হিন্দু ভোট চলে না যায়, তা ঠেকাতেই একাজ করা হয়েছে। যদি ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে দেখা হয়, তখন এই প্রশ্ন উঠবেই। কিন্তু আমরা যে ধর্মনিরপেক্ষতার আবহে বড় হয়েছি, তার থেকে বর্তমান অবস্থার একটা আমূল পরিবর্তন হয়েছে। রাজনীতিতে মূল্যবোধের পরিবর্তন হয়েছে।''
একটা সময় ছিল যখন সরকারি খরচে কেন সোমনাথ মন্দিরের পুনর্নিমাণ হবে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। তার সঙ্গে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্রপ্রসাদের দীর্ঘসময় ধরে একের পর এক চিঠি বিনিময় হয়েছিল এই বিষয়ে। শেষপর্যন্ত রাজেন্দ্রপ্রসাদের কথা মেনে নিতে হয় তাকে। সরকারি খরচেই সোমনাথ মন্দির আবার তৈরি হয়। প্রবীণ সাংবাদিক শরদ গুপ্তা সেই দৃষ্টান্ত টেনে ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''বর্তমানে ধর্ম ও রাজনীতির মধ্যে বিবাজনের রেখাটা ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।''
সাংবাদিক ও লেখক মিলন দত্ত ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''সরকারি পয়সায় মন্দির তৈরি করা, ইমাম ও পুরোহিতদের ভাতা দেয়া, ঈদগাহ ও কবরস্থানে পাঁচিল দেয়া, এখন প্রসাদ দেয়া সবই করদাতাদাদের পয়সায় হচ্ছে। প্রশ্ন হলো, করদাতাদের পয়সা কেন ধর্মীয় কাজে ব্যবহার করা হবে? এই অর্থ দিয়ে কেন উন্নয়নের কাজ হবে না?''
রাজনীতির লাভ-লোকসান
এইভাবে রাজনীতিতে কতটা লাভ পাওয়া সম্ভব? শরদ বলেছেন, ''লোকসভা নির্বাচনের আগে অসমাপ্ত রামমন্দিরের উদ্বোধন করা হয়েছিল। বিজেপি সারা দেশে এই উপলক্ষ্যে বাড়ি বাড়ি চাল নিয়ে গিয়েছিল। সাধারণ মানুষকে বাস, ট্রেন, গাড়িতে করে অযোধ্যা নিয়ে মন্দির দর্শন করিয়েছিল। কিন্তু তারপর অযোধ্যাতেই বিজেপি হেরে গেছিল। ফলে সবসময় যে এভাবে রাজনৈতিক লাভ তোলা সম্ভব এমন নয়।''
বিশ্বনাথ মনে করেন, ''বিজেপি-র দিকে যাতে হিন্দু ভোটের সিংহভাগ না যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই চেষ্টা করছেন। তিনি হিন্দুদের কাছে পৌঁছাতে চাইছেন। এটা তার পপুলিস্ট পলিটিক্সের অঙ্গ।''
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা কখনো কাজ করে, কখনো করে না। অযোধ্যায় বিতর্কিত কাঠামো ধ্বংসের পর উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান এই তিন রাজ্যে বিজেপি শাসিত সরকার বরখাস্ত করে বিধানসভা নির্বাচন হয়। তিনটি রাজ্যেই বিজেপি হেরে যায়। ফলে এই ফর্মুলা যে সবসময় সফল হবে এমন নয়।