কথায় বলে, কালো কালি, কালো ছায়া, আইনের ছলে ঘটে নির্যাতন মায়া। যে-কোনো রাষ্ট্রযন্ত্রের জন্য, সরকারের জন্য তার নাগরিকদের নিপীড়নের সবচেয়ে সহজ ও সুবিধাজনক উপায় হলো নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ। আর যেসব সরকারের জন্য আগে থেকে এমন আইন তৈরি থাকে, তাদের জন্য এমন কর্মসাধন অনেক বেশি সহজ হয়ে পড়ে। তখন তাদের একটি কাজই করতে হয়, সেটি হলো ওই আইনটি ব্যবহারের পক্ষে একটি ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে হয়। হোক সে ব্যাখ্যা যুৎসই বা খোঁড়া যুক্তিসম্বলিত। এমন সরকারের জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘সঙ্গীতের মুক্তি' প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘‘লাঠিয়ালের হাতে রাজদণ্ড দিলেও সে তাহা লইয়া লাঠিয়ালি করিতে চায়, কেননা, রাজত্ব করা তার প্রকৃতিগত নয়।'' এই যে শাসকের বা লাঠিয়াল বাহিনীর গদি ঠিক রাখার আইন – সেগুলোকে অনেকে বলেন, কালো আইন। কালো আইন বলতে এমন আইনকে বোঝানো হয় যা মৌলিক মানবাধিকারবিরোধী, অস্পষ্ট বা সংকীর্ণ ব্যাখ্যার মাধ্যমে নাগরিক স্বাধীনতাকে হরণ করে এবং প্রশাসনকে অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রদান করে। এই ধরনের আইন সাধারণত মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, এবং রাজনৈতিক মতাদর্শ চর্চাকে নিয়ন্ত্রণ বা দমন করতে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের আইনব্যবস্থায় কিছু আইনকে কালো আইন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই আইনগুলো সাধারণত মানবাধিকার লঙ্ঘন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণ এবং নাগরিকদের মৌলিক অধিকার সীমিত করার কারণে সমালোচিত। মজার ব্যাপার হলো, বাংলাদেশে প্রায় সব সরকারের আমলে কালো আইন প্রণীত হয়েছে, কিংবা ব্যবহৃত হয়েছে। এমনকি নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারও বাংলাদেশে নিবর্তনমূলক অধ্যাদেশ জারি করেছিল। আবার অন্তর্বর্তী সরকারও এ ধরনের আইন ব্যবহার করেছে। বলা যায়, কালো আইনের গায়ে কোনো দলীয় রঙ নেই। দল বদলায়, সরকার বদলায়, কিন্তু আইন থাকে – কালো রূপে। স্বৈরাচার নয়, গণতন্ত্রেও বাংলাদেশে কালো আইন টিকে থাকে।
সম্প্রতি মিস আর্থ বাংলাদেশ বিজয়ী মডেল মেঘনা আলমকে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী জোরপূর্বক আটক করে। আটকের একদিন পর আদালতের মাধ্যমে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের অধীনে ৩০ দিনের আটকাদেশ দিয়ে জেলহাজতে পাঠিয়ে দেয়। দেশের একজন সাধারণ নাগরিককে এভাবে গ্রেপ্তার এবং তার বিরুদ্ধে ৫০ বছরের পুরানো আইন ব্যবহার নিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা হতে আমরা দেখেছি। এত আলোচনার অন্যতম প্রধান কারণ হয়তো বর্তমান প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতা। এমন না যে, বাংলাদেশে অতীতে কখনোই কোনো কালো আইন ব্যবহৃত হয়নি বা সেসব আইন ব্যবহারের ক্ষেত্রে শাসকগোষ্ঠীর লাঠিয়াল চরিত্র কখনোই প্রকাশ পায়নি। কিন্তু জুলাই আন্দোলনের দায়িত্ব নেয়া নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রশাসনের কাছে দেশের মানুষের প্রত্যাশা ভিন্নরকম। বিশেষ করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে তিনি ও তার উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের যতটা গলাফাটানো আওয়াজ দিতে দেখা গেছে ততটা অতীতের সরকারগুলোর মধ্যে দেখতে পাওয়া যেতো না। সবচেয়ে বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল ৫০ বছরের আইনটি সবশেষ ব্যবহার হতে দেখা গিয়েছিল প্রায় ২১ বছর আগে। কিন্তু বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক বিশেষ সহকারী খোদা বকশ চৌধুরী সাফাই গাইলেন এই আইনটি ব্যবহারের যৌক্তিকতা নিয়ে। তিনি দাবি করেছেন, এই আইনে মেঘনা আলমের গ্রেপ্তার প্রক্রিয়া যথাযথ ছিল। তবে তার আগে সরকারের আইন উপদেষ্টার স্বীকারোক্তি ছিল, প্রক্রিয়াটি এবং এই আইনের ব্যবহার ঠিক ছিল না। কিন্তু খোদা বকশ চৌধুরী দাবি করলেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুলের বক্তব্যটি সরকারী ভাষ্য নয়, ওটা ছিল উনার ব্যক্তিগত মতামত। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর যে সংস্থাটি মেঘনা আলমকে গ্রেপ্তার করেছিলেন, সেটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন। এক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার উপস্থিতিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তিটি যখন এমন নিবর্তনমূলক আইন ব্যবহারের যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠার পক্ষে যুক্তি দেন, তখন এটিকে সরকারের সিদ্ধান্ত হিসেবে গ্রহণ করাটা অযৌক্তিক হবে না। ভেঙে পড়া আইনের শাসনকে জোড়া লাগাতে, হারিয়ে যাওয়া মানবাধিকারকে ফিরিয়ে আনতে ড. ইউনূসের উপদেষ্টা পরিষদকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। সরকারের পক্ষ থেকে সংস্কার নিয়ে অতিকথনে একটা ধারণা হয়েছিল, অন্ততপক্ষে সংস্কার তেমন একটা না হলেও অতীতের মতো মানবাধিকারহীনতা, জোরপূর্বক বা বলপ্রয়োগের চর্চা আর দেখা যাবে না। কিন্তু শুধু মেঘনাকে গ্রেপ্তার দেখানোর ক্ষেত্রে নয়, তারও দুইদিন পর চারুকলায় মোটিফে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায়ও একই আইন ব্যবহার করার নজির হাজির হয়েছিল।
১৯৭৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি বিশেষ ক্ষমতা আইন পাস হয়েছিল। এই আইন সরকারকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই যে কাউকে অনির্দিষ্টকালের জন্য আটকের ক্ষমতা দেয়। একেবারে লাঠিয়াল বাহিনীর জন্য উপযুক্ত ও যথার্থ আইন। অনেকে দাবি করেন, স্বাধীনতার পর আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে তখন আইনটি প্রণীত হয়েছিল। এই আইনের ভয়ঙ্কর দিকটি হলো, কোনো নিরাপরাধ ব্যক্তিকেও এই আইনের অধীনে গ্রেপ্তার করা যায়। গ্রেপ্তারের জন্য কোনো অজুহাত লাগে না। শুধু সরকারকে মনে করতে হবে, ব্যক্তিটি এমন অপরাধ করতে পারেন। বাংলাদেশের প্রায় সব রাজনৈতিক দল – যারাই যখন ক্ষমতায় ছিলেন আইনটি বাতিলের আশ্বাস দিয়েছিলেন। একই ধরনের আশ্বাস বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানও দিয়েছিলেন। ২০২৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছিলেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সে ভাষণে তিনি বলেছিলেন, সন্ত্রাস দমন আইন, ডিজিটাল/সাইবার নিরাপত্তা আইনে দায়েরকৃত মামলাগুলো শুধু প্রত্যাহারই করা হবে না, এমন কালো আইনের তালিকা করছে তার সরকার। তিনি জানিয়েছিলেন, শিগগিরই তার সরকার এসব কালো আইন বাতিল এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংশোধন করবে। কিন্তু আমরা উল্টো আমরা দেখলাম প্রায় অব্যবহৃত থাকা একটি আইনকে সরকার পরপর দুইবার ব্যবহার করলো।
বাংলাদেশের আরেকটি নিবর্তনমূলক বা কালো আইন হলো সাইবার নিরাপত্তা আইন। যেটি ২০২৩ সালে আওয়ামী লীগ সরকার পাশ করেছিল। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বহুল আলোচিত-সমালোচিত, দমন-পীড়নমূলক সাইবার নিরাপত্তা আইনটি বাতিলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সে প্রতিশ্রুতি পূলণ করতে গিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার আগের আইনটি বাতিল করে নতুন সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৪ প্রণয়ণের উদ্যোগ নিয়েছিল। গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর খসড়া অনুমোদিত হয়েছিল। এরপর এর বেশ কয়েকটি ধারা নিয়ে সমালোচনা হয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ অভিযোগ করে, ডিজিটাল আইনের মতোই অপব্যবহারের ঝুঁকি থাকছে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশে। এতে বুলিং, ধর্মীয় উস্কানি, ওয়ারেন্ট ছাড়া পুলিশের গ্রেপ্তার ক্ষমতা-সংক্রান্ত ধারাগুলোর মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে ফের কুক্ষিগত করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। টিআইবিসহ অনেকের অভিযোগ ছিল, অধ্যাদেশটি মূলত আগের ডিজিটাল বা সাইবার সিকিউরিটি আইনের পুনরাবৃত্তি হয়েছে।
এখানে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। বাংলাদেশে কালো বা নিবর্তনমূলক আইনের একটি ইতিহাস আছে। এর অর্থ হলো, নিবর্তনমূলক আইনগুলো ক্রমপরম্পরায় প্রণীত হয়। বাংলাদেশে যতগুলো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসেছে, তারা কোনো না কোনো সময় কোনো না কোনো কালো আইন জারি করেছে। সরকার আসে যায়, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন হয়; কিন্তু নিবর্তনমূলক আইনের ওপর সব সরকারের এক ধরনের নির্ভরতা ঠিকই থেকে যায়। যেমন, এই যে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ, তার মূলে আছে তথ্যপ্রযুক্তি আইন। সংক্ষেপে আইসিটি অ্যাক্ট নামে পরিচিত এই আইনটি প্রণীত হয়েছিল ২০০৬ সালে বিএনপি আমলে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে এই আইনের ব্যাপক প্রয়োগ শুরু করেছিল। ২০১৩ সালে সংশোধনীর মাধ্যমে এতে আরো কঠোর ধারা প্রয়োগ করা হয়। বিশেষ করে এই আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে সমালোচনা হয় ব্যাপকভাবে। গণমাধ্যমের শিরোনাম ছিল – মরা ছাগল খালে, ৫৭ ধারায় সাংবাদিক জেলে। সাংবাদিক ও সরকার সমালোচকদের হয়রানি ও নিপীড়নের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল এই ৫৭ ধারা। সমালোচনা সামাল দিতে আওয়ামী লীগ আইনটির বদলে নতুন করে, যেটি আরো ভয়াবহ – ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন। আইনকে শোষণ ও নিপীড়নের সর্বোচ্চ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের উদাহরণ হিসেবে বহুদিন এই আইনটির নাম উচ্চারিত হবে। বহু সমালোচনার পর বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ডিএসএ রদ করে নতুন আইন জারি করে, যার নাম সাইবার নিরাপত্তা আইন। সেটি ছিল ‘যে লাউ সেই কদু'র মতো। আগের আইনের কিছু অজামিনযোগ্য ধারাকে জামিনযোগ্য করে মূলত আইনটিকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। এই আইনগুলোর আরো আগে ২০০০ সালে জননিরাপত্তা আইন পাস হয়েছিল। আইনটির পুরো নাম ছিল ‘জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন আইন'। এই আইনে অভিযুক্তকে জামিন দেয়া যেতো না। যেমনটা
ডিএসএ-তে ছিল। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে জননিরাপত্তা আইনটি বাতিল করে নতুন আইন করে, যার নাম ছিল আইনশৃংখলা বিঘ্নকারী অপরাধ। এই আইনটি ছিল নতুন বোতলে পুরাতন পানীয় সরবরাহ করার ব্যবস্থা। জননিরাপত্তা আইনের মতো এই আইনটিও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল সব সময়েই এটিকে বিরোধী দলকে দমন-পীড়নে ব্যবহার করেছিল। বাংলাদেশের আরেকটি কালো আইন হলো সন্ত্রাসী বিরোধী আইন। ২০০৯ সালে প্রণীত হয় এই আইনটি। তবে তারও আগে ২০০৮ সালের জুন মাসে তখনকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার সন্ত্রাস বিরোধী অধ্যাদেশ জারি করেছিল। ওই আইনে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছিল, সেটি ছিল অনেক বিস্তৃত এবং এই বিস্তৃত পরিধির মধ্যেই আইনটির অপব্যবহার হতো। বিশেষ করে বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, শিক্ষক, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে আইনটি ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল। ২০১৩ সালে আইনটি সংশোধন করে আরো কঠোর করা হয়েছিল। জামিনের বিধান বাতিল করা হয়েছিল। পুলিশের হাতে দেয়া হয়েছিল বিস্তর ক্ষমতা। ১৯২৩ সালের দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইনটিকে কালো আইন বলা যেতে পারে। কারণ এটি মানুষের তথ্য প্রাপ্তি ও বাকস্বাধীনতার জন্য হুমকিস্বরূপ। এছাড়া দুটো দায়মুক্তি অধ্যাদেশ বা আইনও বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় কালো আইন হিসেবে বিবেচিত হয়। একটি হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের বিচার না করার জন্য দায়মুক্তি অধ্যাদেশ। ১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে এই অধ্যাদেশটি জারি হয়েছিল। পরে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এর বৈধতা দেয়া হয়েছিল। আরেকটি ছিল অপারেশন ক্লিন হার্টের জন্য দায়মুক্তি অধ্যাদেশ। যার নাম ছিল ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি অধ্যাদেশ ২০০৩'।
বাংলাদেশের সবগুলো কালো আইনের চারটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য থাকে। প্রথমটি হলো অপরাধের ব্যাখ্যার অস্পষ্টতা। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন থেকে শুরু করে হাল আমলের সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ পর্যন্ত সবগুলো আইনে অপরাধের যে সংজ্ঞা ও ব্যাপ্তি দেয়া হয়েছে, তা শুধু অস্পষ্টই নয়, বহুমাত্রিকও। যেমন – ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করা – এমন অপরাধগুলোর যে বর্ণনা আইনে দেয়া আছে তাতে যে কারো বিরুদ্ধে মামলা করা যায়। ফলে সরকার ও আইনশৃংখলা বাহিনী আইনকে নানাভাবে ব্যবহার করেছে। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যটি হলো পুলিশের মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা। জননিরাপত্তা আইন থেকে শুরু করে সাইবার সিকিউরিটি আইনে পুলিশকে অতিরিক্ত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। বিনা বিচারে আটক থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় বাহিনী দিয়ে মানবাধিকার লংঘনের সবরকম ব্যবস্থা এই আইনগুলোতে আছে। তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হলো – জামিন না দেয়ার ব্যবস্থা। কালো আইনগুলোতে প্রচুর অজামিনযোগ্য ধারা থাকে। মূলত এই অজামিনযোগ্য বিধানগুলো ভিন্নমত দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের বেশিরভাগ ধারা ছিল অজামিনযোগ্য। এ মামলায় বারবার জামিন চেয়েও মুশতাক জামিন পাননি, শেষ পর্যন্ত কারান্তরীণ থেকেই তিনি মারা যান। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের কালো আইনগুলোতে আরো একটি বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। সেটি হলো – তৃতীয় পক্ষের মামলা দায়েরের অনুমতি। ভাবমূর্তি সংক্রান্ত মামলাগুলো বোধ হয় বাংলাদেশে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রায় দুইশ বছর ধরে বিশ্বজুড়ে ভাবমূর্তি সংক্রান্ত অপরাধগুলো ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয় না। বাংলাদেশে আবার যার ভাবমূর্তি তার কোনো খোঁজ থাকে না তার হয়ে অন্য আরেকজন ভাবমূর্তি রক্ষার আইনি লড়াইয়ে হাজির হয়। আইসিটি আইন থেকে শুরু করে পরবর্তীতে ডিজিটাল বা সাইবার অপরাধসংক্রান্ত আইনগুলোতে এ বিধান
রাখায় আইনগুলো স্বাধীন সাংবাদিকতাবিরোধী হাতিয়ার হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। মানবাধিকারের কথা যদি বলা হয়, তাহলে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি থাকে কীভাবে? রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি যদি আইনের ভাষায় পরিমাপের বিষয় হয়, তাহলে মানুষ কীভাবে রাষ্ট্রের সমালোচনা করবে? সরকারগুলোর যখন শক্তি ও বলপ্রয়োগ নির্ভর হতে হয় তখন তাদের ভয়ের সংস্কৃতির প্রয়োজন হয়। ভয়ের চাষের মাধ্যমে সেন্সরশিপ ফ্রাঞ্চাইজ করা হয়। পরিণামে আইনের শাসনকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়। ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে একটি অভ্যাস দাঁড়িয়ে যায় – তারা কিছু লেখা বা বলা কিংবা করার আগে শতবার ভাবে। ভাবে আইনি হয়রানির কথা। মানুষের আইনি স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়ায় আইনগুলো রাজনৈতিক ও ভিন্নমত দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ধীরে ধীরে আইনের প্রতি, আইনের শাসনের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যায়। কিন্তু বাকস্বাধীনতা যত খর্ব হয়, বিচারবহির্ভূত শাস্তির প্রকটতা যত বাড়ে, ততই সমাজে অস্থিরতা বাড়ে। সমাজ তখন দয়ামায়াহীন সমাজে পরিণত হয়। সেজন্য কোনো অপরাধী বা অভিযুক্তকে দণ্ড দেয়ার আগে বিচারের প্রণালী ঠিক আছে কীনা তা দেখতে হয়। সে দায়িত্ব রাষ্ট্রের । অপরাধের শাস্তি দেয়ার একটা দারুণ অনিবার্যতা আছে। কিন্তু সেই শাস্তিটাকে ন্যায়বিচার প্রণালীর ফিল্টারের মধ্য দিয়ে পক্ষপাত-পরিশূন্য না হলে সমাজের তা গৃহীত হয় না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ছোটো ও বড়ো' প্রবন্ধে এমন পরিস্থিতির পরিণাম সম্পর্কে লিখেছেন, ‘তাহা না হইলেই লাঠিয়ালের লাঠি এবং শাসনকর্তার ন্যায়দণ্ডের মধ্যে প্রভেদ বিলুপ্ত হইতে থাকে।' কালো আইনের ব্যবহার শাসককে শাসিতের কাছ থেকে বহু দূরে নিয়ে যায়। সেখানে সরকার ও সরকারের আইনপ্রয়োগ ব্যবস্থা নিয়ে পপুলিজম থাকলেও সেটি নিতান্ত লোক দেখানো ছাড়া ভিন্ন কিছু নয়। বরং শাসয়িতা ও শাসিত পরস্পরবিচ্ছিন্ন থাকলে অনিবার্য হলো জীবনহীন শুষ্ক শাসনপ্রণালীর আবির্ভাব ঘটা।