কলকাতায় ১৮৭২ সালে মঞ্চস্থ হয়েছিল নীলদর্পণ। রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছিল নীল চাষীদের উপর অত্যাচার ও তাদের কষ্টের কাহিনি নিয়ে লেখা এই নাটক। শ্বেতাঙ্গ শাসকরা এই সত্যকথন ও সমালোচনা হজম করতে পারলো না। ১৮৭৬ সালে তারা নিয়ে এলো ড্রামাটিক পারফরমেন্স আইন। এই আইনে প্রচুর বিধিনিষেধ চাপানো হলো।
দেশ স্বাধীন হলো। কিন্তু অনেক আইন একই থেকে গেল। ১৯৮১ সালে দিল্লিতে পুলিশ জানালো, কোনো নাটক করার আগে তাদের কাছে স্ক্রিপ্ট জমা দিতে হবে। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের তালিকা জমা দিতে হবে। এর প্রতিবাদে মিছিল করলেন দিল্লির নাট্যকর্মীরা। সেই মিছিলে অংশ নেয়া পরিচালক ও অভিনেতা সিদ্ধার্থ দাশগুপ্ত জানাচ্ছেন, ''সফদর হাসমি ছিলেন, এই প্রতিবাদের অন্যতম উদ্যোক্তা। আমরা প্রচুর নাট্যকর্মী ‘শিল্পীর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা যাবে না'- এই স্লোগান তুলে বিক্ষোভ দেখালাম। তারপর দিল্লির লেফটেন্যান্ট জেনারেল(এলজি) মৌকিকভাবে জানালেন, পুলিশ আর স্ক্রিপ্ট জমা দিতে বলবে না। কারা অভিনয় করছেন, নাম আগে থেকে জানাতে হবে না। তারপর আর অসুবিধা হয়নি।''
সে না হয় দিল্লিতে হয়নি। কিন্তু অন্যত্র? ২০১৬ সালে অভিনেতা অমল পালেকর মুম্বই হাইকোর্টে একটা মামলা করলেন ১৯৫১ সালের মুম্বই পুলিশ আইন নিয়ে। সেখানেও বিষয়টা একই ছিল। কারণ, ওই আইনে বলা হয়েছিল, নাটকের আগে পুলিশের কাছে স্ক্রিপ্ট অনুমোদন করাটা বাধ্যতামূলক। অমল পালেকরের বক্তব্য ছিল, এটা শিল্পীর, নাগরিকের অধিকারের বিরোধী। এরপর রাজ্য সরকার হাইকোর্টে জানায়, পুলিশ কমিশনার আগেই আইনের ওই ধারা বাদ দিয়ে দিয়েছেন। কোনো স্ক্রিপ্ট অনুমোদন করাতে হবে না। তখন আরেক নাট্যব্যক্তিত্ব অ্যালেক পদমসি বলেছিলেন, তিনি এই ঘটনায় অবাক হননি। আমলাতন্ত্র এভাবেই চলে।
১৯৭৫ সালে ভারতে জারি হলো জরুরি অবস্থা। শিল্পী, সাহিত্যিক, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, অধিকার কিছুই থাকলো না। পশ্চিমবঙ্গে দুই বিশিষ্ট সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষ ও বরুণ সেনগুপ্তকে জেলে ভরা হলো। দেশজুড়ে বিরোধী রাজনীতিকরদের বন্দি করা হলো। সংবাদপত্রে সেন্সরশিপ চালু হলো। সরকারের অনুমোদন ছাড়া খবর ছাপা যেতো না। যতদিন জরুরি অবস্থা ছিল, ততদিন মতপ্রকাশের অধিকারই ছিল না, শিল্পীর স্বাধীনতা কোথায় থাকবে?
এম এফ হুসেনকে নিয়ে বিতর্ক
মকবুল ফিদা হুসেনকে ‘ভারতের পাবলো পিকাসো' বলেছিল ফোর্বস ম্যাগাজিন। কিন্তু সেই হুসেনকে বারবার বিতর্কের মধ্যে পড়তে হয়েছে। দেবী দুর্গা ও সরস্বতীর নগ্ন ছবি আঁকার ফলে কিছু হিন্দু গোষ্ঠী হুসেনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করে। তখন তার ছবির প্রদর্শনীতে হামলাও হয়েছে৷
‘মাদার ইন্ডিয়া' ছবি নিয়েও বিতর্ক তুঙ্গে ওঠে। সেখানেও মূল আপত্তি ছিল নগ্নতা নিয়ে। হুসেনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ২০০৬ সাল থেকে তিনি লন্ডনে স্বেচ্ছা নির্বাসনে ছিলেন। আর ভারতে ফেরেননি। সেখানে তার মৃত্যু হয়।
তার আগেই হাইকোর্টে তার বিরুদ্ধে চলা মামলা খারিজ করে দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছিল, ''এরকম কত ছবি আছে, বই আছে, আপনারা কি সবার বিরুদ্ধে মামলা করবেন? মন্দিরের ভাস্কর্য নিয়ে কী করবেন? হুসেনের ছবি হলো শিল্প। যদি আপনার দেখতে ইচ্ছে না করে তো দেখবেন না। কত মন্দিরেও তো এই ধরনের শৈল্পিক ধারা অনুসরণ করা হয়।''
কাস্টমস বিভাগ অশ্লীলতার দায়ে এফএন সুজা ও আকবর পদমসির শিল্পকর্ম বাজেয়াপ্ত করেছিল। মুম্বই হাইকোর্ট তাদের ধাতানি দেয়।
ভারতে নিষিদ্ধ বই, নাটক
১৯৮৮ সালে ভারতে নিষিদ্ধ হয় সালমান রুশদির ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস'। তিন দশক ধরে নিষিদ্ধ থাকার পর ২০১৯ সালে দিল্লি হাইকোর্টে এই নিষেধাজ্ঞা নিয়ে মামলা হয়। গত ৫ নভেম্বর হাইকোর্টের বিচারপতিরা জানান, সরকার তাদের জানিয়েছে, এই নিষেধাজ্ঞার নির্দেশ তারা খুঁজে পাচ্ছেন না। তাই তা আদালতে জমা দিতে পারছেন না। তারপরই আদালত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাহলে আমরা এটাই মনে করছি, এই ধরনের কোনো নির্দেশই নেই। এরপর আবেদনকারী সন্দীপ খাঁর আইনজীবী উদ্যম মুখোপাধ্যায় জানান, ৫ নভেম্বর থেকে আর কোনো নিষেধাজ্ঞা থাকছে না, কারণ, কোনো বিজ্ঞপ্তিই নেই।
মারাঠি নাটক মি নাথুরাম গডসে বোলতোয়েও মহারাষ্ট্র ও কেরালা সরকার নিষিদ্ধ করে। মহত্মা গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসেকে নিয়ে নাটক নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছিল কংগ্রেস ও শরদ পাওয়ারের এনসিপি। ২১৯৯৭ থেকে ২০০১ পর্যন্ত নাটকটির অনেকগুলি শো হয়েছিল। সরকার নিষিদ্ধ করার পর হাইকোর্ট সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে দেয়, সুপ্রিম কোর্টেও সেই সিদ্ধান্ত বহাল থাকে। ২০১১ থেকে আবার নাটকটির শো চলছে।
পশ্চিমবঙ্গে বাম আমলে তসলিমা নাসরিনের ‘দ্বিখণ্ডিত' নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সেসসময় পশ্চিমবঙ্গে তসলিমার ঠাঁই হয়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পর ‘লজ্জা' নাটকের মঞ্চায়ন বন্ধ করে দেয় পুলিশ। হিন্দুস্তান টাইমসের রিপোর্ট বলছে, ফেসবুকের দেওয়ালে তসলিমা নাসরিন লেখেন,''মমতা ব্যানার্জি আজ আমার লজ্জা নাটকটি পশ্চিমবঙ্গে নিষিদ্ধ করলেন। গোবরডাঙ্গায় আর হুগলির পাণ্ডুয়ার নাট্যউৎসবে লজ্জা নাটকটি মঞ্চস্থ হওয়ার কথা ছিল। দু'মাস যাবৎ বিজ্ঞাপন যাচ্ছে নাট্যউৎসবের। আর আজ, বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ মমতা ব্যানার্জির পুলিশ এসে জানিয়ে দিলো, সব নাটক মঞ্চস্থ হবে, শুধু লজ্জা ছাড়া। নবপল্লী নাট্যসংস্থা দিল্লিতে তিনবার নাটকটি মঞ্চস্থ করেছে। তিনবারই প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ ছিল।'' রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, ''তসলিমার প্রশ্ন, যারা দাঙ্গা বাঁধাতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে, শিল্প সাহিত্যকে নিষিদ্ধ করা হয় কেন? শিল্পী সাহিত্যিকের কন্ঠরোধ করা হয় কেন? এই প্রশ্নটি আর কত যুগ একা একা আমিই করে যাব? আর কারও দায়িত্ব নেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করার?''
পত্মাবতী সিনেমা নিয়েও কম হাঙ্গামা হয়নি। রাজপুতদের ভাবাবেগে আঘাত লেগেছে এই অভিযোগ করে ছবির সেটে হামলা হয়। সঞ্জয় লীলা ভনশালী নিগৃহীত হন। পরে ছয়টি রাজ্য়ে সিনেমাটি নিষিদ্ধ হয়। এরকমভাবেই কখনো নাটক, কখনো সিনেমা, কখনো বই নিষিদ্ধ হয়েছে ভারতে।
শিল্পীর স্বাধীনতা এবং....
শুধু শিল্পী কেন, সকলেরই চিন্তার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আছে। আর এখন এই আমরা-ওরার সময়ে সেই স্বাধীনতা বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে। কারণ, আমার মতে না মিললেই তো ভাবাবেগে আঘাত লেগে যাচ্ছে। কখনো তার মধ্যে রাজনীতি ঢুকছে, কখনো ধর্ম ঢুকছে, কখনো জাতি, কখনো সম্প্রদায়, কখনো বা অন্য কিছু। দুই বন্ধুর তর্কাতর্কিতেও তো মানসিকভাবে আঘাত লাগে। তাহলে তো তর্ক করাই যাবে না।
এই যে নিষিদ্ধ করার সংস্কৃতি এটা খুবই বিপজ্জনক। এর সীমারেখা থাকে না। কোন বিষয় কার খারাপ লাগে, কেন খারাপ লাগে, তার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ থাকে না। তাকে আবেগ। আর যেহেতু একটা কথা সংবিধানে আছে, অধিকার থাকলে, একটা দায়িত্বও থাকে, ফলে সেই যুক্তিকে হাতিয়ার করে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠতে থাকে। আর এই দাবির পরিধি বাড়তে থাকে। কোনো সন্দেহ নেই, ইচ্ছে করে কারো মনোভাবে আঘাত করা উচিত নয়। আবার পাশাপাশি এটাও সত্যি কোনো ছুতোয় নাতায় এই আঘাতের প্রশ্ন তুলে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলাও অন্য়ায্য। পাঁচটা মানুষ থাকলে, তাদের পাঁচটা মত থাকতে পারে। থাকবে। তাতে কী অসুবিধা হয়েছে।
একসময় সক্রেটিসকে হেমলক পান করে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল। কারণ, তিনি প্রশ্ন করতেন। বের করে আনার চেষ্টা করতেন সত্যকে। আর যিনি প্রশ্ন করেন, তাকে সর্বকালে শাসক থেকে সমাজপতি সকলে ভয় পায়। তাই প্রশ্ন করো না, নিজের মত জানিও না। শুধু বেনোজলে গা ভাসিয়ে দাও। অতিবাম, মধ্যপন্থি, অতি ডান, উদার থেকে কট্টরপন্থি কেউই অন্যের মতামতপ্রকাশের স্বাধীনতায় পুরো বিশ্বাস করে না। যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের স্বার্থে আঘাত না আসছে, ততক্ষণ তারা বলতে থাকেন, এখন সবই শান্ত, সবই ভালো। আর অন্যমত হলেই তখনই আঘাত লাগে মনোভাবে, তখন দায়িত্বের কথা মনে পড়ে যায়। তখন আর শিল্পীর স্বাধীনতা থাকে না।