শিল্পী-সাহিত্যিকের স্বাধীনতা : বাংলাদেশে যেমন...
৩১ জানুয়ারি ২০২৫২০২৪ সালের ২ নভেম্বর চট্টগ্রাম নগরে ‘খুকি লাইফস্টাইল' নামের একটি শোরুম উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন অভিনেত্রী মেহজাবীন চৌধুরী। ‘রিয়াজউদ্দিন বাজারের সর্বস্তরের ব্যবসায়ী ও তৌহিদি জনতা' ব্যানারে কিছু লোকের বাধার মুখে উদ্বোধন না করেই ঢাকায় ফিরতে বাধ্য হন মেহজাবীন। পরে এক ফেসবুক পোস্টে তিনি ‘রিয়াজউদ্দিন বাজারের সর্বস্তরের ব্যবসায়ী ও তৌহিদি জনতা'-র বাধার বিষয়টি উল্লেখ না করে লিখেছেন ‘‘একটি শোরুম উদ্বোধনের জন্য চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম। কিন্তু বিমানবন্দর থেকে শোরুমে যাওয়ার পথে শুনি নিরাপত্তা সংক্রান্ত কিছু সমস্যা হয়েছে। তাই আয়োজক ও আমি নিরাপত্তার অভাবে শোরুমে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা তখনই গাড়ি ঘুরিয়ে বিমানবন্দরে ফিরে যাই ও ঢাকায় ফেরার সিদ্ধান্ত নিই।''
গত ২৫ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ডের টিন মার্কেটে প্রসাধন পণ্য বিক্রির একটি শোরুম উদ্বোধনের কথা ছিল পরীমণির। কিন্তু জাতীয় ওলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদ ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের টাঙ্গাইল এবং কালিহাতী শাখার আপত্তির মুখে তারও শোরুম উদ্বোধন করা হয়নি৷ পরীমনিকে না আনতে দোকান সংশ্লিষ্টদের ফোন করে হুমকি দেয়ার অভিযোগও উঠেছে৷ ফলে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার শঙ্কায় অনুষ্ঠান বাতিল করেন সংশ্লিষ্টরা। ঢালিউডের আলোচিত এই নায়িকা অবশ্য নীরব থাকেননি৷ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, ‘‘এত চুপ করে থাকা যায় নাকি! পরাধীন মনে হচ্ছে। শিল্পীদের এত বাধা কেন আসবে? অনিরাপদ লাগছে! এমন স্বাধীন দেশে নিরাপদ নই কেন আমরা! ধর্মের দোহাই দিয়ে কী প্রমাণ করতে চলেছেন তারা? কী বলার আছে আর… এ দেশে সিনেমা/বিনোদন সব বন্ধ করে দেওয়া হোক তাহলে! এই দায়ভার কিন্তু আমাদের সবার নিতে হবে।''
সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভ উগড়ে দেওয়ার একদিন পরেই এক ব্যবসায়ীকে মারধর, খুনের চেষ্টা ও হুমকির পুরনো মামলায় পরীমণির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। দুটি ঘটনার যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন অনেকেই। নির্মাতা আশফাক নিপুন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‘মবের প্রতিবাদের মুখে পরীমণির দোকান উদ্বোধন করতে না পারার ক্ষোভ উদগীরণের পরপরই তার বিরুদ্ধে দায়ের করা পুরনো মামলায় হাজিরা দিতে না যাওয়ায় গ্রেপ্তারের আদেশ জারি বড়ই কাকতালীয়, সরকার। আবার সাজাপ্রাপ্ত দাগী আসামি সকলের জামিনে বের হয়ে ত্রাস সৃষ্টি করা মোটেও কাকতালীয় না। ঠিক যেমন আদিবাসীদের ওপর সভারেন্টি গ্রুপের হামলাও কাকতালীয় না, আবার নারী অভিনেতাদের তথাকথিত ‘মব'-এর প্রতিবাদের মুখে শোরুম উদ্বোধন করতে না পারাও এখন আর কাকতালীয় না। কাকতালীয় বা অকাকতালীয় কোনো সরকারই হইয়েন না, জনাব সরকার; কাজের সরকার হন।”
বাংলাদেশে শিল্পী-লেখকদের অধিকার চর্চার পথে বাধা সৃষ্টির ঘটনা আগেও ঘটেছে৷ দাউদ হায়দার এবং তসলিমা নাসরিনের মতো লেখকদের তো বিদেশেই চলে যেতে হয়েছে৷
তবে অতি সাম্প্রতিক প্রবণতা একেবারে অন্যরকম৷ শিল্পীদের, বিশেষ করে নারী শিল্পীদের কোনো দোকান বা শোরুম উদ্বোধনে বাধা দেয়ার ঘটনা তিনটি ঘটেছে খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে৷
এসব ঘটনায় ফেসবুকে সরব হয়েছেন অনেকে। পরীমণির ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ভারতে নির্বাসিত বাংলাদেশি লেখক তসলিমা নাসরিন শঙ্কা প্রকাশ করেছেন এভাবে, ‘‘কোথাও আর কিছু উদ্বোধন করতে কোনো নারীকে ডাকতে ভয় পাবে উদ্যোক্তারা। কোনো নারীশিল্পীকে নাচ-গান ও যাত্রা-নাটকের জন্য ডাকবে না আয়োজকরা। ডাকলেও হামলার ভয়ে নারীশিল্পীরাও মঞ্চে উঠতে ভয় পাবে। প্রতিটি নারীর পায়ে পরানো হয়ে গেছে অদৃশ্য শিকল।”
অভিনেত্রী কাজী নওশাবা আহমেদ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘‘পরীমণি, মেহজাবীন, এরপর? আমরা চুপ! শিল্প-সংস্কৃতি একটি জাতির ধারক। এটাতে হাত দিলে ও যারা হাত দিতে সাহস দিচ্ছেন, তারা নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনছেন! সত্তাকে বিকিয়ে বেশিদূর এগোনো যায় না, ওয়েক আপ বাংলাদেশ!''
মেহজাবীন ও পরীমণি ঢাকার বাইরে তোপের মুখে পড়ার পর চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাস রাজধানীতেই বিরূপ পরিস্থিতি দেখেছেন। গত ২৮ জানুয়ারি ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে ‘সোনার থালা' নামের একটি রেস্তোরাঁ উদ্বোধন করার কথা ছিল তার। তবে ‘স্থানীয় জনতা'র প্রবল চাপের মুখে তিনি পিছু হটতে বাধ্য হন। অতিথি হিসেবে নায়িকাকে আনা হলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির হুমকি দেওয়া হয় রেস্তোরাঁ মালিককে। কামরাঙ্গীরচর থানা পর্যন্ত বিষয়টি গড়ালে আয়োজকরা অপু বিশ্বাসকে আনার সিদ্ধান্ত বাতিল করেন।
মেহজাবীন, পরীমণি ও অপু বিশ্বাসকে মৌলবাদীদের হুমকি-ধমকি দেওয়াকে সুস্পষ্ট মানবাধিকারের লঙ্ঘন মনে করেন অভিনেতা, নাট্যকার মামুনুর রশীদ। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘যারা মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে তাদের কোনো শাস্তির ব্যবস্থা আমাদের দেশে নেই। এর আগে আমরা দেখেছি বাউলদের চুল কেটে দিয়েছে। শিল্পীরা একটা দোকান উদ্বোধন করবে, সেটাও পারছে না। এই যে গায়ের জোরে সবকিছু করা, এটা তো সুস্থ সমাজের লক্ষণ নয়। আমরা দেখেছি, মাজার ভাঙা হচ্ছে, এটাও তো ঘোরতর অন্যায়। মাজার ভাঙবে কেন? বাউলদের আখড়াও ভেঙে ফেলা হয়। কিছু মানুষ তাদের বিশ্বাস ও ভক্তি নিয়ে এসব জায়গায় যায়, তাদের সেই অধিকারটুকু ক্ষুণ্ন করার অধিকার কিন্তু কারো নেই। এটা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। কিন্তু এখন এই লঙ্ঘনগুলো অহরহ হচ্ছে।''
মানবাধিকার সংগঠন আমরাই পারি জোটের প্রধান নির্বাহী জিনাত আরা হক ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘দেশের প্রত্যেক মানুষেরই মানবাধিকার আছে। শিল্পীর অধিকার বাদ দিয়ে মানবাধিকার নয়। তাই শিল্পীর অধিকার নিশ্চিত করা দরকার। আমাদের সংবিধান বলে– কোনো পেশা, লিঙ্গ ও বর্ণের কারণে আপনি কারো সঙ্গে কোনোরকম বৈষম্য করতে পারবেন না। ক্ষতিকর কোনো কাজ করতে পারবেন না। এটা কেউই সাংবিধানিকভাবে করতে পারে না। আর আইনত তো করতেই পারে না। যেভাবে তাদের অপদস্থ করা হয়েছে, এটা করার আইনগত অধিকার কারো নেই।''
শিল্পীদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হওয়ার ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে বেশি ঘটার বিষয়ে মামুনুর রশীদ ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘মূল সমস্যা হলো, আমরা গণতন্ত্রহীন সমাজে আছি। গণতন্ত্রহীনতার অনেক সংকট আছে। যেমন, আইন-শৃঙ্খলা, বিচার বিভাগ কোনো স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে না। এ কারণে বিভিন্ন ধরনের অপশক্তির জন্ম হয়। এরমধ্যে একটা অপশক্তি কিছুতেই শিল্প-সাহিত্য ও শিল্পীদের সম্মান করতে শেখেনি। সেই গোষ্ঠী মাঝে মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।''
জিনাত আরা হক ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘শিল্প-সংস্কৃতি হচ্ছে একটি দেশের পরিচয়। দেশ তো একটা বায়বীয় শব্দ, সাংস্কৃতিক উপকরণগুলো দেশকে উপস্থাপন করে। দেশ কীভাবে দেখাতে চাই সেটা বদলাতে চাইলে শিল্প-সংস্কৃতির ওপর আঘাত করা হয়। যুগ যুগ ধরে নাটক, সিনেমা, সংগীত এমনকি মাজার আমাদের সংস্কৃতির অংশ। এগুলো এখন নেতিবাচকভাবে সামনে আনার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। এগুলো করা গুনাহের কাজ, এগুলো ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক–এসব বলছে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠী। আমাদের সংস্কৃতি কিন্তু এমন না। সংস্কৃতির একটি অংশ কিন্তু ধর্ম। আমাদের সাংস্কৃতিক আবহ পরিবর্তনের অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে। তারকা শিল্পীদের দিয়ে দোকান উদ্বোধনের সংস্কৃতি অধিকাংশ দেশেই আছে। কিন্তু যেহেতু তারা নারী, তাই মনে করা হচ্ছে এসব কাজে তাদের অংশগ্রহণ ধর্মের প্রতি হানিকর। এ কারণে অভিনেত্রীদের প্রতি নেতিবাচক আচরণ প্রকাশ করা হচ্ছে।শুধু ব্যক্তি পরীমণি, ব্যক্তি মেহজাবীন ও ব্যক্তি অপু বিশ্বাসের প্রতি আক্রোশ নয়, আমাদের পুরো সংস্কৃতির ওপর তারা আঘাত হানছে।''
জিনাত আরা হকের মতে, ‘‘যদি আমরা এখনই শক্তভাবে ও সম্মিলিত প্রতিবাদ না করি, তাহলে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলার শঙ্কা থাকবে। একদিনে সংস্কৃতি পরিবর্তন হয় না। সংস্কৃতি চর্চায় কেউ আঘাত হানলে সমাজ, সংস্কৃতি শূন্য হয়ে যাবে। তখন মারামারি-হানাহানি আরো বাড়বে। মানুষ যখন নাটক কিংবা সিনেমা দেখে, গান শোনে, খেলাধুলা করে, তখন কিন্তু খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকে৷ যখন এসব বন্ধ করে দেবেন, তখন কিন্তু মানুষের সহিংস হওয়ার শঙ্কা বেড়ে যায়।'
অভিনেতা-গায়ক ফজলুর রহমান বাবু মনে করেন, দেশে এক ধরনের ধর্মীয় উগ্রবাদ তৈরি হয়েছে। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘কেউ কেউ মনে করে ধর্মে গান-বাজনা নিষিদ্ধ, শরীয়তে নিষিদ্ধ। আবার কয়েকটি ধর্মে গান হলো আচার-অনুষ্ঠানের অংশ। যারা উগ্র বা ধর্মীয় মতবাদে বিশ্বাসী, তারা মনে করে গান-বাজনা হারাম। একই দেশে একজন এটি হালাল আবার অন্যজন হারাম মনে করতেই পারেন। প্রত্যেকেরই তার ধর্মের স্বাধীনতা থাকতে হবে। অন্যের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা অত্যন্ত দুঃখজনক ও গর্হিত কাজ বলে আমি মনে করি। যদি কারো বিচারের প্রয়োজন হয়, তাহলে আদালত দেখবে। বিচার করার দায়িত্ব সাধারণ মানুষকে কেউ দেয়নি। অন্যের বিচার করার কোনো অধিকার নেই কারো। সেজন্য রাষ্ট্রব্যবস্থা আছে। প্রকৃত অর্থে ধার্মিক ব্যক্তি মনে করে সৃষ্টিকর্তাই বিচার করবে।''
ফজলুর রহমান বাবু ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘শিল্পী, ব্যবসায়ীসহ যে-কোনো পেশার মানুষের নীতি থাকা গুরুত্বপূর্ণ। সেই নীতির ভেতরে থেকে কাজ করতে গিয়ে কেউ যদি লাঞ্ছনা-বঞ্চনা ও দমন-পীড়নের শিকার হয়, কিংবা ধর্মীয় কারণে এক ধরনের সহিংসতার শিকার হয়, সেসব সত্যিই দুঃখজনক। ধর্ম আসলে ধারণ করার বিষয়। এটা জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় না। ধর্ম হলো লালন করে বুকে ধারণ করার বিষয়। আর সৃষ্টিকর্তা তো প্রেমের কথা বলেছেন। তিনি ধ্বংসের কথা বলেননি। হানাহানি বা যুদ্ধের কথাও বলেননি। সৃষ্টিকর্তা ভালোবাসা, প্রেম ও শান্তির কথা বলেছেন। সংস্কৃতি মানে কিন্তু শুধু গান-বাজনা নয়। আমাদের জীবনযাপন, আচার-অনুষ্ঠান, সভ্যতা সবকিছু মিলিয়েই সংস্কৃতি।'
নাট্যকার মাসুম রেজা বলেন, ‘‘পরীমণি ও মেহজাবীন শোরুম উদ্বোধন করতে যাচ্ছিলেন, বৈষম্যের দিক থেকে যদি বিচার করি, তারা কি কাউকে বঞ্চিত করছিলেন? তা তো না। একইভাবে মেয়েদের ফুটবল খেলা কি অন্যদের খেলা বন্ধ রেখে করা হচ্ছিল? তা তো না। আমাদের দেশনাটকের ‘নিত্যপুরাণ' যে তৌহিদি জনতার ব্যানারে কিছু লোকের কারণে মাঝপথে বন্ধ করা হয়েছিল, আমরা কি অন্যদের বঞ্চিত কিংবা বৈষম্য তৈরি করে নাটক করেছি? তাও তো না। তারপরও যারা এসব ঘটাচ্ছেন, তাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক চেতনা বলতে কিছু নেই।''
নওশাবা মনে করেন, নারী স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে ইদানীং। তিনি বলেন, ‘‘খেলাধুলা ও সংস্কৃতি আমাদের দেশকে বিশ্বদরবারে সম্মানের সঙ্গে তুলে ধরে। এগুলোকে আঘাত করার মানেই হলো উন্নতির পরিবর্তে দেশের ক্ষতি চাওয়া। যারা এমন সংকীর্ণ মনোভাব নিয়ে থাকেন, তারা দেশপ্রেমের নতুন সংজ্ঞা তৈরির পাঁয়তারা করছেন। তারা নিতান্তই বোকা। সচেতন নাগরিকরা ঠিকই শিল্প-সংস্কৃতিকে মননে ধারণ ও সম্মান করেন। আপনি একটি গাছকে পানি দিচ্ছেন, কিন্তু তাকে সূর্য থেকে দূরে একটি বদ্ধ ঘরে আটকে রাখবেন, তাহলে কিন্তু গোড়া পচে যাবে। একসময় গাছটা মরে যাবে। যদি আমরা শিল্প-সংস্কৃতি ও খেলাধুলায় ব্যাঘাত ঘটাই, নারী স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করি, তাহলে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তাই-ই হবে। এগুলো কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।''
তিন অভিনেত্রী যে বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়লেন, আগামীতে অন্যরা একই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলে করণীয় কী? অধিকারকর্মী জিনাত আরা হক ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘তারা আইনিভাবে ব্যবস্থা নিতে পারেন। নিরাপত্তাহানির কথা জানাতে তাদের থানায় যাওয়া উচিত। তারা আদালতে বিচার প্রত্যাশা করবেন। এসব পরিস্থিতির বিচার চাইলে আমাদের মতো সংগঠনগুলোর সহায়তা মিলবে।''
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি কিংবা ছোট পর্দার সংগঠন অভিনয়শিল্পী সংঘ এসব ঘটনায় কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। কিন্তু জিনাত আরা হক মনে করেন, সংগঠনের পক্ষ থেকে এসব ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ জানানো উচিত। তার অভিমত, ‘‘আমরা সবসময় তাদের অধিকারের পাশাপাশি থাকবো। আইনি সহায়তা চাওয়ার পাশাপাশি শিল্পীদের যেসব প্ল্যাটফর্ম আছে, তাদের খুবই সক্রিয়ভাবে প্রতিবাদ করতে হবে এবং তথ্য-সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে যে, কেন শিল্পীদের এ ধরনের হেনস্তার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তারা অবশ্যই সাংগঠনিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রের থেকে নিরাপত্তা চাইতে পারেন। এ কারণেই তো আমরা সংগঠন তৈরি করি, যাতে একই ধরনের লোক যেন তাদের দাবি নিয়ে কথা বলতে পারে।''
মামুনুর রশীদের মন্তব্য, ‘‘আমাদের সাংস্কৃতিক আন্দোলন দরকার। ষাটের দশকে রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি রাজনীতি ও সংস্কৃতি হাত ধরাধরি করে চলেছে। এই প্রক্রিয়া আমরা অনেকদিন ধরে দেখছি না। এটা সর্বশেষ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে আমরা করতে পেরেছি। কিন্তু নব্বইয়ের পরে কী যে হলো! একটা গণতন্ত্র এলো ঠিকই, তবে সেটি আমরা বুঝলামও না, ব্যবহার করতেও জানলাম না। তারই একটা চরম পরিণতি দেখা দিচ্ছে এখন।''
বাউল-সাধুদের ওপর গত কয়েক মাসে একের পর এক হামলার ঘটনায় সাংস্কৃতিক অঙ্গনে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। দেশজুড়ে বাউলরা অনিরাপদ বোধ করছেন। নরসিংদীর বেলাবোতে বাউলদের আখড়ায় ২০২৪ সালের ৭ মে গান-বাজনার সময় বেশ কয়েকজন দুষ্কৃতিকারী হামলা চালিয়ে বাদ্যযন্ত্র ভাঙচুর করে। ঠিক একমাস পর কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার পোড়াদহ ইউনিয়নের আহমদপুর গ্রামে বাউল নিশান আলীর আখড়া ভেঙে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। আখড়াটিতে সন্ধ্যার পর গানের আসর বসাতেন বাউল-সাধুরা। গত বছরের ২২ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার নরসিংহপুর গ্রামে তৌহিদি জনতার ব্যানারে হুমকি দেওয়ায় ‘সাধুসঙ্গ ও লালন মেলা' বন্ধ হয়ে যায়। মুক্তিধাম আশ্রম ও লালন একাডেমি প্রাঙ্গণে হওয়ার কথা ছিল দুই দিনের ১১তম মেলাটি। এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে পরদিন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ‘বৈচিত্র্যের ঐক্য' শীর্ষক সমাবেশে অর্থনীতিবিদ-শিক্ষক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘‘বাংলাদেশ বহুজাতি, বহুবর্ণ ও বহু বৈচিত্র্যের দেশ। বহু বৈচিত্র্য নিয়ে ঐক্য গড়ে উঠলেই সমাজ শক্তিশালী হয়। অন্যথায় বৈষম্য দানা বাঁধে। বৈষম্যের বিপক্ষে ও বৈচিত্র্যের পক্ষে দাঁড়াতে হবে আমাদের।''
গত বছরের ২৫ নভেম্বর যশোরের মণিরামপুর উপজেলার শ্যামকুড় ইউনিয়নের পাড়দিয়া গ্রামে দুর্বৃত্তদের হামলায় পণ্ড হয় ফকির মন্টু শাহের লালন স্মরণোৎসব। মন্টু শাহ তার নিজ বাড়িতে প্রতিবছর দুই দিনের এই সাধু সংঘে অংশ নেন খুলনা বিভাগের অনেক বাউল শিল্পী।
যশোর বাউলিয়া সংঘের সাধারণ সম্পাদক পরিতোষ বাউল বলেন, ‘‘বাউলরা মুক্তমনের মানুষ। তারা ধর্ম, জাত, রাজনীতি বোঝে না। বাঙালি সংস্কৃতির শিকড় উপড়ে ফেলার অপচেষ্টা থেকে বাউলদের অনুষ্ঠান বন্ধ করা হয়।''
রাজনৈতিক পালাবদলের পর গত ছয় মাসে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৮০টির বেশি মাজার শরিফ ও দরবার শরিফে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। বিশ্ব সূফী সংস্থা নামের একটি সংগঠন গত ২৩ জানুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবের আবদুস সালাম মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এই অভিযোগ জানায়।
চলমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে নানান সংকট দেখছেন মামুনুর রশীদ। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘মৌলবাদীরা একটা ফুল ফ্রন্টে চলে আসছে। সেখানে আমাদের একটা আশার আলো ছিল যে, গণতান্ত্রিক শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিহত করবে। কিন্তু তার তো কোনো লক্ষণ এখনো দেখতে পাচ্ছি না। এখন যা অবস্থা তাতে যেকোনো সমস্যা হতে কতক্ষণ? সাধারণ মানুষ যেমন-তেমন, গণমাধ্যমকর্মীদের ওপরও কী ধরনের নির্যাতন চলছে। এসব নিরসনে একটা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি চালু হোক। একটা নির্বাচন হোক। নির্বাচনের মাধ্যমে একটা দল ক্ষমতায় আসুক। তখন আবার একটা চেষ্টা করা যাবে। আমি বিশ্বাস করি, আমরা যে জায়গায় আছি সবাই সেই জায়গা থেকে প্রতিবাদ ও ভূমিকা রাখা উচিত। সেগুলো সঠিকভাবে পালন করতে পারলেই আমার মনে হয় উত্তরণ সম্ভব। সবশেষে এটাই বলতে চাই, গণতন্ত্রের ফেরাটা অত্যন্ত জরুরি।''
উত্তরণের উপায় খুব সহজ নয় মেনে ফজলুর রহমান বাবু বলেন, ‘‘আমাদের দরকার সঠিক শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চা। মানুষ যদি সংস্কৃতিবান ও প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত হয় তাহলে তার মধ্যে কোনও ধরনের উগ্রবাদ তৈরি হবে না। প্রকৃত শিক্ষিত হতে হবে। এমএ পাস করলাম আর শিক্ষিত হয়ে গেলাম বিষয়টি কিন্তু এমন নয়। যদি আমি প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ হই, তাহলেই সংস্কৃতিবান হবো। অন্যের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবো না। একটা শিক্ষিত জাতি আমাদের গড়ে তুলতে হবে। এটা একদিনের না, দীর্ঘদিনের কাজ। দ্বিতীয় কথা হলো, পারিবারিক শিক্ষা। এই যে বিভিন্নভাবে উগ্র ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে ও নানান মতবাদ তাদের মধ্যে একটা সঠিক বলছে তো আরেকটা সঠিক বলছে না এই যে বিভিন্ন ধরনের মতভেদ তৈরি হয়েছে, এগুলো থেকে আমাদের দূরে থাকতে হবে।''
মাসুম রেজা মনে করেন, এসব প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের দায়িত্ব শুরু থেকে সমস্তটাই সরকারের। তিনি বলেন, ‘‘বৈষম্যবিরোধী অঙ্গীকার আছে এই সরকারের, এটি ঘোষিত। যাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক চেতনা নেই, সরকারের দায়িত্ব তাদের খুঁজে বের করে শাস্তি দেওয়া। এটাই প্রধান কাজ। বৈষম্যহীন প্রতিশ্রুতি নিয়ে এই সরকার এসেছে, ফলে এসব ক্ষেত্রে ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব তাদের। সমাজে মেয়েদের স্বাধীনতা ও শিল্পের যথাযথ চর্চা হওয়া জরুরি।''
তৌহিদী জনতার ব্যানারে নারীদের বাধা দেওয়ার বিষয়ে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘আমরা এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি। এগুলো হলো সামাজিক প্রেক্ষাপট। কারণ, আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি, যারা নাটক-সিনেমা করে তাদের দিয়ে কিছু উদ্বোধন করানো ও তাদের কাজ-কর্ম ধর্মপ্রাণ মানুষ সুন্দর দৃষ্টিতে দেখে না। কারণ, নাটক-সিনেমা দেখেই মানুষের চরিত্র ধ্বংস হয়। নায়ক-নায়িকাদের ব্যাপার স্পর্শকাতর। আমরা কিন্তু কাউকে বাধা দিচ্ছি না। তবে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের দেশে নায়িকাদের প্রকাশ্যে এনে এসব কাজ করানো ঠিক না।''
একই সুরে আন্তর্জাতিক মজলিসে তাহাফফুজে খতমে নবুওয়ত বাংলাদেশের মহাসচিব মাওলানা মুহিউদ্দিন রব্বানী ডিডাব্লিউকে বলেন ,‘‘আমাদের দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুভূতি বিবেচনা করে নায়িকাদের এসব কর্মসূচি থেকে বিরত থাকা উচিত। মুসল্লিদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত আসে, এমন কিছু করা কোনোভাবেই ঠিক না।''
মাওলানা মুহিউদ্দিন রব্বানী সাভারের জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। একজন অভিনেত্রী দোকান উদ্বোধন করতে গেলে কি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত চলে আসে? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কেউ কি অন্যের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারে? এসব প্রশ্নের জবাবে তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা এটা পছন্দ করে না। তাদের অনুভূতিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এসব কাজ দেখলে তাদের মূল্যবোধের ওপর আঘাত আসে। জনগণের ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর আঘাত আসে এমন কোনও কর্মসূচি না দেওয়াই ভালো। তৌহিদী জনতার ব্যানারে যারা বাধা দিচ্ছেন তাদের বলতে চাই, আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। মানুষকে বুঝিয়ে ও সমঝোতার মাধ্যমে ইসলামিক ও শরীয়তের বিষয় অভ্যস্ত করতে হবে।''
তবে অভিনেত্রী কাজী নওশাবা আহমেদ ডিডাব্লিউকে বলেন, ‘‘যে ভরসা, ভালোবাসা ও বিশ্বাস নিয়ে গণঅভ্যুথান হলো, তাতে বাধা শব্দ তো আমরা প্রত্যাশা করিনি। বাংলাদেশে কোনও জায়গায় আমরা যেন বাধাপ্রাপ্ত না হই। কারও ভিন্নমত শুনলেই, কারও মধ্যে ভিন্নতা দেখলেই তাকে বাধার সম্মুখীন হতে হবে, এটা কাঙ্ক্ষিত নয় মোটেই। সেটা নিশ্চয়ই আমরা কখনও মেনে নিতেও পারবো না।''
নওশাবার বিশ্বাস, ‘‘বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ সংস্কৃতিমনা। কারণ আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি অনুযায়ী বাড়িতে হারমোনিয়াম থাকবে, মেয়েরা বাইরে গিয়ে খেলবে, মেয়েরা মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকবে, শিল্প-সংস্কৃতি চর্চা, নাটক, মঞ্চ সবই হবে। যেটাতে বাধা বেশি আসবে সেগুলো বেশি বেশি করতে হবে। মেয়েদের খেলা বেশি বেশি আয়োজন করতে হবে। বেশি করে সিনেমা নির্মাণ, থিয়েটার ও উৎসবের আয়োজন করতে হবে। এক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদের শিল্পী সমাজের কিছু দায়িত্ব রয়েছে। আমরা যেন নিজেদের স্বাধীনতার চর্চা পরিমিতিবোধের সঙ্গে ও একটু ভেবেচিন্তে করি।''