যোগ্য শিক্ষকদের তালিকা স্কুলে, চলছে অবস্থানও
২৪ এপ্রিল ২০২৫যোগ্য ও অযোগ্যদের পৃথক তালিকা প্রকাশ করতে হবে, এই দাবিতে আন্দোলন করছেন চাকরিহারা শিক্ষকরা। তালিকা সামনে চলে এলেও ওএমআর শিট প্রকাশের দাবি থেকে তারা সরছেন না।
শিক্ষকরা পথে
সুপ্রিম কোর্ট ২০১৬ সালের এসএসসি প্যানেল বাতিল করে দিয়েছে। সিবিআই তদন্তের ভিত্তিতে দাগি শিক্ষকদের চিহ্নিত করা হয়েছে। কারা দাগি ও দাগি নন, সেই তালিকা প্রকাশের দাবিতে গত সোমবার থেকে এসএসসি দপ্তর আচার্য সদনের সামনে টানা অবস্থান চালিয়ে যাচ্ছেন চাকরিহারারা।
সরকার এই দাবিতে মান্যতা না দিলেও দাগি হিসেবে চিহ্নিত নন, এমন শিক্ষকদের তালিকা বিভিন্ন জেলার স্কুল পরিদর্শকের কাছে পাঠিয়েছে শিক্ষা দপ্তর। পরিদর্শকের দপ্তর থেকে স্কুলে স্কুলে প্রধান শিক্ষকদের কাছে তালিকা পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। তালিকায় যাদের নাম নেই, তারা দাগি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন বলে ধরে নিচ্ছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ।
যারা দাগি হিসেবে চিহ্নিত নন, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী তারা আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্কুলে পড়াতে পারবেন। আগামী কয়েক মাস তারা বেতন পাবেন। তালিকায় যাদের নাম নেই, তারা স্কুলে পড়াতে পারবেন না। বেতন পাওয়ার প্রশ্ন নেই। চলতি এপ্রিল মাসের বেতন দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। সে কারণে বিভিন্ন স্কুলের যোগ্য তালিকাভুক্ত শিক্ষকদের ফর্ম পূরণ করে জমা দিতে বলা হয়েছে।
প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিল হয়ে গিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে। শিক্ষাকর্মীদের কারো আর স্কুলে ফেরা বা বেতন পাওয়ার প্রশ্ন নেই। রাজ্য সরকার যে রিভিউ পিটিশন দাখিল করতে চলেছে, তার ভিত্তিতে যদি নতুন কোনো নির্দেশ শীর্ষ আদালত না দেয়, তা হলে এই পরিস্থিতি বদলাবে না। যোগ্য শিক্ষকের সংখ্যা ১৭ হাজারের কিছু বেশি। অযোগ্য বা দাগি হিসেবে চিহ্নিত শিক্ষক ছয় হাজারের আশেপাশে।
২০১৬ সালের প্যানেলের ভিত্তিতে শিক্ষকরা প্রথম যেখানে নিয়োগ পেয়েছিলেন, সেখানে যোগ্যদের নাম পাঠানো হয়েছে। কোনো শিক্ষক বদলি হয়ে অন্য জেলায় চলে গেলেও প্রথম যে জেলায় চাকরি পেয়েছিলেন, সেখানকার তালিকায় নাম থাকছে।
ইতিমধ্যেই তালিকায় না থাকা শিক্ষকরা আওয়াজ তুলতে শুরু করেছেন, তাদের অন্যায়ভাবে বাদ দেয়া হয়েছে। এদের অন্যতম চলতি শিক্ষক আন্দোলনের নেতা চিন্ময় মণ্ডল। তিনি বলেন, "দুর্ভাগ্যবশত এটা আমার ক্ষেত্রে যেমন হয়েছে, অনেকের ক্ষেত্রেই হয়েছে। প্রথম জয়েনিংয়ের যে ডিআই, তার তালিকাতে আমার নাম নেই। পরে যেখানে যোগ দিয়েছি, সেই জেলার তালিকাতেও নাম বাদ পড়েছে।"
ডিআই অফিসে পাঠানো তালিকা জনসমক্ষে চলে এসেছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, কারা দাগি নন। তবু কেন তালিকা প্রকাশের দাবিতে অবস্থান চালাচ্ছেন শিক্ষকরা। নদিয়ার রানাঘাটে হাজরাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক দেবাশিস অধিকারী ডিডাব্লিউকে বলেন, "আমি ২০৪২ সাল পর্যন্ত চাকরি করব বলে পরীক্ষায় পাশ করেছি। এখন যদি আমাকে বলা হয়, ২০২৫ পর্যন্ত চাকরি করবেন, সেটা কি মেনে নেওয়া সম্ভব? যদি কোনো ত্রুটি হয়ে থাকে, সেটা কমিশন বা রাজ্য সরকারের বিষয়। তার জন্য আমরা দায়ী হব কেন?"
বাটানগর শ্রীরামকৃষ্ণ আশ্রম বিবেকানন্দ বিদ্যামন্দিরের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক অমিত ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন, "প্রথম কথা হচ্ছে যে, কোর্টের অর্ডারে কোথাও বলা নেই, স্কুলে আসবেন না। এই জায়গায় একটা বিভ্রান্তিকর বার্তা ছড়ানো হচ্ছে। আদতে পুরো বিষয়টার মধ্যে কী আছে, সেটা নিয়ে আমাদের অনেক সংশয় আছে।"
যারা ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পড়াতে পারবেন, তাদেরও ফের পরীক্ষায় বসতে হবে। সেই সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি মে মাসের মধ্যে কমিশনকে প্রকাশ করতে বলেছে সুপ্রিম কোর্ট। ফলে অনিশ্চয়তা থেকে যাচ্ছে হাজার হাজার শিক্ষকের মধ্যে।
কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশন (মেন)-এর প্রধান শিক্ষক সায়ন্তন দাস বলেন, "এটা বিরাট কষ্টকর ব্যাপার যে, আবার পরীক্ষায় বসতে হবে। এটা যদি আমাকে বলা হতো, মন ভেঙে যেতো। কিন্তু এছাড়া কি কোনো পথ আছে? আমাদের সংবিধান মেনে চলতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের উপরে কথা বলার সুযোগ আমাদের নেই। যারা নিয়ামক সংস্থা, তারাই যদি যোগ্য ও অযোগ্য বাছতে না পারে, তাহলে দুর্ভাগ্যের অন্ত থাকে না। আমরা চোখের সামনে আমাদের সহশিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের এই পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে দেখছি।"
শিক্ষাকর্মীদের আন্দোলন
আচার্য সদনের কাছেই মধ্যশিক্ষা পর্ষদের দপ্তর নিবেদিতা ভবনে অবস্থান বিক্ষোভে রয়েছেন শিক্ষাকর্মীরা। তাদের অনশন তৃতীয় দিনে পড়েছে। গ্রুপ সি-র চাকরিহারা কর্মী কৌশিকরঞ্জন মণ্ডল বুধবার দুপুরে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি শিক্ষাকর্মীদের দাবি, তাদের অবিলম্বে চাকরিতে ফেরাতে হবে।
আন্দোলনকারী শিক্ষাকর্মী ও হুগলির ধনিয়াখালির বেলমুড়ি ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশনের বিকাশ পাল ডিডাব্লিউকে বলেন, "সবাই শিক্ষকদের কথা বলছেন। আমাদের কথা কেউ বলছেন না। শিক্ষকদের একটা অংশ বেতন পাবেন। সেখানে যোগ্য-অযোগ্য ভেদাভেদ করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে সেটা করা হয়নি। আমরা তালিকা এবং ওএমআর শিট প্রকাশ করার কথা বলেছিলাম। আমাদের কোনো দাবি মানা হচ্ছে না।"
আদালত অবমাননার মামলা
গত বছরের ২২ এপ্রিল কলকাতা হাইকোর্ট চাকরি বাতিলের রায় দেয়। এই রায় বহাল রাখে সুপ্রিম কোর্ট। হাইকোর্ট বলেছিল, অযোগ্য শিক্ষকদের বেতন সুদ সহ ফেরাতে হবে। সেই নির্দেশ মানা হয়নি কেন, এই প্রশ্ন তুলে হাইকোর্টে আদালত অবমাননার মামলা দায়ের হয়।
স্কুল সার্ভিস কমিশনের আইনজীবীর সওয়াল, সুপ্রিম কোর্ট যেহেতু হাইকোর্টের রায়কে পরিমার্জন করেছে, তাই আদালত অবমাননার মামলার বিচার এখানে হতে পারে না। আদালতের বক্তব্য, এই মামলা শোনার এক্তিয়ার সংক্রান্ত যে আইনি প্রশ্ন, তাকে সরিয়ে রেখে দেখতে হবে, আগের নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে কিনা। আগামী সোমবার এই মামলার পরের শুনানি।
পার্শ্বশিক্ষকদের মিছিল
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্কুলে এমনিতেই শিক্ষকের সংকট রয়েছে। ছাত্রের অনুপাতে শিক্ষকের সংখ্যা কম। তার উপরে ছয় হাজার শিক্ষক দাগি হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায বাদ পড়েছেন। এর ফলে শিক্ষকের অভাব আরো বাড়বে। পঠনপাঠন ব্যাহত হবে। এই পরিস্থিতিতে স্কুলে পার্শ্বশিক্ষকদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সামান্য বেতনে এই পার্শ্বশিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরা কাজ করেন। তারা বেতন বৃদ্ধির দাবিতে বিকাশ ভবন অভিযানের ডাক দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ছিলেন স্কুল শিক্ষা দপ্তরের অধীন পার্শ্বশিক্ষক, শিশু ও মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্র, মাদ্রাসা দপ্তরের অধীন মাধ্যমিক শিক্ষাকেন্দ্রের শিক্ষা সহায়ক, শিক্ষা সম্প্রসারক, অ্যাকাডেমিক সুপারভাইজার, শিক্ষা বন্ধু, স্পেশাল এডুকেটর, সমগ্র শিক্ষা মিশনের শিক্ষা কর্মীরা। শিক্ষাক্ষেত্রে যুক্ত এই চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের সংখ্যা কমবেশি ৫০ হাজার।
আন্দোলনকারীদের বক্তব্য, ২০২৪ সালের পয়লা মার্চের যে বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী রাজ্য সরকারের সব চুক্তিভিত্তিক কর্মীর বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছিল, তাদের ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা কার্যকর করতে হবে। বেতন বৃদ্ধি না হলে লাগাতার স্কুল বয়কটের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা।
নিয়োগের দাবি
প্রাথমিক স্কুলে ৩২ হাজার শিক্ষকের নিয়োগ নিয়ে মামলা ঝুলে আছে হাইকোর্টে। আগামী সপ্তাহে তার শুনানি হওয়ার কথা। সেই শুনানির আগে ২০২২ সালের প্রাথমিক টেট উত্তীর্ণ চাকরিপ্রার্থীরা নিয়োগের দাবিতে অবস্থান করলেন। তাদের দাবি, অবিলম্বে প্রাথমিকে ৫০ হাজার শূন্যপদে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হবে। সেই বছরের টেট উত্তীর্ণ প্রার্থীদের নাম অন্যান্য তথ্য সহ প্রকাশ করতে হবে।
যদিও পর্ষদের বক্তব্য, সুপ্রিম কোর্টে ওবিসি সংক্রান্ত একটি মামলা বিচারাধীন থাকায় সংরক্ষণ এখন কার্যকর নয়। সেই মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত করা সম্ভব হচ্ছে না। চাকরিহারা গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি-র শিক্ষাকর্মীরা যেখানে অবস্থান করছেন, তার কাছেই এপিসি ভবনের সামনে অবস্থান করলে পুলিশ আন্দোলনকারীদের তুলে দেয়।