পারিবারিক সহিংসতার পোশাকি নাম ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স বা ডিভি। মে মাসের গোড়ায় প্রকাশিত হয়েছে ভারতের জাতীয় মহিলা কমিশনের এই বছরের প্রথম কোয়ার্টারের রিপোর্ট। প্রথম চার মাসে মোট সাড়ে সাত হাজার জমা পড়া অভিযোগের মধ্যে সিংহভাগই এই ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স সংক্রান্ত। হিসেব বলছে, মোট অভিযোগের ২০ শতাংশ পারিবারিক সহিংসতার কারণে। গতবছর জাতীয় মহিলা কমিশনে নথিভুক্ত মোট অভিযোগের ২৬ শতাংশ ছিল পারিবারিক সহিংসতাজনিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বছরেও তার কাছাকাছি যাবে সংখ্যাটা।
নীরব সহিংসতার ক্ষত
লিঙ্গবৈষম্য আমাদের উপমহাদেশের ডিএনএ-তে আছে। নারীর উপর আক্রমণের ঘটনা তাই সহজাত। পারিবারিক বা গার্হস্থ্য সহিংসতা বললে চট করে আমরা ধরে নিই বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে নারীদের উপর অত্যাচার। স্বামী এবং তার পরিবারের বাকি সদস্যদের নারীর শরীর এবং জীবনের উপর নিয়ন্ত্রণ এবং আক্রমণ পারিবারিক সহিংসতার সিংহভাগ গঠন করে। ইন্টিমেট পার্টনার ভায়োলেন্সের ঘটনা আমাদের দেশে আকছার ঘটে। তবে তার বাইরেও যে দুটি বিষয় বাস্তব হলেও উপেক্ষিত থেকে যায়, তা হলো, মানসিক অত্যাচার এবং বিয়ের আগে নিজের বাড়িতেই অত্যাচার (মানসিক বা শারীরিক)।
ভারতে প্রায় ২০ বছর হলো পারিবারিক সহিংসতা প্রতিহত করতে প্রোটেকশন অফ উইমেন ফ্রম ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স (পিডাব্লিউডিভি) অ্যাক্ট পাশ হয়েছে। আইন থাকলেও ভারতে স্বজন যখন নারী নিগ্রহের ঘটনা ঘটায়, তখন তা পুলিশ বা মহিলা কমিশন পর্যন্ত যেতে অনেক দিন সময় লাগে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যাওয়াই হয় না। যে নিগ্রহ চোখে দেখা যায়, শরীরের ক্ষত রেখে যায় তাকে চেনা সহজ। রোজ মার খেতে খেতে একদিন কোনো নারী পুলিশের কাছে চলে যান হয়তোবা। প্রচণ্ড গালিগালাজ, বা পণ সংক্রান্ত নিপীড়নের একটা সহ্যের সীমা থাকে।
কিন্তু যে অত্যাচার দৃশ্যত নীরব, তার খেয়াল কে রাখে?
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারীর জীবনের গল্প টেনে এনে এই অচ্যাচারের গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করব। বাড়ির ছোটমেয়ে। পড়াশুনায় ভালো। স্নাতকোত্তর স্তরে ডিস্টিংশন পেয়ে, বিএড পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে যখন একটা হাই স্কুলে চাকরি পেলেন তখন বিয়ে হলো। স্বামীর চাকরি হায়দ্রাবাদে। ফলে চাকরি তিনি চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন।
তখন আশির দশক। স্বামী অত্যন্ত যত্নশীল। বিয়ের এক বছরের মধ্যে সন্তান। তার চাকরিতে আপত্তি স্বামীসহ শ্বশুরবাড়ির সবারই। তা-ও সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতায় এবং খানিকটা জেদে আবার একটি স্কুলে চাকরি পেলেন। স্বামীর ট্রান্সফারের চাকরি। শ্বশুর, শাশুড়ি, সন্তানসহ সারা ভারত ঘুরতে গিয়ে থিতু হয়ে চাকরি করা হলো না কৃতী এই নারীর।
অর্থনৈতিক ভাবে স্বাধীন হওয়াই যে তার লক্ষ্য ছিল শ্বশুরবাড়িতে তা বারবার বলেও লাভ হয়নি। কেবলমাত্র চাকরিতে মানা, তাই নয়, এই নারীর স্বাভাবিক জীবনে প্রভাব ফেলতেন শ্বাশুড়ি। কী পোশাক পড়বেন, কোথায় যাবেন, স্বামীর সঙ্গে নিভৃতে কতটা সময় কাটাবেন, এই সব বিষয়ে মন্তব্য করতে ছাড়তেন না বাড়ির বড়রা। স্বামী যত্নশীল হলেও বাবা মায়ের মন্তব্যকে 'মৃদু শাসন' ধরে নিয়ে স্ত্রীকে বলেছিলেন মেনে নিতে। 'কী আর এমন বলেছে? সংসারে একটু মানিয়ে গুছিয়ে তো নিতেই হয়,' বলেছিলেন নারীর মা।
স্বাধীনতা জলাঞ্জলি দিয়ে প্রায় ৪০ বছর সংসার করার পর আপাত সুখী সেই নারী গুরুতর মানসিক হীনমন্যতার শিকার হন। ডিপ্রেশন এমন মাথা চাড়া দেয় যে মনস্তত্ববিদের সাহায্য নিতে হয় দীর্ঘদিন। সেই মনস্তত্ববিদ জানান, এই নারীর স্বাধীন চেতনা অবদমিত হতে হতে মনের ভিতর ক্ষত তৈরি হয়েছে। তিনি এই ঘটনাক্রমকে এক প্রকার 'পারিবারিক হিংসা' বলেন। হতবাক এই নারী এবং তার স্বামী আকাশ থেকে পড়েন। যাকে তারা 'হিংসা' হিসেবে চিহ্নিত করেননি তার জেরে এই মুহূর্তে নিয়মিত চিকিৎসাধীন এই নারী।
সহিংসতার স্বাভাবিকীকরণ
দৃশ্যত নীরব মানসিক অত্যাচার এই উদাহরণে শেষ হয় না। বরং এই রকমের সহিংসতার হিমশৈলের চূড়ার ইঙ্গিত দেয়।
মানসিক নিপীড়নের আলোচনা আমরা যাও বা করতে শুরু করেছি, সম্পূর্ণ উপেক্ষিত থেকে যায় বিয়ের আগে নিজের বাড়িতেই পারিবারিক সহিংসতার সঙ্গে 'মানিয়ে নেওয়ার' বিষয়টি। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, উপরোক্ত উদাহরণে উচ্চশিক্ষিত এক নারী 'সাংসারিক কারণে' তার উপর চাপানো নিষেধাজ্ঞা মেনে নিলেন কেন? এর সহজতম উত্তর, ছোটবেলা থেকে নিষেধাজ্ঞা মেনে নেয়ার পাঠ দেয় আমাদের সমাজ।
ভারতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশুকাল থেকেই কন্যা সন্তানদের উপর এক রকম বৈষম্য এবং গণ্ডির ঘেরাটোপ থাকে। কন্যাসন্তানদের উপর পরিবারের পুরুষদের, এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে বাবার যৌন নির্যাতনের ঘটনাও বার বার সামনে এসেছে। সেই নিপীড়ন খালি চোখে দেখা যায়। অন্যদিকে, ক্রমাগত বৈষম্য, আপোষ এবং 'মানিয়ে নেওয়ার' শিক্ষা, নিজের ইচ্ছাকে দমন করার পাঠ যে আদতে একপ্রকার মানসিন নিপীড়ন তা আমরা বুঝতে পারি না। একটি নারীকে শিশুকাল থেকে শেখানো হয় তাকে নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দেওয়ার আগে সংসারকে প্রাধান্য দিতে হবে। ফলে, তার অর্থনৈতিক ভাবে স্বাধীন হওয়ার ইচ্ছেই হোক বা সন্তান গ্রহণ বা না গ্রহণের সিদ্ধান্তই হোক -- বৃহদাংশেই তা পরিবারের অন্য সদস্যদের দ্বারা প্রভাবিত।
তার শরীরে এবং মনে যে একমাত্র তারই অধিকার বর্তায় তার কোনো ইঙ্গিত সমাজ দেয় না। ছোটবেলায় মাছের বড় টুকরো তার ভাই পাবে আর বিয়ে হয়ে গেলে বাড়ির পুরুষদের খাওয়া হয়ে গেলে তবেই খেতে বসবেন। এটাই দস্তুর। শিশুকাল থেকে নিজের বাড়িতে এই 'মানিয়ে নেওয়ার' পাঠ আসলে পরবর্তীকালে পারিবারিক সহিংসতাকে স্বাভাবিক করে তোলে। এর ফলে সহিংসতা সহ্য করার চৌকাঠ এতটাই উঁচু হয়ে যায় যে, শারীরিক আঘাতের আগে বেশিরভাগ নারী বুঝতেই পারেন না তিনি মানসিক ভাবে নিগৃহীত হচ্ছেন। ফলে পারিবারিক সহিংসতা পেরিয়ে থানা, পুলিশ, কমিশন করতে অনেক দেরি হয়ে যায়।
পারিবারিক সহিংসতা এবং পুরুষ
ভারতে প্রোটেকশন অফ উইমেন ফ্রম ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স (পিডাব্লিউডিভি) অ্যাক্ট নারীদের সুরক্ষা দেয়। কেবলমাত্র স্ত্রী-ই নন মা, বোন, বাড়ির বিধবা নারী, লিভ-ইন পার্টনার এমনকি আশ্রিতাও এই আইনের সুরক্ষা পেতে পারেন। তবে শাশুড়িরা এই আইনের সুরক্ষা পান না। এবং পান না পুরুষরা।
পারিবারিক সহিংসতা নিয়ে এই লেখা শেষ করার আগে এ কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন, সংখ্যায় কম হলেও এই সহিংসতার পরিসংখ্যানে জায়গা করে নিয়েছেন পুরুষরাও। বিশেষ করে নাবালকরা। লিঙ্গ নির্বিশেষে শিশুকাল থেকে পরিবারের লোকজন, এমনকী বাবা মায়ের হাতেও নানারকম নিপীড়নের শিকার হয় শিশুরা। সম্প্রতি, কলকাতার একটি এনজিও স্বয়ম একটি সমীক্ষায় দেখিয়েছে, এই নিপীড়ন বহুগুণ বেড়েছে কোভিড-কালের লকডাউনের সময় থেকে। শারীরিক নিগ্রহ, মাত্রাতিরিক্ত শাসন, সন্তানের জীবনে নিরন্তর নজরদারিসহ বিভিন্ন বিষয় অপরিবর্তনশীল ট্রমা সৃষ্টি করে শিশুমনে। বিশেষজ্ঞরা একে নেটাল ফ্যামিলি ভায়লেন্স বলে চিহ্নিত করেছেন। এই সহিংসতার মাত্রা বহুগুণ বৃদ্ধি পায় সন্তান তৃতীয় বা প্রান্তিক লিঙ্গের হলে।
ভারতে বৈষম্য, নিপীড়ন সহ্যের সীমা বেশি। পারিবারিক সহিংসতার পরিসংখ্যান কোনো ব্যতিক্রমী চিত্র দেয় না। বহুদিনের সংগ্রামের ফলে নারীকে সুরক্ষিত রাখার কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে দেশ। আইন এসেছে। সচেতনা বাড়াতে এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন সংস্থা। বাস্তব না বদলালেও মূলধারার আলোচনায় ঢুকে পরেছে পারিবারিক সহিংসতার মতো বিষয়গুলি। তবে মনের উপর হিংসার বীজ বপন নিয়ে এখনো আমরা উদাসীন। যে নিপীড়ন গায়ে না, মনে কালশিটে রেখে যায়, তার ক্ষত যেমন সহজে দেখা যায় না, তেমন সহজে উপশমও হয় না। সহিংসতার পুঁথিগত পাঠে সেই ব্যাথা আমরা যেন ভুলে না যাই।