মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে সহায়ক হতে পারে জাতিসংঘের রিপোর্ট
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫এই প্রতিবেদন বাংলাদেশের মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সাক্ষ্য হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা৷
এছা়ড়া যারা দেশের বাইরে পলাতক আছেন তাদের ফিরিয়ে আনার জন্যও এই প্রতিবেদন সহায়ক হবে বলে মনে করছেন তারা৷
প্রতিবেদনে যা আছে
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আহ্বানের পর জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস জুলাই-আগস্টের ঘটনা নিয়ে তদন্ত করেছে৷ বুধবার সেই তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়৷ এতে বলা হয়েছে, ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্টের মধ্যে এক হাজার জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে, এবং এসময় হাজার হাজার মানুষ আহত হয়েছেন৷ এদের অধিকাংশই বাংলাদেশের নিরাপত্তাবাহিনীগুলোর হাতে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন৷ প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, নিহতদের মধ্যে ১২-১৩ শতাংশ ছিল শিশু৷ বাংলাদেশ পুলিশ জানিয়েছে, তাদের ৪৪ জন কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন৷
বাংলাদেশের সাবেক সরকার, নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সহিংস সংগঠনগুলো গত বছরের ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভের সময় পদ্ধতিগতভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর সাথে জড়িত ছিলো বলে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে৷
কীভাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং অন্যান্য ক্ষেত্রের কর্মকর্তারা একাধিক বড় আকারের অভিযানের নির্দেশনা দেন ও তদারকি করেন, যেখানে নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের গুলি করে হত্যা করেছিল বা নির্বিচারে গ্রেফতার ও নির্যাতন করেছিল, তার প্রমাণ পেয়েছে জাতিসংঘ৷
যখন সাবেক সরকার দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করেছিল তখন সংঘটিত প্রতিশোধমূলক হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ কর্মী ও সমর্থক, পুলিশ এবং মিডিয়াকে লক্ষ্য করে করা অন্যান্য গুরুতর প্রতিশোধমূলক সহিংসতার ঘটনাগুলোও নথিভুক্ত করেছে জাতিসংঘের তদন্তকারীরা৷
হিন্দু, আহমাদিয়া মুসলিম এবং চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলগুলোর আদিবাসী জনগণের বিরুদ্ধেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে বলে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে৷ যদিও বিভিন্ন ধর্মীয় ও আদিবাসী গোষ্ঠীর ওপর আক্রমণের সাথে সম্পর্কিত প্রায় ১০০ জন গ্রেপ্তার হয়েছে, তবে অনেক প্রতিশোধমূলক সহিংসতা এবং এসব গোষ্ঠীর ওপর আক্রমণের পরেও অপরাধীরা এখনও দায়মুক্তি উপভোগ করছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ৷
‘জাতিসংঘের রিপোর্ট সাক্ষ্য হিসাবে ব্যবহারের সুযোগ আছে'
পূর্ব তিমুরে জাতিসংঘের অধীনে গণহত্যার জন্য গঠিত আদালতের সাবেক বিচারক ড. শাহজাহান সাজু বলেন, ‘‘এখানে এখন যে গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে সেই আদালতে জাতিসংঘের এই রিপোর্ট সাক্ষ্য হিসাবে ব্যবহার করার সুযোগ আছে৷ এজন্য বাংলাদেশে জাতিসংঘ অফিসের মাধ্যমে আবেদন করতে হবে৷ সেই আবেদন তারা গ্রহণ করলে তাদের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে এসে সাক্ষ্য দেবেন৷ তাদের কাছে ডকুমেন্ট আছে৷ আলামত আছে৷ সব কিছুই তখন বাংলাদেশের আদালতে উপস্থাপন করা যাবে৷''
‘‘তারা যে প্রতিবেদন দিয়েছে তাতে বাংলাদেশ সরকারের গণহত্যার বিচার অনেক সহজ হয়ে গেছে৷ যারা বড় বড় এই মামলায় আসামি তাদের অপরাধের কথা তো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,'' বলেন তিনি৷
ড. সাজু বলেন, ‘‘আবার সরকার চাইলে এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসেও যেতে পারে৷ কিন্তু এখানে বিচারেও কোনো সমস্যা নাই৷ কারণ এটা মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল৷''
‘পলাতকদের ফেরত আনায় এই প্রতিবেদন সহায়ক হবে'
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির মনে করেন, ‘‘জতিসংঘ তো তথ্য উপাত্ত দিয়ে প্রমাণ করে দিলো এখানে মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে৷ এখন সরকার জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন কীভাবে কাজে লাগাবে তা তাদের বিবেচনার ব্যাপার৷ সরকার এখন নিশ্চয়ই এটা বিশ্লেষণ করে দেখবে৷ তারপর সিদ্ধান্ত নেবে৷''
‘‘সরকার যদি মনে করে তাহলে এই বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতেও নিয়ে যেতে পারে৷ কিন্তু এখানে তো মানবতাবিরোধী অন্তার্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে৷ সরকার সেখানেও এই রিপোর্ট কাজে লাগতে পারে৷ পলাতক আসামিদের ফেরত আনার জন্যই এই প্রতিবেদন সহায়তা করবে,'' বলেন তিনি৷
মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার' এর পরিচালক নাসির উদ্দিন এলান বলেন, ‘‘জাতিসংঘের প্রতিবদেনে এটা স্পষ্ট যে আওয়ামী লীগ সরকার তার ক্ষমতা ধরে রাখতে এখানে মাসকিলিং চালিয়েছে৷ বাংলাদেশে তার বিচার শুরু হয়েছে৷ কিছু গ্রেপ্তার হয়েছে৷ কিন্তু অনেকেই দেশের বাইরে পলাতক আছেন৷ আমরা মনে হয় সরকার এই প্রতিবেদনকে কাজে লাগিয়ে পলাতকদের দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে পারে৷ জাতিসংঘের সহায়তাও চাইতে পারে৷ জাতিসংঘের এই প্রতিবেদন শেখ হাসিনাসহ অন্যদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করতে সহায়তা করবে৷ সরকারের সেই চেষ্টা করা উচিত৷ জড়িত সবাইকে বিচারের আওতায় আনা নিশ্চিত করতে হবে৷''
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘প্রতিবেদনে দল হিসাবে আওয়ামী লীগের কথাও উঠে এসেছে৷ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ফ্যাসিবাদী দলের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে৷ আমরা মনে হয় সরকার ও বাংলাদেশের জনগণকে আওয়ামী লীগের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত৷''
‘জাতিসংঘের কাছে কেস টু কেস তদন্তের সহায়তা চাইতে পারে সরকার'
মানবাধিকার কর্মী এবং সরকারের গুম কমিশনের সদস্য নূর খান বলেন, ‘‘প্রতিবেদনে স্পষ্ট হয়েছে যে সাবেক সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গণহত্যার দায় এড়াতে পারবেন না৷ সাবেক সরকার নিজ দেশের নাগরিকদের ওপর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে মারণান্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছে৷ তাই এটা নিঃসন্দেহে মানবতাবিরোধী অপরাধ৷ বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এরইমধ্যে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে৷ এই বিচার জাতিসংঘের প্রতিবেদনের সঙ্গে সামঞ্জস্যস্যপূর্ণ মনে হয়েছে৷''
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘প্রতিবেদনে জেনোসাইড শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি৷ এই কারণেই হয়তো তারা অধিকতর তদন্তের কথা বলেছে৷ আমরা মনে হয় জাতিসংঘের কাছে এখন কেস টু কেস তদন্তের সহায়তা চাইতে পারে সরকার৷ তাতে গণহত্যার বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে৷''
‘‘সংখ্যালঘুদের ওপর যে হামলা নির্যাতনের কথা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সে ব্যাপারে সরকারকে বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে,'' বলেন তিনি৷
সরকার স্বাগত জানিয়েছে
এদিকে, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের রিপোর্টকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার৷ প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে সরকারের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন৷ তিনি পুলিশ, প্রসিকিউটর এবং বিচারকসহ বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত সকলকে আইনের শাসন সমুন্নত রাখার জন্য কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন৷
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘‘আমি অন্তর্বর্তী সরকারে কর্মরত সকল ব্যক্তি এবং কোটি কোটি নাগরিককে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশকে এমন একটি দেশে রূপান্তরিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যেখানে সকল মানুষ নিরাপত্তা ও মর্যাদার সাথে বসবাস করতে পারবে৷''
হারুন উর রশীদ স্বপন (ঢাকা)