মমতার অভিযোগে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রতিক্রিয়া
১৮ এপ্রিল ২০২৫বুধবার কলকাতায় ইমাম-মুয়াজ্জিনদের নিয়ে একটি বৈঠক করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে তিনি অভিযোগ করেছিলেন, 'বাংলাদেশের দুষ্কতী'দের মুর্শিদাবাদে নিয়ে এসে 'পূর্বপরিকল্পিত' দাঙ্গা করানো হচ্ছে। নাম না করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উদ্দেশ্যে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, "আপনি বাংলাদেশের পরিস্থিতি জানেন না? আপনি ইউনূসের সঙ্গে গোপন মিটিং করুন, চুক্তি করুন। দেশের ভালো হলে খুশি হব। কিন্তু আপনাদের প্ল্যানিংটা কী? কোন এজেন্সির মাধ্যমে ওখান থেকে লোক নিয়ে এসে দাঙ্গা করা?"
মুখ্যমন্ত্রীর এই অভিযোগের রাজনৈতিক জবাব দিয়েছে বিজেপি। এবার আনুষ্ঠানিকভাবে এর প্রতিবাদ জানালো ঢাকা। বৃহস্পতিবার ঢাকায় প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেন, ''মুর্শিদাবাদের সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় বাংলাদেশকে জড়ানোর যেকোনো চেষ্টাকে আমরা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করি।'' পাশাপাশি তিনি জানিয়েছেন, ভারতে মুসলিমদের উপর হামলা এবং জানমালের ক্ষতি হওয়ার ঘটনার নিন্দা করছে বাংলাদেশ। ভারতে মুসলিম সম্প্রদায়ের পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আবেদন জানিয়েছেন তিনি। উল্লেখ্য, এই আবেদন কেবল ভারত সরকারের কাছে নয়, আলাদা করে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছেও জানানো হয়েছে।
বুধবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আরো অভিযোগ করেছিলেন। তার বক্তব্য, এই দাঙ্গা বিজেপির পূর্বপরিকল্পনা। বাইরে থেকে লোক নিয়ে এসে এই কাজ করানো হয়েছে। বিএসএফ সীমান্ত এলাকা থেকে টাকা দিয়ে লোক নিয়ে এসেছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। এরপরেই সংবাদসংস্থা এএনআই-এর একটি এক্স হ্যান্ডেল পোস্টের উল্লেখ করেন তিনি। সেখানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সোর্স উল্লেখ করে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ থেকে লোক এসে মুর্শিদাবাদে দাঙ্গার ঘটনা ঘটাচ্ছে।
মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ, এর দায় কেন্দ্রকে নিতে হবে। কেন বিএসএফ বাংলাদেশ থেকে লোক ঢুকতে দিল, এই প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
দেশের ভিতরেও বিতর্ক
মুর্শিদাবাদের ঘটনা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যে বিতর্ক হচ্ছে দেশের ভিতরেও। বিরোধীরা তো বটেই, বিশেষজ্ঞদের একাংশও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই বক্তব্যের নিন্দা করেছেন। সহিংসতার ঘটনায় শামসেরগঞ্জে কুপিয়ে খুন করা হয় বাবা ও ছেলেকে। সেই ঘটনায় এখনো পর্যন্ত দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা দুজনেই ভারতীয়। প্রশ্ন উঠছে, যদি সত্যিই বাংলাদেশ থেকে মানুষ এসে এই ঘটনা ঘটিয়ে থাকে, তাহলে এখনো পর্যন্ত একজন বাংলাদেশিকেও গ্রেপ্তার করা গেল না কেন?
প্রবীণ সাংবাদিক আশিস গুপ্ত এবিষয়ে ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''বছরকয়েক আগে কলকাতায় ডেঙ্গি বেড়ে যাওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে মশা এসে কলকাতায় ডেঙ্গি ছড়াচ্ছে। কোনো বিষয় হাতের বাইরে চলে গেলেই বাংলাদেশকে জড়িয়ে নেন মুখ্যমন্ত্রী। এ তার এক আশ্চর্য স্বভাব।'' আশিসের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রীর এই অভিযোগ দুই দেশের সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলবে, তাতে সন্দেহ নেই। এই ধরনের মন্তব্য করার আগে একজন মুখ্যমন্ত্রীর কূটনৈতিক বিষয়গুলি মাথায় রাখা উচিত। হাতে তথ্যপ্রমাণ নিয়ে এই ধরনের মন্তব্য করা উচিত।
সাংবাদিক শরদ গুপ্তাও আশিসের সঙ্গে সহমত। ডিডাব্লিউকে তিনি বলেছেন, ''বাংলাদেশে পালা বদলের পর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে টেনশন তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে এমন মন্তব্য পরিস্থিতি আরো খারাপ করতে পারে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এমন মন্তব্য করার আগে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করা উচিত ছিল।'' শরদের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রীর এই মন্তব্য অকারণে বাংলাদেশের হাতে একটি কার্ড তুলে দিল। আদতে যার কোনো প্রয়োজন ছিল না।
বস্তুত, মুর্শিদাবাদের ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে কোনো কোনো মহল। প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, সহিংসতা শুরু হওয়ার খবর কেন আগে থেকে গোয়েন্দাদের কাছে ছিল না? কেন গোড়াতেই যথেষ্ট শক্ত অবস্থান নিল না প্রশাসন? ওয়াকফ নিয়ে সেখানে যে গন্ডগোল হতে পারে, এমন অনুমান তো আগেই করা উচিত ছিল! বস্তুত, প্রশাসনের ব্যর্থতার বিষয়টি যে সরকারও মানছে, তার প্রমাণ বৃহস্পতিবার শামসেরগঞ্জ এবং সুতি থানার ওসিকে সরিয়ে দেওয়ার ঘটনা। ইতিমধ্যেই ইনস্পেক্টর পদমর্যাদার নতুন ওসি নিয়োগ করা হয়েছে ওই দুই থানায়।
এদিকে ঢাকার মন্তব্য় নিয়ে মন্তব্য করেছেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল। তিনি বলেছেন, ''বাংলাদেশের বক্তব্য আমরা প্রত্যআখান করছি। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের নিয়ে ভারতের উদ্বেগের একটি সমান্তরাল তৈরির চেষ্টা করেছে বাংলাদেশ। কিন্তু এই দুইটি বিষয় কখনোই এক নয়। বাংলাদেশ নিজের দেশের সংখযালঘুদের সুরক্ষার দিকে নজর দিক।''
শুক্রবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে তার মন্তব্য তুলে ধরা হয়।
সেখানে জয়সওয়াল বলেন, ‘‘আমরা পশ্চিমবঙ্গের ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করছি। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর চলমান নিপীড়ন নিয়ে ভারতের উদ্বেগের সঙ্গে তুলনা টানার বিষয়টি প্রায় প্রকাশ্য ও কপট অপচেষ্টা। সংখ্যালঘু নির্যাতনে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা এখনো সেখানে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।’’
রণধীর জয়সওয়াল আরো বলেন, ‘‘অনভিপ্রেত মন্তব্য না করে এবং নৈতিকতার আশ্রয় না নিয়ে বাংলাদেশ বরং নিজেদের সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় মনোযোগী হোক।’’
ওয়াকফ সংশোধনী বিল পাশ হওয়ার পর পশ্চিমবঙ্গের মালদা এবং মুর্শিদাবাদে আন্দোলন শুরু হয়। সেই আন্দোলনই ক্রমশ সহিংস হয়ে ওঠে বলে অভিযোগ। আন্দোলন কার্যত দাঙ্গার চেহারা নেয়। এখনো মুর্শিদাবাদে বহু মানুষ ঘরছাড়া। তবে ধীরে ধীরে ঘরছাড়াদের ঘরে ফেরানো শুরু হয়েছে। এখনো সেখানে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করে রাখা হয়েছে।
এসজি/জিএইচ (দৈনিক প্রথম আলো, পিটিআই)