ভোটের আগে আবার তৃণমূলের দল ভাঙানোর রাজনীতি
১১ মার্চ ২০২৫সারা দেশে গত কয়েক বছরে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের এক দল থেকে অন্য দলে যোগদানের প্রবণতা বেড়েছে। পশ্চিমবঙ্গ তার ব্যতিক্রম নয়। এখানে ক্ষমতাসীন তৃণমূল ভোটের আগে আবার বিধায়ক ভাঙানোর খেলায় নেমেছে। তার সর্বশেষ উদাহরণ হলদিয়ার বিধায়ক তাপসী।
বিজেপি থেকে তৃণমূলে
২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে সিপিএমের টিকিটের জয়ী হয়েছিলেন তাপসী মণ্ডল। বিধানসভা নির্বাচনের এক বছর আগে, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে মেদিনীপুরে বিজেপি শীর্ষ নেতা অমিত শাহের সভায় তিনি যোগদান করেন গেরুয়া শিবিরে। ২০২১ সালে তাপসী পদ্মফুল প্রতীকে হলদিয়া কেন্দ্রেই জেতেন। আগামী বছর রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার কথা। ঠিক তার এক বছর আগে তাপসী এবার গেলেন তৃণমূলে। সোমবার তৃণমূল ভবনে রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস বিজেপি বিধায়কের হাতে জোড়াফুল পতাকা তুলে দেন।
২০২১ সালের নির্বাচনের পর তাপসী হলেন ১২তম বিজেপি বিধায়ক যিনি তৃণমূলে যোগ দিলেন।
দলবদল করে তাপসী বিজেপির বিরুদ্ধে বিভাজনের রাজনীতির অভিযোগ তুলেছেন। তার বক্তব্য, "বিভাজনের রাজনীতি মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল। প্রতিবাদ করা সত্ত্বেও পরিবর্তন হয়নি। এর পাশাপাশি হলদিয়ার উন্নয়নের কথা ভেবে তৃণমূলের সঙ্গে যুক্ত হলাম।"
বিজেপি ভেদাভেদের রাজনীতি করছে এটা বুঝতে বিধায়কের কেন চার বছরের বেশি সময় লাগল, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সিপিএম। বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর বক্তব্য, "এর আগে মুকুটমণি অধিকারী, বিশ্বজিৎ দাস, কৃষ্ণ কল্যাণী তৃণমূলে গিয়ে ভোটে লড়েছেন। ওদের আমরা হারিয়েছি ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে। তাপসীকে প্রার্থী করলে হলদিয়ার তৃণমূলে নেতারাই ওকে হারিয়ে দেবে।"
তাপসী দলবদল করলেও বিধায়ক পদ ছাড়েননি। দলবদল আইন অনুসারে এইভাবে দলবদল করা যায় না। দুই তৃতীয়াংশ বিধায়ক দল ছাড়লেই তা বৈধ। কিন্তু এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা বিধানসভা স্পিকারের কাছে। তার একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া আছে। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান বিধানসভার মেয়াদ আর এক বছরও নেই।
দলবদল ও বিধায়ক ভাঙানোর রাজনীতি
রাজনীতির এই চাপানউতোর থেকে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে দলবদল বা দল ভাঙানোর রাজনীতির প্রশ্নটি। সাম্প্রতিক অতীতে পশ্চিমবঙ্গে অনেক জনপ্রতিনিধি একদল থেকে অন্য দলে যোগ দিয়েছেন। মূলত বাম ও বিজেপি থেকে তৃণমূলে যোগদানের প্রবণতা দেখা গিয়েছে। বিরোধীদের বক্তব্য, রাজ্যের শাসক দল তাদের শিবির ভাঙিয়েছে। বিপরীতে শাসক নেতাদের বক্তব্য, তারা স্বেচ্ছায় উন্নয়নের খাতিরে তাদের দলে যোগ দিয়েছেন।"
শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, সারা দেশেই এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এ জন্য শুরু হয়েছে রিসর্ট পলিটিক্স। মূলত বিজেপি অন্য দল ভাঙিয়ে সরকার গড়েছে। আবার শিবসেনার মতো রাজনৈতিক দল ভেঙে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে গেরুয়া শিবিরের বিরুদ্ধে।
ভারতের রাজনীতিতে আয়ারাম-গয়ারাম প্রবাদ অনেক পুরোনো। ২০১১-র পর থেকে পশ্চিমবঙ্গেও দলবদল ও দল ভাঙানোর রাজনীতি অনেকগুণ বেড়েছে।
দেশের সার্বিক প্রবণতার প্রতিফলন দেখা গিয়েছে অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্ম (এডিআর)-এর রিপোর্টে। ২০২১ সালে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৪-২১ সালে সবচেয়ে বেশি নেতা কংগ্রেস ত্যাগ করেছেন। মোট ২২২ জন প্রার্থী অন্য দলে যোগ দিয়েছেন। কংগ্রেস ছেড়েছেন ১৭৭ জন বিধায়ক-সাংসদ। উত্তরপ্রদেশের বহুজন সমাজ পার্টি থেকে ১৫৩ জন জনপ্রতিনিধি দল ছেড়েছেন৷ ৩৩ জন জনপ্রতিনিধি বিজেপি ছেড়েছেন ৷
আইনকে বুড়ো আঙুল
দলবদল ঠেকাতে সংবিধানে সংশোধনী আনা হয়েছিল। ১৯৮৫ সালে সংবিধানের ৫২তম সংশোধনী অনুসারে দুই-তৃতীয়াংশের কম সদস্য দল পরিবর্তন করলে সেটা বেআইনি৷ কিন্তু এই নেতাদের অধিকাংশই দল ছাড়লেও পদ ছাড়ছেন না। এক্ষেত্রে তৈরি হচ্ছে নৈতিকতার সংকট।
ভারতের সাবেক রেলমন্ত্রী মুকুল রায় ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির টিকিটে নদিয়া থেকে জিতে পরে তৃণমূল কংগ্রেসের ফিরে যান। দলত্যাগ বিরোধী আইনে বিধায়কের বিরুদ্ধে স্পিকারের কাছে অভিযোগ জানায় বিজেপি৷ বিষয়টি গড়ায় সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত৷
আবার বিজেপি সাংসদ বাবুল সুপ্রিয় তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পরে সংসদের সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দেন। গত বছরের লোকসভা নির্বাচনে নামার আগে বিজেপিতে যোগ দেয়া তাপস রায় তৃণমূলের টিকিটের জেতা বিধায়ক পদ ছেড়ে দিয়েছিলেন।
ক্ষমতার লক্ষ্যে দল ভাঙাগড়ার নজির অতীতেও পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে। ১৯৬৭ সালে যুক্তফ্রন্টের আমলে প্রফুল্ল ঘোষের নেতৃত্বে ১৭ জন বিধায়ক পিডিএফ গঠন করেছিলেন৷ সেই ফ্রন্ট ভেঙে আবার তৈরি হয়েছিল আইএনডিএফ৷ এই দলবদল হয়েছিল ক্ষমতার তাগিদে। তার চার দশক পরে ২০১১ সালে তৃণমূল ও কংগ্রেস জোট সরকার পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসে৷ কয়েক মাস পরে জোট ভেঙে দেয় কংগ্রেস। পরবর্তীতে ১৭ জন কংগ্রেস ও ৬ জন বাম বিধায়ক তৃণমূলে যোগ দেন৷
পশ্চিমবঙ্গেও এখন বিষয়টা জলভাত হয়ে গিয়েছে। একাধিক জনপ্রতিনিধি অন্য দলে যোগ দিয়ে আইনসভার ভিতরে পুরোনো দলের প্রতিনিধিত্ব করে চলেছেন। দলত্যাগ বিরোধী আইন থাকা সত্ত্বেও কীভাবে এটা সম্ভব হচ্ছে?
'তৃণমূল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে'
সাংবাদিক দীপ্তেন্দ্র রায়চৌধুরী ডিডাব্লিউকে বলেন, "এক দল থেকে অন্য দলে গেলে তাকে বিধায়ক পদ ছাড়তে হয়, নইলে স্পিকার তার সদস্যপদ খারিজ করে দেন।এই দলত্যাগ বিরোধী আইন পশ্চিমবঙ্গ বাদে দেশের সর্বত্র কার্যকর হচ্ছে। হয়তো স্পিকার একটু বেশি সময় নিচ্ছেন অন্য রাজ্যে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস একটা নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে যে, কীভাবে একটা আইন বানচাল করে দেয়া যায়।
এই আইনে ক্ষমতাটা দেওয়া হয়েছে স্পিকারের হাতে। কিন্তু কত দিনের মধ্যে স্পিকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, সে কথাটা বলা নেই। পশ্চিমবঙ্গে বছরের পর বছর কেটে গেলে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় না।"
পদ না ছেড়ে অন্য দলে যুক্ত হয়ে জনপ্রতিনিধিরা কি জনতার রায়কে অসম্মান করছেন না? এডিআর-এর পশ্চিমবঙ্গ শাখার সঞ্চালক উজ্জয়িনী হালিম বলেন, "পদত্যাগ না করে দলবদল জনগণের রায়কে অগ্রাহ্য করে দেয়। এই ধরনের দলবদল রাজনৈতিক পরিবেশে অস্বচ্ছতা নিয়ে আসে ও অসাধু কার্যকলাপের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। গণতন্ত্রে যদি ঘোড়া কেনাবেচাই ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক হয়, তাহলে সেখানে সত্যিকারের জনগণের প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়।"
তার মতে, "পদত্যাগ না করে দলত্যাগ করা বিধায়ক বা সাংসদদের পদ খারিজ করে আবার জনতার দরবারে নতুন ম্যান্ডেট নিয়ে আসার জন্য ফেরত পাঠানো উচিত। এ জন্য আইন দরকার, আজ তার অভাব রয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, স্পিকার উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছেন না। অথচ দল ভাঙিয়ে বহু রাজ্যে সরকার পর্যন্ত পরিবর্তন করা হয়েছে।"
এর ফলে রাজনীতিতে নৈতিকতা বলে আর কিছু থাকছে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন, "রাজনৈতিক দলগুলির ক্ষমতালিপ্সা এই নৈতিক অধঃপতনের জন্য দায়ী। তাই একটি দলের হয়ে ভোটে জিতে জনপ্রতিনিধিরা অন্য দলে যোগ দিচ্ছেন, কিন্তু নিজের পদ ছাড়ছেন না। কেন্দ্রে বিজেপি ও রাজ্যে তৃণমূল এই ভোগবাদের তত্ত্ব নিয়ে এসেছে, অর্থাৎ কোনো কিছুর লোভ দেখিয়ে, দল ভাঙিয়ে নিজেদের শক্তিশালী করছে।"
একইসঙ্গে লঘু হয়ে গিয়েছে আদর্শের বিষয়টি। সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন, "রাজনৈতিক আদর্শের তুলনায় এখন এক্সিকিউশন বা কোনো কর্মসূচির বাস্তব রূপায়ণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ এটা আগেই তাত্ত্বিকভাবে প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন। এখন দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গেও এটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।"