ভারতের বার্নিহাট কেন বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর?
১১ মার্চ ২০২৫সুইস সংস্থা আইকিউ এয়ার ২০২৪ সালের সবচেয়ে দূষিত শহর ও দেশের তালিকা প্রকাশ করেছে। সেই তালিকায় দূষিত শহরের ক্ষেত্রে বার্নিহাট এক নম্বরে আছে। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত রাজধানী শহর হলো দিল্লি। বায়ুদূষণের নিরিখে এবং বাতাসে ফাইন পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম দুই দশমিক পাঁচ-এর উপস্থিতির ভিত্তিতে এই তালিকা তৈরি করা হয়েছে। বিশ্বের স বচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় প্রথম ২০টি শহরের মধ্যে ১৩টি শহরই ভারতের।
দিল্লির দূষণ বহুচর্চিত বিষয়। প্রতিবার শীতের আগে থেকে দিল্লির দূষণ যখন চরমে ওঠে, তখন তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে লেখালিখি হয়, বিতর্ক হয়, ভারতের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত দিল্লির দূষণ নিয়ে বিশেষ নির্দেশ দিয়েছে। তারা জানিয়েছে, দূষণমুক্ত বাতাস মানুষের অধিকারের মধ্যে পড়ে। সেই তুলনায় বার্নিহাট নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা নেই। সকলের নজরের অগোচরে থাকা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের শিরোপা পাওয়া এই শহর সম্পর্কে ভারতের মানুষই সেভাবে জানেন না।
বার্নিহাট কেন সবচেয়ে দূষিত?
বার্নিহাট হলো আসাম ও মেঘালয় সীমানায় থাকা একটা ছোট শহর। এটা শিল্প শহর এবং এক্সপোর্ট প্রমোশন এলাকায় পড়ে। এখানে তাই ৪১টিরও বেশি কারখানা রয়েছে।
এই কারখানার মধ্যে আছে লৌহ এবং ইস্পাত কারখানা, পানীয় জল ও ঠান্ডা পানীয়র কারখানা এবং প্রচুর সিমেন্ট কারখানা। এই সব কারখানা থেকে অনিয়ন্ত্রিত দূষণ ছড়ায়। সবসময়ই এই জায়গায় বায়ুদূষণের পরিমাণ খুবই উদ্বেগজনক জায়গায় থাকে।
আসামে ডিডাব্লিউর প্রতিনিধি বিশ্বকল্যাণ পুরকায়স্থ বার্নিহাটের পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন, ''বার্নিহাটের মাত্রাছাড়া দূষণের পিছনে এখানকার সিমেন্ট-সহ বিভিন্ন কারখানার অবদান প্রচুর।''
তবে শুধু এই কারখানাই নয়, বার্নিহাটে বায়ুদূষণ বৃদ্ধিতে ছোট-বড় ট্রাক ও ম্যাটাডোরের ভূমিকাও কম নয়। শিল্পতালুক বলে প্রচুর বড় বড় ট্রাকও নিয়মিত যাতায়াত করে। এই সব যানবাহন থেকে নির্গত দূষণের পরিমাণ কম নয়।
কাস্টমস অ্যান্ড সেন্ট্রাল এক্সাইজ বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান সুমিত দত্ত মজুমদার আসামে দীর্ঘদিন ছিলেন। তার ছেলেবেলা কেটেছে শিলচরে। ডিডাব্লিউকে তিনি বলেন, ''বার্নিহাটের সামান্য আগে থেকে পাহাড়ি রাস্তা শুরু হয়েছে। বার্নিঘাটের চারপাশে পাহাড় থাকায় দূষিত বায়ু অন্যত্র চলে যাওয়ার ক্ষেত্রে অসুবিধা হয়।''
বার্নিহাট সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, ''এই সব এলাকায় ট্রাক থেকে প্রবল দূষণ ছড়ায়। স্থৈানীয় ভাষায় বার্নি মানে বস্তা। একসময় এই জায়গাটি বস্তার জন্য বিখ্যাত ছিল।''
দিল্লিতে দূষণ তীব্র হওয়ার পর অতি প্রয়োজনীয় জিনিস বহনকারী ডিজেল ট্রাকই শুধু ঢুকতে দেয়া হয়। অন্য কোনো জিনিস নিয়ে ডিজেল ট্রাক দিল্লিতে ঢুকতে পারে না। ১০ বছরের বেশি বয়সি ডিজেল গাড়ি দিল্লিতে চলতে পারে না। দিল্লিতে পরিবেশ সংক্রান্ত বিধিও কড়া।
কিন্তু বার্নিহাটের পরিস্থিতি সেরকম নয়। এখানে পরিবেশ সংক্রান্ত বিধিনিষেধ অনেক শিথিল। বায়ুদূষণ মাপার কেন্দ্র শিলংয়ে, যা এখান থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে।
বার্নিহাটে অনেকবার গেছেন আশিস গুপ্ত। অসমীয়া প্রতিদিনের দিল্লির ব্যুরো চিফ আশিস ডিডাব্লিউকে জানিয়েছেন, ''বার্নিহাটের কিছুটা এলাকা আসামের মধ্যে পড়ে, বেশির ভাগটা মেঘালয়ে। বলা যায়, এখান থেকেই পাহাড় শুরু হয়েছে। তাই দূষিত বাতাস বাইরে বেরোতে পারে না।''
বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের মধ্যে ১৩টি ভারতের
বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের যে তালিকা আইকিউএয়ার দিয়েছে, তার মধ্যে ১৩টি শহরই ভারতের। তালিকায় এক নম্বরে বার্নিহাট, দুই নম্বরে দিল্লি, চারে পাঞ্জাবের মুল্লানপুর, ছয়ে ফরিদাবাদ, আটে লোনি, নয় নম্বরে নতুন দিল্লি, ১৩ নম্বরে গুরুগ্রাম, ১৪তে গঙ্গানগর, ১৬তে গ্রেটার নয়ডা, ১৭তে ভিওয়ান্ডি, ১৮তে মুজফফরনগর, ১৯শে হনুমানগড়, ২০তে নয়ডা।
এখানে দিল্লি ও নতুন দিল্লি আলাদা করা হয়েছে। নয়ডা এবং গ্রেটার নয়ডাকেও আলাদা শহর হিসাবে ধরা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে সুমিত দত্ত মজুমদার বলেন, ''সাধারণত দিল্লি রাজধানী ক্ষেত্র যাকে এনসিটি বলা হয়, তার মধ্যে দিল্লি, নতুন দিল্লি, গুরুগ্রাম, ফরিদাবাদ, নয়ডা, গাজিয়াবাদ সবই পড়ে যায়। দিল্লি বলতে সাধারণত রাষ্ট্রীয় রাজধানী ক্ষেত্র দিল্লিকেই ধরা হয়। তাছাড়া দিল্লি ও নতুন দিল্লি, নয়ডা ও গ্রেটার নয়ডাকে আলাদা শহর হিসাবে ধরার কোনো যুক্তি নেই।''
ভারত নিয়ে যা বলা হয়েছে
রিপোর্টে বলা হরয়েছে, ২০২৩-এর তুলনায় ২০২৪ সালে ভারতের শহরে গড়ে পিএম দুই দশমিক পাঁচের পরিমাণ অল্প হলেও কমেছে। তারপরেও বায়ুদূষণের নিরিখে ভারত হলো পঞ্চম সবচেয়ে দূষিত দেশ।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, দিল্লি, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, চণ্ডিগড়ে চাষের মাঠে খড় পোড়ানোর জন্য বায়ুদবষণের পরিমাণ খুব বেশি থাকে। এই সব জায়গায় বায়ুদূষণ যখন সর্বোচ্চ থাকে, তখন ৬০ শতাংশ দূষণ হয় এই খড় পোড়ানোর জন্য। ভারতে ৩৫ শতাংশ শহরের বাতাসে পিএম দুই দশমিক পাঁচের পরিমাণ নির্ধারিত সীমার থেকে দশগুণ বেশি। বড় শহরের মধ্যে দিল্লির পরেই দবষণের তালিকায় আছে কলকাতা। সেখানেও বায়ুদূষণের পরিমাণ যথেষ্ট।
বলা হয়েছে, দূষণ কমাতে গেলে গাড়ি থেকে নির্গত গ্যাস, কলকারখানা থেকে নির্গত দূষিত পদার্থ কম করতে হবে, বাতাসে ধুলোর পরিমাণ কমাতে হবে এবং খড় পোড়ানো বন্ধ করতে হবে। সরকারি প্রয়াস সত্ত্বেও দূষণ সেভাবে কমছে না বলেও জানানো হয়েছে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে দূষিত বাতাসের জন্য দূষিত শহরে বাস করা ভারতীয়দের গড় আয়ু পাঁচ বছর দুই মাস কমে যাচ্ছে।