ভারতের বন্দর কেন বাংলাদেশকে ব্যবহার করতে দিচ্ছে না দিল্লি?
১০ এপ্রিল ২০২৫গত ৮ এপ্রিল নোটিফিকেশন জারি করে ভারত জানিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশকে আর বাণিজ্যের জন্য ভারতের বন্দর ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। বিষয়টি নিয়ে দুই দেশের কূটনৈতিক মহলে বিতর্ক শুরু হয়েছে।
কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট
২০২০ সাল থেকে বাংলাদেশকে বিশেষ সুবিধা দিয়েছিল ভারত। বলা হয়েছিল, ভারতের সমুদ্র এবং বিমানবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করতে পারবে তারা। গত ৮ এপ্রিল সেই সুযোগ বাতিল করলো ভারত। ভারত জানিয়েছে, বাংলাদেশের বাণিজ্যের কারণে ভারতের বন্দরগুলিতে চাপ তৈরি হচ্ছিল। ভারতীয় ব্যবসায়ীরা সময়মতো জিনিসপত্র পাঠাতে পারছিলেন না। পণ্যের জট তৈরি হচ্ছিল বিভিন্ন বন্দরে। ভারতীয় ব্যবসায়ীদের অসুবিধার কথা চিন্তা করেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তবে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এই নিয়ম চালু হবে না বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, নেপাল এবং ভুটান দুটি ল্যান্ডলক দেশ। ভারতের ভিতর দিয়েই তাদের সঙ্গে বাণিজ্য চালায় বাংলাদেশ। এই দুই দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ যেভাবে বাণিজ্য করছিল, তা অটুট থাকবে বলে জানানো হয়েছে।
ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেছেন, ''২০২০ সাল থেকে পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশকে তৃতীয় দেশে পণ্য রপ্তানির জন্য এই ট্রান্সশিপমেন্টের সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এর ফলে ভারতের বন্দরগুলিতে জট তৈরি হচ্ছে। ভারতীয় রপ্তানিকারকেরা সমস্যায় পড়ছেন। তাই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।'' ৮ তারিখ থেকেই ওই নিয়ম কার্যকর করা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন রণধীর।
বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া
ভারতের এই সিদ্ধান্ত জানার পর বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ''আমাদের উপর যে বিধিনিষেধ আরোপিত হয়েছে, সেখান থেকে উত্তরণের একটি প্রক্রিয়া খুঁজে কাজ করতে হবে। একইসঙ্গে আমাদের নিজস্ব সক্ষমতা ব্যবহার করে প্রতিযোগিতামূলক জায়গাগুলিতে কীভাবে কাজ করতে হবে তা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি।'' তিনি জানিয়েছেন, এবিষয়ে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যেই নেওয়া হয়েছে। আরো কিছু 'চূড়ান্ত' সিদ্ধান্ত পরবর্তী বৈঠকে নেওয়া হবে।
তবে বাংলাদেশ এবং ভারতের অধিকাংশ বিশেষজ্ঞই মনে করছেন এই সিদ্ধান্ত দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের উপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলবে।
উল্লেখ্য, অতি সম্প্রতি থাইল্যান্ডে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস। অনেকেই মনে করেছিলেন, ওই বৈঠকের পর সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের সম্পর্কে যে অবনতি ঘটেছে, তার কিছুটা হলেও উন্নতি হবে। কিন্তু ভারতের এই পদক্ষেপ পরিস্থিতি আবার আগের জায়গায় নিয়ে যাবে বলেই মনে করছে কূটনৈতিক মহলের একাংশ।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক অভ্র ঘোষ ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''ভারতের এই পদক্ষেপ যে ইতিবাচক নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে এর প্রভাব দুই দেশের সম্পর্কে কতটা পড়বে তা বুঝতে আরো কিছুটা সময় লাগবে।'' তার মতে, বাংলাদেশ এরপর দু'টি পথ নিতে পারে। এক, তারা ভারতের বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ নেবে অথবা আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের রাস্তা খুঁজবে। বাংলাদেশ কোন পদক্ষেপ নেয়, তার উপর নির্ভর করবে পরবর্তী কূটনৈতিক সম্পর্ক।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আইনুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''নেপাল, ভুটান এবং মিয়ানমারে আমাদের বাণিজ্যের পরিমাণ খুব বেশি নয়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে ভারতের এই পদক্ষেপ আমাদের বাণিজ্যে প্রভাব ফেলবে। আমরা কম পয়সায় এবং কম সময়ে বাইরে জিনিস পাঠাতে পারতাম ভারতের বন্দর ব্যবহার করে। বিশেষ করে তৈরি পোশাকের ব্যবসায় আমাদের বিশেষ সুবিধা হতো।'' অধ্যাপক আইনুল ইসলাম মনে করেন, এর প্রভাব যতটা অর্থনৈতিক তার চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক। ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে এই বিষয়টি প্রভাব ফেলবে বলে তিনি মনে করছেন। অধ্যাপক আইনুল মনে করেন, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এর সমাধানসূত্র খুঁজে বার করা দরকার। বাংলাদেশ পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।
ওপি জিন্দল বিশ্ববিদ্য়ালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত অধ্যাপক আইনুল ইসলামের সঙ্গে সহমত। তিনিও মনে করেন ভারতের পদক্ষেপ রাজনৈতিক। ডয়চে ভেলেকে তিনি জানিয়েছেন, ''ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে যে টানাপড়েন চলছে, এই ঘটনা তার আরো একটি উদাহরণ। উত্তর-পূর্ব ভারত নিয়ে মুহাম্মদ ইউনূস চীনে যে মন্তব্য করেছিলেন, ভারতের এই পদক্ষেপ তার পরিপ্রেক্ষিতে হলে অবাক হবো না ।'' শ্রীরাধা অবশ্য মনে করেন, ভারতের বন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশের যে বিরাট উপকার হচ্ছিল, এমন ভাবার কারণ নেই।
বিজিএমইএ এর সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. শহীদুল্লাহ আজিম ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''বরফ না গলা পর্যন্ত আমাদের একটি বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তবে এই সমস্যাটি যতটা অর্থনৈতিক তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক বলে আমি মনে করি।'' শহীদুল্লাহ জানিয়েছেন, আলোচনার মাধ্যমে দুই দেশের একটি সমাধানসূত্র খুঁজে বার করা দরকার। নইলে কূটনৈতিক সম্পর্কে দূরত্ব বাড়তেই থাকবে। রাগারাগি করে সমস্যার সমাধান হবে বলে তিনি মনে করেন না।
চলতি পরিস্থিতিতে ভারতের ব্যবসায়ীরাও একই ভয় পাচ্ছেন। বিশেষ করে সীমান্ত অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের ভয়, এরপর বাংলাদেশও এমন কোনো পদক্ষেপ নিলে তাদের ব্যবসা মার খাবে। ইন্দো-বাংলা চেম্বার অফ কমার্সের গৌহাটি বিভাগের ডিরেক্টর আতোয়ার রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''উত্তর-পূর্ব ভারতের একাধিক বন্দর দিয়ে বাংলাদেশের জিনিস ভারতে ঢোকে এবং তারপর অন্য দেশে চলে যায়। ভারতের এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের বাণিজ্যে বড় প্রভাব ফেলবে। এখন বাংলাদেশও যদি তাদের বন্দরগুলি ভারতের জন্য বন্ধ করে দেয়, তাহলে আমরাও সমস্যায় পড়বো। ঘুর পথে রপ্তানি করতে হবে।'' আতোয়ার রহমানও মনে করেন, আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।