‘বৈবাহিক ধর্ষণ' অপরাধ নয়, সামাজিক ব্যার্থতার আয়না
৩০ মে ২০২৫২০১৭-র ডিসেম্বরে ছত্তিসগড়ের বাস্তারে ছিন্ন ভিন্ন শরীরে হাসপাতালে ভর্তি হন বছর ৩০-এর এক নারী। শারীরিক আঘাতের অভিঘাত সহ্য না করতে পেরে কিছুদিনের মধ্যেই মৃত্যু হয় তার। মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতে তিনি বলেন, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বামী নৃশংসভাবে ধর্ষণ করেছেন তাকে। অস্বাভাবিক যৌনক্রিয়ায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে তার যৌনাঙ্গ এবং পায়ুদ্বার। পুলিশের দ্বারস্থ হন মৃতার বাবা। স্বামীর বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা (অস্বাভাবিক যৌনক্রিয়া), ৩৭৬ (ধর্ষণ) এবং ৩০৪ (অনিচ্ছাকৃত খুন) ধারা মামলা হয়। নিম্ন আদালত তাকে ১০ বছরের কারাদণ্ডের সাজা দেয়।
২০২৫-এর ফেব্রুয়ারিতে ছত্তিসগড় হাইকোর্টের বিচারপতি নরেন্দ্র কুমার ব্যাস বেকসুর মুক্তি দেন স্বামীকে। রায়ে বলা হয়, ভারতীয় আইনে স্ত্রীয়ের বয়স ১৫-র বেশি হলে তার সঙ্গে যৌন সম্পর্ককে ধর্ষণ বলা যায় না। এদেশে অস্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক বা সম্মতির কোনো আইনি স্বীকৃতি নেই, এ কথাও বলা হয়।
স্বামীর দ্বারা ধর্ষণ ফৌজদারি অপরাধ নয়
ভারতবর্ষে বৈবাহিক ধর্ষনের কারণে স্বামীর সাজা না পাওয়া কোনো বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়। স্বাধীনতার ৭৭ বছর পরেও এদেশে স্বামী স্ত্রীকে ধর্ষণ করলে তাকে ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য করা হয় না। সম্প্রতি, সুপ্রিম কোর্টে বৈবাহিক ধর্ষণকে ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য করার পক্ষে একটি আবেদনের বিরোধিতা করেছে দেশের সরকার। ২০২৪-এর অক্টোবরে আদালতকে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয় একে ফৌজদারি অপরাধের পরিধিতে আনলে তা 'অত্যন্ত কঠোর' হয়ে যাবে যা দাম্পত্যে প্রভাব ফেলতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে আরো বলা হয়, এর ফলে 'পবিত্র বৈবাহিক বন্ধন' ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এমনকি, এর ভুল ব্যবহারও হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। স্বামী স্ত্রীকে বলপূর্বক ধর্ষণ করলে কেন সেই একই 'পবিত্র বন্ধন' ক্ষতিগ্রস্ত হবে না তার কোনো সদুত্তর অবশ্য কোনো সরকারই দেয় না।
যে কাজ অন্য যে কেউ করলে তাকে অপরাধী শনাক্ত করে শাস্তি দেয় দেশের আইন, সেই একই অপরাধ স্বামী করলে তার শাস্তি হবে না কেন? ভারতবর্ষে স্ত্রীর উপর স্বামীর শারীরিক অত্যাচারের ঘটনা অহরহ ঘটে চলেছে। সরকারের সাম্প্রতিক এক পরিসংখ্যানে, স্বামীর দ্বারা নিগৃহীত হন প্রায় ২৬ দশমিক নয় শতাংশ মহিলা। এই অবস্থায় বৈবাহিক ধর্ষণকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে কেন স্বীকৃতি দেওয়া যাবে না, তার ব্যাখ্যা স্বাভাবিকভাবেই লুকিয়ে আছে দেশের মজ্জাগত পুরুষতন্ত্রের ছায়ায়। একটু ব্যাখ্যা করা যাক।
বিয়ের পবিত্রতা এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজ
ভারতীয় সংস্কৃতিতে 'বিবাহ বন্ধনের' পবিত্রতার মধ্যে সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে পুরুষতান্ত্রিকতার ছায়া। পণ বিনিময় আইনত দণ্ডনীয় হলেও বাস্তবে এখনো বিরাজমান। কন্যাদান, কনকাঞ্জলি, ইত্যাদি আচারে নারীকে সম্পত্তি সমতুল্য করে রাখা হয়েছে। কন্যাদান কার্যত একটি হস্তান্তর আচার যার মাধ্যমে নারী বাবার হাত থেকে স্বামী হেফাজতে যায়। এহেন পরিমণ্ডলে ধরেই নেওয়া হয় স্ত্রী স্বামীরই সম্পত্তি। তার শরীরের উপর তার থেকেও বেশি অধিকারী তার স্বামী। সেক্ষেত্রে, স্ত্রী-এর সম্মতির প্রশ্নটি সম্পূর্ণভাবে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করা সমাজ।
এমনিতেই সম্মতি, ব্যক্তিগত পরিসরের মতো ধারণাগুলি উপমহাদেশের প্রেক্ষিতে এখনো অচল। বড় শহরের বিশ্বদর্শনে খানিকটা চর্চায় এলেও ভারতের বিশাল পরিধিতে তা প্রায় নেই বললেই চলে। যে শিশু ছোটবেলা থেকেই সাধারণভাবে ব্যক্তিগত পরিসরের ধারণা ছাড়াই বড় হয়, বিয়ের পর তার নিজের শরীরের উপর অধিকার জন্মাবে কেমন করে? অন্যদিকে, যে শিশু ছোটবেলা থেকেই জেনে এসেছে নারী মাত্রেই তার অধীন, সে স্বামী হয়ে তার অন্যরকম ভাবা প্র্যাকটিস করবেই বা কেন? বরং সে নারীর উপর শক্তি প্রয়োগ করে নিজের অধীনে রাখার মধ্যে একটা একটা 'পাওয়ার ট্রিপ' নিতে শিখবে। এক্ষেত্রে সম্মতি কেন, সম্মানের সিকিভাগও খরচ করবে না এদেশের পৌরুষ।
তাছাড়া, এদেশে বিয়ের বন্ধনকে পবিত্র বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। দাম্পত্য জীবনে সামাজিক আচার প্রবেশ করলেও, আইন সচরাচর প্রবেশাধিকার পায় না। ন্যাশানাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে পাঁচের রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৮ থেকে ৪৯ বছরের বিবাহিত মহিলাদের ৩২ শতাংশ নারী স্বামীর হাতে নিগৃহীত হন। কেবলমাত্র মারধর নয়, এর মধ্যে আছে যৌন অত্যাচার, ধর্ষণের অভিযোগও। তদন্ত, বিচার প্রক্রিয়া তো অনেক পরের ব্যাপার, এদের মধ্যে মাত্র ২৯ শতাংশ নারী পুলিশের কাছে যান। বাড়ির অন্তরমহলে চাপা পরে থাকে প্রায় তিন চতুর্থাংশেরও বেশি অভিযোগ। আবার ধর্ষণের অভিযোগ দাখিলযোগ্য না হওয়ায় অনেকক্ষেত্রেই তা গার্হস্থ হিংসার নামে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানানো হয়।
শরীরের অধিকার
বিয়ে দুটি জীবনকে, এমনকি দুটি পরিবারকেও সামাজিকভাবে কাছাকাছি এনে দেয়। এই পারস্পরিকতায় ব্যক্তিগত পরিসর, পরিধি বা সম্মতির মতো স্বাভাবিক দৈনন্দিন জীবনের বোঝাপড়াগুলির পরিবর্তন হওয়ার কথা নয়। আমার শরীর আমারই। তার ভালো থাকা, খারাপ থাকা, ইচ্ছে-অনিচ্ছেগুলি নিজের মতো করে আমারই থাকে। তার উপর জোর করা যায় না। নারী হোক বা পুরুষ, অসম্মতিতে শরীরের উপর অধিকার হস্তান্তরিত হয় কী করে?
অ্যামেরিকা, ইউরোপসহ পৃথিবীর বহু দেশেই বৈবাহিক ধর্ষণকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। বিশ্বের এগিয়ে থাকা দেশগুলি বাদ দিলেও, সাম্প্রতিককালে একে অপরাধ বলে মেনে নিয়েছে জিম্বাবোয়ে, তুরস্ক, ঘানা, নেপালের মতো অর্থনৈতিক ভাবে উন্নয়নশীল দেশগুলিও। বিয়ের পবিত্রতা এই দেশগুলিতে অপরাধীকে আড়াল করতে বর্ম হিসেবে ব্যবহার হয়না। নারীর শরীরের উপর অধিকার একেবারেই তার -- এটা মেনে নিতে পৌরুষে আটকায় না এই দেশগুলির সমাজের।
সারা বিশ্বে দক্ষিণপন্থি রাজনীতির উত্থানের সঙ্গে নারী বিদ্বেষের বাড়বাড়ন্ত অস্বাভাবিক নয়। বিভিন্ন দেশে নারীবাদী, সমানাধিকার কর্মীদের উপর আক্রমণ বেড়েছে বহুগুণ। ভারতের ক্ষেত্রে প্রাচীন সনাতনী মূল্যবোধের সঙ্গে এই নব্য নারীবিদ্বেষ মিশে তৈরি হয়েছে এক অভূতপূর্ব ককটেল। সেই কারণে বিয়ের পরে ধর্ষণের মতো ঘটনা শহরাঞ্চলের শিক্ষিত উচ্চমধ্যবিত্ত পরিসরেও কিছু কম নয়। গ্রাম থেকে শহর, উচ্চবিত্ত থেকে সাধারণ খেতে খাওয়া মানুষ -- জাতি ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি নির্বিশেষে নারীর প্রতি ন্যূনতম সম্মান, তার সম্মতিকে সম্মান না জানানো আমাদের সমাজে দস্তুর হয়ে গেছে। বৈবাহিক ধর্ষণকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়ে বারবার আইন আদালতের দরজায় ধাক্কা দিয়েছেন সমাজকর্মীরা। এখনো সদুত্তর মেলেনি। এতদিনেও, একবিংশ শতাব্দীতেও মেলেনি। জিডিপিতে ভারত জাপানকে টপকে চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতি হল কি না, সেই আলোচনার মধ্যে আমরা এই মানবাধিকারের ব্যর্থতার ইতিহাসগুলো যেন ভুলে না যাই।