’বৈবাহিক ধর্ষণ’ : বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার নারী, পুরুষ যা ভাবছেন
‘ম্যারিটাল রেপ’ অর্থাৎ ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি, পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছে ডয়চে ভেলে৷ ছবিঘরে বিস্তারিত...
পক্ষে-বিপক্ষে কথা হলে আইন তৈরি ও সংজ্ঞায়িত করা সহজ হবে: কামরুন নাহার, সদস্য, নারীপক্ষ
‘‘বিবাহের পর যৌন সম্পর্ক স্থাপনে জোরজবরদস্তির মতো ‘অপরাধটি’ যেন বেড়ে না যায় এবং নারী-পুরুষ সকলেই আইনের সহায়তা পায় সেই কারণেই সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পক্ষে-বিপক্ষে তো কথা হবেই এবং হওয়া উচিত বলেও মনে করি।এতে আইন তৈরি করা এবং সম্মতি ও ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’কে সংজ্ঞায়িত করা সহজ হবে। কোন প্রেক্ষিতে এটিকে অপরাধ ধরা হবে তার ব্যাখ্যায় বয়স নির্ধারণ করা আছে।’’
বিবাহ মানেই সম্মতির অধিকার কেড়ে নেওয়া নয় : পিয়া জান্নাতুল, আইনজীবী
‘‘সংবিধানের ২৭ নম্বর ধারায় বলা আছে সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। ৩২ নম্বর ধারায় ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার কথা বলা হয়েছে। বিবাহ মানেই তো সম্মতির অধিকার কেড়ে নেওয়া নয়। বিয়ের আগে একজন নাগরিকের যেসব অধিকার থাকে, বিয়ের পরও ঠিক তাই থাকে। এই অধিকার রক্ষা করতে না পারলে তা সংবিধানের সঙ্গেও অসঙ্গতিপূর্ণ।আধুনিক যুগে দেশের 'বৈবাহিক ধর্ষণ' নিয়ে সরাসরি আইন না থাকা হতাশার।’’
বৈবাহিক ধর্ষণ ও সম্মতির গুরত্ব নতুন প্রজন্ম কিছুটা বুঝতে পারছে : জাওয়াদ বিন মিজান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাওয়াদ বিন মিজান বলেন, ‘‘বন্ধু ও সমসাময়িক পরিচিতজনদের মধ্যে এই বিষয়গুলো নিয়ে কিছুটা কথা হয়। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখি তরুণ প্রজন্মের অনেকেই আলোচনা করেন। সম্পর্কে থাকলেই সব কিছু স্বাভাবিকভাবে অনুমতিপ্রাপ্ত- এই ধারণায় কিছুটা বদল এসেছে বলে মনে হচ্ছে। ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ বিষয়টি খুবই সংবেদনশীল। তাই নারী ও পুরুষ উভয়রই এ বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করা উচিত।’’
'ম্যারিটাল রেপ' পরিভাষাটি বলা বাদ দিয়ে বরং নারীর অধিকার রক্ষার আলাপ করা উচিত: মীর হুযাইফা, গবেষক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসা থেকে শিক্ষাজীবন শেষ করা এবং বর্তমানে গবেষক হিসেবে কর্মরত মীর হুযাইফা বলেন, ‘‘হাদিসের আলোকেই বিবাহ পরবর্তী প্রতিবার মেলামেশায় দুজনেরই সম্মতির প্রয়োজন আছে। দেশে বিবাহ পরবর্তী সহিংসতার হার বেশি। নারীরা এ বিষয়ে কথা বলতে ভয় পান। তাই সামাজিক আলাপ ওঠা উচিত। তবে ‘ম্যারিটাল রেপ’ বা ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ পরিভাষাটির পরিবর্তে নারীর অধিকার রক্ষা- এভাবে আলোচনা জরুরি।’’
‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা বড় একটি জনগোষ্ঠীর কাছে ট্যাবু : জুবায়দুল হক রনি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জুবায়দুল হক রনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দেশে ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’-এর ফলে নারী মৃত্যুর মতো ঘটনাও ঘটছে। কিন্তু তবুও ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা বড় একটি জনগোষ্ঠীর কাছে ট্যাবু। বিষয়টিকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে আইন করা হলে সে আইন শুধু নারীর জন্য নয়, পুরুষের জন্যও হবে। কোনো পুরুষ যদি ‘বৈবাহিক ধর্ষণের’ শিকার হন, তাহলে তিনিও আইনের সহায়তা নিতে পারবেন। ’’
সেই ক্ষত ও ট্রমা দীর্ঘ বছরেও ভুলতে পারিনি : ভুক্তভোগী নারী
বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার এক ভুক্তভোগী নারী বলেন, ‘‘নিজের পছন্দে বিয়ে করলেও বিয়ের রাতেই স্বামীর জোরজবরদস্তির শিকার হয়েছি। এটিকে যে ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ বলে সেটাও জানতাম না। কিন্তু বহুবার একই ধরনের ঘটনা ঘটার পরে বুঝতে পারলাম,পরিবারকে জানালেও সবাই সংসার চালিয়ে যাওয়ার জন্য চাপ দেন। অনেক সহ্য করার পর সে সম্পর্ক থেকে তালাক দিয়ে বেরিয়ে আসি। কিন্তু সেই ক্ষত ও ট্রমা দীর্ঘ বছরেও ভুলতে পারিনি।’’
অনেক নারী ও পুরুষের কাছেই ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’-এর অস্তিত্ব নেই : নওশিন নাবিলা, চাকরিজীবী
চাকরিজীবী নওশিন নাবিলা বলেন, ‘‘পরিবার থেকেই নারীদের শিখানো হয় স্বামীকে খুশি রাখতে হবে। এই প্রথাগত ধারণা থেকে এ সময়ে এসেও নারীরা বের হতে পারেননি। আর বেশির ভাগ পুরুষও এর বাইরে ভাবতে চান না। তাই ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’-এর অস্তিত্ব অনেক নারী ও পুরুষের কাছেই নেই। কোনো নারী তার অধিকার নিয়ে কথা বললেই সে খুব নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ‘নারীবাদী’ বলে বিবেচিত হন।’’
পুরুষ তার চাহিদাই শুধু বোঝে : মাসুদা, সুপারশপের কর্মী
একটি সুপারশপের কর্মী মাসুদা বলেন, ‘‘পুরুষরা শুধু নিজের চাহিদা বোঝে। স্ত্রীর শরীর খারাপ, ব্যথা বা পিরিয়ড কোনো কিছুই তারা বুঝতে চায় না। স্বামীর সঙ্গে প্রায়ই এ নিয়ে ঝগড়া হয়। আমি যে ছোট বাড়িতে ভাড়া থাকি, সেখানে প্রায় সব মেয়েই একই কষ্টের কথা বলে। আইন হলে নারীদের সাহায্য নেওয়া উচিত, কিন্তু পরিবার, সমাজ কী বলবে। টাকা না থাকলে সে নারী কী খাবে, সন্তানদের নিয়ে কোথায় যাবে।’’
বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে অনেক কিছুই মানতে হয়েছে : সুলতানা, গৃহকর্মী
সুলতানা পেশায় গৃহকর্মী৷ তিনি জানান, ‘‘বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে অনেক কিছুই মানতে হয়েছে। এখন আর স্বামী কোনো কিছু নিয়া জোরাজুরি করে না। আমার অমতে শারীরিক সম্পর্ক করে না। বয়স কম থাকতে তো বুঝতে চায় না। সারা দিন পরিশ্রম করলে মন না-ই চাইতে পারে। বিয়ের পর নিজের মায়ের কাছেও কিছু বলা যায় না। স্বামীর সম্পর্কে কিছু বলাও তো ভালো না।’’
কোনো আলোচনা ছাড়া কণ্ঠরোধ সমর্থন করি না : কামরুল হাসান, উদ্যোক্তা ও চলচ্চিত্রকার
উদ্যোক্তা ও চলচ্চিত্রকার কামরুল হাসান বলেন, ‘‘বৈবাহিক সম্পর্কে অধিকার আছে, কিন্তু ধর্ষণ বলে কিছুই নেই- এমন ধারণা অনেক নারী ও পুরুষের। তাই এই বিষয়ে আলোচনা হলে, আইন হলে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই ভালো, যদিও আইনের ভুল ব্যবহার যেন না হয় সে ব্যবস্থা নিতে হবে। তা নিয়ে আলাপ হওয়াও জরুরি। কিন্তু কোনো আলোচনা ছাড়া কণ্ঠরোধ সমর্থন করি না। বিশ্বের অনেক দেশেই বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে আইন হয়েছে।’’
পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ ও সম্মতি শিক্ষা নিয়ে আলোচনার সুযোগ নেই : নিফাত সুলতানা, শিক্ষার্থী
শিক্ষার্থী নিফাত সুলতানা মনে করেন, ‘‘পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বৈবাহিক ধর্ষণ ও সম্মতি শিক্ষা নিয়ে আলোচনার সুযোগ নেই।’’ ডয়চে ভেলেকে তিনি আরো বলেন, ‘‘বেশির ভাগ ছেলে বন্ধু এ বিষয়ে কথা বলতে লজ্জা বোধ করেন। তবে কিছু বন্ধু স্বাভাবিকভাবেই আলোচনা করেন। তাই মেয়ে বন্ধুরা নিজের মধ্যে আলাপ করি, বিবাহিত বান্ধবীদের থেকে জানার চেষ্টা করি।’’
বৈবাহিক ধর্ষণ ও সম্মতির বিষয়ে বিবাহিত ও অবিবাহিত সবারই কথা বলা উচিত : তাসফিয়া ফাইরোজ আনান, শিক্ষার্থী
শিক্ষার্থী তাসফিয়া ফাইরোজ মনে করেন বিবাহিত নারীদের অনেকেই চুপ থাকাতে বৈবাহিক ধর্ষণের মতো বিষয়টি আলোচনায় আসছে না৷ তিনি বলেন, ‘‘সম্মতির বিষয়টি প্রতিটি সম্পর্কেই জরুরি, সে সম্পর্ক বৈবাহিক হোক বা না হোক। একজন মানুষ হিসেবে নিজের শরীর ও সম্মতির অধিকার সবারই থাকা উচিত। এই বিষয়ে কেবল ভুক্তভোগী না, বরং আমাদের সবার, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের খোলাখুলি কথা বলা উচিত, যাতে সচেতনতা বাড়ে এবং সমাজে পরিবর্তন আসে।’’
স্বামীর ডাকে স্ত্রীকে সাড়া দিতে হবে: মাওলানা কারী রওশন আরা নূরী, প্রিন্সিপাল, ইসলামী মিশন মহিলা কামিল মাদ্রাসা
তিনি বলেন, ‘‘কোরআনের আয়াতে বলা হয়েছে, ‘স্বামী-স্ত্রী একে অপরের লেবাস (পোশাক) স্বরূপ৷ আরেকটি আয়াতে বলা হয়েছে, যখন তোমার স্বামী ডাকবে, তখন তুমি তার ডাকে সাড়া দেবে৷ এটা হলো ফরজ৷ স্বামী ডাকলে সাড়া দিতে হবে৷ কিন্তু স্ত্রীর কোনো শারীরিক বা মানসিক অসুস্থতা থাকলে সে অনিচ্ছা প্রকাশ করলে স্বামীকে সেটা বিবেচনা করতে হবে৷ প্রয়োজনে একসাথে বসে আলোচনা করে নেবে। কিন্তু স্বামীর ডাকে স্ত্রীকে সাড়া দিতে হবে।''