বৈজ্ঞানিক তথ্যকে দৃশ্যমান করে তোলেন যে শিল্পী
১৩ জানুয়ারি ২০২৩আমস্টারডাম শহরের উপকণ্ঠে পুরানো এক কাগজের কারখানায় টাইস বিয়ারস্টেকার আড়ম্বরহীন বৈজ্ঞানিক তথ্য দিয়ে শিল্প সৃষ্টি করছেন৷ প্রযুক্তি ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের এক টিম তাঁকে সেই কাজে সহায়তা করে৷
তারা শুধু কনসেপ্ট ও ভিসুয়াল ডিজাইন নিয়েই ব্যস্ত থাকেন না, প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বাস্তবায়নের পথও তাদের সুগম করতে হয়৷ জলবায়ু সংকটের চ্যালেঞ্জই এই কর্মকাণ্ডের মূল প্রেরণা৷ বিয়ারস্টেকার বলেন, ‘‘বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হতাশা থেকেই সেটা শুরু হয়৷ কোনো বিজ্ঞানীর গবেষণাপত্র পড়ার সময় মনে হয়, কেন আমি এটা আগে জানতাম না? আমার জানা উচিত, গোটা বিশ্বের সেটা জানা উচিত৷ তখন বোধ হয় আমার মস্তিষ্ক সৃজনশীল পর্যায়ে চলে যেতে শুরু করে৷ সেই সঙ্গে বৈজ্ঞানিক চেতনাও কাজ করে৷ সেই দুই ক্ষেত্র এক হয়ে একটি আকার নেয়৷ আমরা তথ্য ও গবেষণাপত্রগুলিকে আর্ট ইনস্টলেশনে রূপান্তরিত করি, যা সে বিষয়ে মানুষের অনুভূতি জাগিয়ে তোলে৷’’
‘ধীরে ধীরে উধাও' নামের সর্বশেষ প্রকল্পের জন্য টাইস এমন কৃত্রিম গাছের পাতা সৃষ্টি করছেন, যেগুলির সারফেস কখনো স্বচ্ছ হয়, কখনো হয় না৷ টাইস বিয়ারস্টেকার নিজের ইনস্টলেশনের রহস্য ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘‘কাগজের মধ্যে ক্রিস্টালের অবস্থা বেশ এলোমেলো৷ কিন্তু বিদ্যুৎ চালু করলে, ভেতর দিয়ে শক্তি চলে গেলে সেগুলি সোজা ও স্বচ্ছ হয়ে যায়৷’’
একটি শিল্পকর্ম রেন ফরেস্টের ধ্বংসলীলা তুলে ধরছে৷ প্রতি সেকেন্ডে এই আদি অরণ্য কতটা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে, সেটি তা স্পষ্ট করে তুলছে৷ টাইস বিয়ারস্টেকার বলেন, ‘‘প্রত্যেকটি দৃশ্যমান পাতা উধাও হয়ে যাচ্ছে, স্বচ্ছ হয়ে যাচ্ছে এবং ফিরে আসছে, যা রেন ফরেস্টের ১২৮ বর্গ মিটার অংশ ধ্বংসের বার্তা বহন করছে৷ অর্থাৎ এই মুহূর্তে মিনিটে দশটি করে ফুটবল মাঠের মাপের রেন ফরেস্ট উধাও হয়ে যাচ্ছে৷’’
বিজ্ঞানীরা ইউনেস্কোর সঙ্গে সহযোগিতার মাধ্যমে সেই তথ্য সংগ্রহ করেছেন৷ টাইস বিয়ারস্টেকার সেই বাস্তব দৃশ্যমান করে তুলছেন৷ একটি সিগারেটের টুকরো দিনে ৫০০ লিটার পানি দূষণ করে৷ প্রতি বছর এক কোটি টনেরও বেশি প্লাস্টিক সমুদ্রে জমা হয় এবং এক মেগাবাইট ডেটা ২০ গ্রাম কার্বন-ডাই-অক্সাইড সৃষ্টি করে৷
টাইস বিয়ারস্টেকার ও তার টিম কোনো প্রোটোটাইপ তৈরি করার আগে বিজ্ঞানীদের সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা করেন৷ নেদারল্যান্ডসের এই শিল্পী নিজে ডেলফ্ট ও আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন৷ তিনি তাঁর অনেক কনসেপ্ট এমনভাবে পরিকল্পনা করেন, যাতে সেগুলি বিভিন্ন আকার-আয়তনে তৈরি করা যায়৷ বিয়ারস্টেকার জানালেন, ‘‘আমাদের প্রোটোটাইপ পর্যায় অত্যন্ত জোরালো৷ স্টুডিওয় প্রথম বার সেই রূপায়নই সেরা সময়৷ তাতে কাজ হলে খুশি হই৷ আপনি সহমর্মিতা অনুভব করলে অথবা বিষয়টি স্পষ্ট করে তোলা গেলে সেই মুহূর্তে আমাদের সবার উপলব্ধি হয় যে আমরা উচিত কাজই করছি৷’’
গাছপালা কি কিছু বলতে চাইছে? সেগুলি নিজেদের মধ্যে কীভাবে আদানপ্রদান করে? আমাদের কাছেই বা কোন্ তথ্য পাঠায়?
একাধিক সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে টাইস বিয়ারস্টেকার এই সব প্রশ্নের নানা দিক তুলে ধরছেন৷ আর্নেম শহরে ডাচ মিউজিয়ামেও এমন দৃষ্টান্ত শোভা পাচ্ছে৷ যেমন একটি ইউরোপীয় বিচ গাছ কেমন বোধ করছে, সেই অনুভূতি তিনি ‘লাইভ' পদ্ধতিতে দৃশ্যমান করে তুলছেন৷ ১২টি সেন্সর কার্বন-ডাই-অক্সাইডের চাপ, আর্দ্রতা ও আলোর মতো বিষয়ের উপর নজর রাখছে৷ তিনি সেই সব তথ্য রিং-এর মাধ্যমে দৃশ্যমান করে তুলছেন৷ গাছের গুঁড়ির বাৎসরিক বলয়ের পাশাপাশি সেটি গাছ সম্পর্কে সরাসরি তথ্য দিচ্ছে৷ টাইস বিয়ারস্টেকার বলেন, ‘‘আপনারা এখানে যা দেখছেন, তার মধ্যে কয়েকটি একেবারে নিখুঁত৷ কারণ আজকের আবহাওয়া একেবারে আদর্শ৷ তবে কয়েকটি বেঁকে যাচ্ছে, কারণ এলাকায় একটি যানজটের কারণে কার্বন নির্গমন তুঙ্গে উঠেছে৷ অথবা এখানকার মাটিতে হয়তো পানির অভাব রয়েছে৷’’
এভাবে সাফল্য পাওয়া যাবে কিনা, নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে টাইস বিয়ারস্টেকার সেটা দেখাতে পারেন৷ কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলে প্রকৃতি আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে কিনা, একটি রোবট উদ্ভিদ তা দেখিয়ে দিচ্ছে৷ সেই শিল্পকীর্তি যেন বেড়ে চলা আশার আলোর প্রতিক হয়ে উঠেছে৷
হেনড্রিক ভেলিং/এসবি