বেতন-বোনাস না পেলে ঈদে পোশাক শ্রমিকদের ভুখা মিছিল
২৮ মার্চ ২০২৫শনিবারও বেতন-বোনাস না পেলে ঈদের দিনে ভুখা মিছিল করবেন এখনো প্রাপ্য না পাওয়া পোশাক শ্রমিকরা৷
তবে শনিবারও সব শ্রমিক বেতন-ভাতা না পেলে শ্রমিক অসন্তোষ বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে৷ কারণ, ব্যাংক বন্ধ হলে ঈদের আগে বেতন-ভাতা পরিশোধের সুযোগ থাকবে না।
গাজীপুরের টিএনজেড গ্রুপের পোশাক শ্রমিকরা ঈদের আগে বেতন-বোনাসের দাবিতে ঢাকায় শ্রমভবনের সামনে অস্থান করছেন গত কয়েকদিন ধরে। মালিক পক্ষ তাদের সবাইকে এক কোটি টাকা ভাগ করে দেয়ার কথা বলছে, কিন্তু তাদের পাওনা সাত কোটি টাকারও বেশি। তারা যদি তাদের পাওনা না পান, তাহলে তাদের অবস্থান চালিয়ে যাবেন এবং ঈদের দিন ভুখা মিছিল করবেন।
ওই গ্রুপের শ্রমিক নেতা শহিদুল ইসলাম বলেন, "টিএনজেড গ্রুপের তিনটি কারখানার তিন হজারেরও বেশি কর্মীর কয়েক মাস ধরে বেতন বকেয়া আছে। এর সঙ্গে আছে বোনাস। এর পরিমাণ ছয় কোটি ৭৫ লাখ টাকা, যার মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র এক কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। বেতন-বোনাস না পেলে সবাই শ্রম ভবনের সামনেই অস্থান চালিয়ে যাবে।”
দেশে বর্তমানে রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানা আছে তিন হাজার ৫৫৫টি। এর মধ্যে বিজিএমইএর সদস্য সচল কারখানার সংখ্যা দুই হাজার ১০৭। বিকেএমইএর সচল সদস্য কারখানা ৬১৩টি। বিজিএমইএর সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ আজিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "কিছু প্রবলেম গার্মেন্টস আছে। তারপরও অধিকাংশ কাখানায় বেতন-বোনাস দেয়া হয়েছে। শনিবারের মধ্যে বাকিগুলোতে হবে। আমরাও সংকটে আছি। ব্যাংক টাকা দেয় না। রপ্তানি কমে গেছে।”
বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেমের দাবি , প্রায় শতভাগ কারখানায় বেতন-বোনাস দেয়া হয়েছে, বাকিগুলোতে শনিবার দেয়া হবে।
বিজিএমইএর প্রশাসক আনোয়ার হোসেন বলেন, পরিদর্শক কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ঈদুল ফিতরের উৎসব ভাতা দেয়া কারখানার সংখ্যা হচ্ছে এক হাজার ৯৯৭, যা মোট কারখানার ৯৪.৭৮ শতাংশ। ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন পরিশোধ করেছে ৯৯.৫৩ শতাংশ বা দুই হাজার ৯৭টি।
গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক জলি তালুকদার বলেন, "সরকার বলছে, প্রায় শতভাগ কারখানায় বেতন-বোনাস দেয়া হয়েছে। কিন্তু আমাদের কাছে যে হিসাব রয়েছে, তাতে ১০ শতাংশেরও বেশি কারখানায় বেতন-বোনাস হয়নি। শনিবারও দেয়ার কথা আছে। শনিবার বিকেল নাগাদ বাস্তব চিত্র পাওয়া যাবে। কারণ, তারপর তো আর বেতন-বোনাস দেয়ার সুযোগ নাই।”
তিনি মনে করেন, শ্রম মন্ত্রণালয় শ্রমিকদের স্বার্থে যথাযথ উদ্যোগ নিলে এমন পরিস্থিতি হতো না, "শ্রম মন্ত্রণালয় আন্তরিকভাবে কাজ করছে না। তারা মালিকের পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। আর বেতন-বোনাসের হিসাব করা হচ্ছে চালু কারখানার হিসাব করে। কিন্তু বাস্তবে বেশ কিছু কারখানা বন্ধ আছে। কয়েকদিন আগেও তিনটি কারখানা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ৫ আগস্টের পর বেশ কিছু কারখানায় ঝামেলা হয়েছে। সেগুলোতেও বেতন-বোনাসের সমস্যা আছে। আর সরকার ১২টি পোশাক কারখানাকে ‘প্রবলেম গার্মেন্টস' হিসাবে চিহ্নিত করলেও এর সংখ্যা কমপক্ষে ১৫০টি।”
গার্মেন্টস মুক্তি আন্দোলনের ইকবাল কবির বলেন, "টিএনজেড গ্রুপেরই তো তিনটি কারখানা আছে। তারা তো পাঁচদিন ধরে শ্রম ভবনের সামনে বেতন-ভাতার দাবিতে অবস্থান করছে। গাজীপুর, আশুলিয়া ও সাভারে আরো বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানায় বেতন-বোনাস হয়নি। তাদের শনিবারের আশায় রাখা হয়েছে। শনিবার যদি তারা শেষ পর্যন্ত বেতন-বোনাস না পান, তাহলে কী হবে?''
বিজিএমইএর সদস্য নয় এরকম আরো কারখানা আছে। সেগুলোতেও সমস্যা আছে বলে জানান তিনি।
গাজীপুর জেলায় মোট পোশাক কারখানাসহ মোট শিল্প কারখানা আছে দুই হাজার ১৭৬টি । এর মধ্যে পোশাক কারখানার সংখ্যা ৭৭৬টি। গাজীপুর শিল্প পুলিশের এসপি এ কে এম জহিরুল ইসলাম বলেন, "মোট শিল্পের মধ্যে ১২১টি কারখানা এখনো বোনাস দেয়নি। তারা শনিবারের মধ্যে দেবে আশা করি। তারা শনিবার কাজ করিয়ে বন্ধ দেবে। তবে মার্চ মাসের বেতন দিয়েছে ৮০ শতাংশ কারখানা। এক হাজার ৪৮৯টি কারখানা শুক্রবার থেকে ছুটি হয়েছে। বাকিগুলো শনিবার কাজ করিয়ে ছুটি দেবে।”
তিনি জানান, "এখানে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমসিসহ আরো শিল্প কারখানা আছে। তাদের মধ্যে পোশাক কারখানায় বেতন-বোনাস পরিশোধের হার ভালো। দুই-তিনটি পোশাক কারখানা নিয়ে জটিলতা আছে৷ তারা এখনো বেতন-বোনাস দেয়নি। শনিবার ব্যাংক খোলা রাখা হচ্ছে। আশা করছি তারা শনিবারের মধ্যে বেতন-বোনাস দিয়ে দেবে।”
তার কথা, "রাস্তায় শ্রমিকরা বেতন-বোনাসের জন্য অবরোধ করে বিক্ষোভ না করলেও টেনশন আছে। আমরা তাই শনিবারের মধ্যে যাতে সবাই বেতন-বোনাস পায়, তার জন্য কাজ করছি। শ্রমিকদের তো বেতন-বোনাস দিতে হবে। তা না হলে তারা বাড়ি যাবেন কীভাবে।”
বিজিএমইএর প্রশাসক ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো-ইপিবির ভাইস-চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, "যেসব কারখানা চালু আছে প্রায় শতভাগ পোশাক কারখানার কর্মীদের বেতন এবং বোনাস দেয়া হয়েছে। আরো একদিন, শনিবার শিল্পাঞ্চলে ব্যাংক খোলা থাকবে, দুই-একটি কারখানায় বাকি আছে। আশা করছি তারাও বেতন-বোনাস শনিবার দিয়ে দেবে।”
"আমরা চেষ্টা করেছি ব্যাংকগুলোকে বলে যাতে ফ্যাক্টরিগুলোকে সাপোর্ট দেয়। ফলে অনেকেই সাপোর্ট পেয়েছে। বেক্সিমকোর সম্পদ বিক্রি করে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধের ব্যবস্থা করেছি। তারপরও টিএনজেড গার্মেন্টসের সমস্যার সমাধান এখনো হয়নি। আশা করি, যে-কোনো উপায়ে শনিবার তাদের বেতন-বোনাসের সমাধান হবে।”
গাজীপুর শিল্প পুলিশের এসপি এ কে এম জহিরুল ইসলাম বলেন, "টিএনজেড গার্মেন্টসের মালিক শুক্রবার সন্ধ্যায় আমাদের সঙ্গে বৈঠক করে মুচলেকা দিয়েছেন। তারা শনিবার ব্যাংক থেকে টাকা ম্যানেজ করে শ্রমিকদের পাওনা দেয়ার চেষ্টা করবে। সেটা না হলে তারা ফ্যাক্টরির মালপত্র ও যন্ত্রপাতি বিক্রি করে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করবে।”
তিনি আরো বলেন, " শ্রমিকদের মোট পাওনা আছে ছয় কোটি টাকার বেশি। আশা করছি শনিবার আংশিক তিন কোটি টাকা তারা পরিশোধ করবে। সেটা হলেও শ্রমিকরা বাড়ি যেতে পারবেন।”
তৈরি পোশাক খাত সংশ্রিষ্টদের অনেকেই মনে করছেন, এই খাতের জন্য শনিবার খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিন। কারণ, এরপর আর বেতন-বোনাস পরিশোধের সুযোগ থাকবে না। গাজীপুর শিল্প পুলিশের এসপি এ কে এম জহিরুল ইসলাম বলেন, "আমাদের মধ্যেও টেনশন আছে। আমরা অব্যাহতভাবে শ্রমিক ও মালিকদের সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছি। এর উদ্দেশ্য হলো, শ্রমিকদের রাস্তায় না নামতে দিয়ে সমস্যার সমাধান করা। আশা করি, শেষ পর্যন্ত কোনো সমস্যা হবে না।''
আর বিজিএমইর প্রশাসক বলেন, "মালিকরা যাতে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করে, তার জন্য তাদের ব্যাংকসহ সব ধরনের সহায়তা করা হয়েছে। মালিকরা যাতে বেতন-ভাতা পরিশোধ না করে দেশের বাইরে চলে যেতে না পারে, সেজন্য কয়েকজনের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞাও দেয়া হয়েছে।”