বেটিং: রাশিয়ার টাকা পেতে গুজরাটে ভুয়া আইপিএল
১২ জুলাই ২০২২গুজরাটের মেহসানা জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম মোলিপুর। সেখানেই রমরমিয়ে চলছিল নকল আইপিএল। আসল আইপিএল শেষ হওয়ার তিন সপ্তাহ পরেই শুরু হয় নকল আইপিএল। উদ্দেশ্য, রাশিয়ায় যারা বেটিং করেন, তাদের অর্থ আত্মসাৎ করা। রাশিয়ার বেটিং চক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে একেবারে নিখুঁতভাবে মোলিপুরে নকল আইপিএলের আয়োজন করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত পুলিশের তৎপরতায় একজন বাদে সব অভিযুক্ত গ্রেপ্তার হয়েছে। যাকে গ্রেপ্তার করা যায়নি, সে রাশিয়ায় আছে।
নকল আইপিএলের পরিকল্পনা
গুজরাটের এই আইপিএলের মূল পরিকল্পনা করেছিল দুই জন, শোয়েব দাবদা এবং আসিফ। শোয়েব রাশিয়ার একটা বার-এ কাজ করত। সে আটমাস সেখানে কাজ করে। ওই পানশালা বেটিংয়ের সঙ্গে জড়িতদের আড্ডার জন্য বিখ্যাত। সেখানেই শোয়েবের সঙ্গে আসিফের পরিচয় হয়। দুজনে মিলে ভুয়া আইপিএলের পরিকল্পনা করে।
পুলিশ জানিয়েছে, আসিফই রাশিয়ার জুয়াড়িদের সঙ্গে কথা বলে। তাদের ক্রিকেট খেলা ও আইপিএলের বিষয়টি বোঝায়। রাশিয়ার জুয়াড়িরা সব জেনেশুনে রাজি হয়ে যায়।
পরিকল্পনা রূপায়ণ
এরপর শোয়েব গুজরাটের মোলিপুরে চলে আসে। সেখানে সে একটি ফার্ম ভাড়া নেয়। সেখানেই তৈরি হয় স্টেডিয়াম ও পিচ। গ্রামের ২১ জন যুবককে ভাড়া করা হয়। প্রতিটি ম্যাচের জন্য তারা প্রত্যেকে চারশ টাকা করে পেতেন। গ্রামের দুইজনকে আম্পায়ার করা হয়। মুম্বই ইন্ডিয়ান্স, গুজরাট টাইটান্স, চেন্নাই সুপার কিংস সহ বিভিন্ন টিমের জার্সি জোগাড় করে শোয়েব। ওই ২১ জন গ্রামবাসীই বিভিন্ন টিমের জার্সি পরে মাঠে নামতেন।
পাঁচটি হাই রেজোলিউশন ক্যামেরা কেনে শোয়েবরা। মাঠের বিভিন্ন জায়গায় ক্যামেরা রাখা হয়। ম্যাচের দিন তা চালিয়ে ইউটিউবে লাইভ খেলা দেখানো শুরু হয়। সেখানে উঁচুমানের ঝকঝকে ছবি আসত। মাঠে দর্শক, তাদের চিৎকার, বাউন্ডারির ধারে বিজ্ঞাপন এবং অন্যান্য জিনিস ডিজিটালি যোগ করা হত।
উত্তরপ্রদেশের মিরাটে একজন ধারাভাষ্যকার হর্য ভোগলের গলা নকল করতে পারে। সেই ধারাভাষ্য দিত, শুনে মনে হতো, হর্ষ ভোগলে বলছেন।
শোয়েবের সঙ্গে এই ভুয়া আইপিএলের আয়োজনে হাত মিলিয়েছিল আরো তিনজন।
রাশিয়া থেকে বেটিং
মস্কো, ভিয়ের, ভোরোনেঝের মতো শহরের মানুষ এই নকল আইপিএলে বেটিং করেছেন। যে ইউটিউব চ্যানেলে খেলা দেখানো হতো তার নাম ছিল আইপিএল। আর একটি মেসেজিং অ্যাপের মাধ্যমে বেটিং হতো।
বেটিংয়ের টাকা আসার পর আম্পায়ারদের ওয়াকি টকিতে নির্দেশ দেয়া হতো, পরের বল চার দিতে হবে, তার পরের বলে ছয়। ব্যাটসম্যান ও বোলারদের কাছে সেই নির্দেশ পৌঁছে দিতেন আম্পায়ার। সেইমতো চার ও ছয় হতো।
পুলিশ জানিয়েছে, রাশিয়ায় যেহেতু ক্রিকেট জনপ্রিয় নয়, আইপিএল সম্পর্কেও তারা খুব বেশি জানতেন না। তাই নকল আইপিএলে বেটিং করেছেন অনেকে।
পুলিশের তৎপরতা
মেহসানা পুলিশের কাছে নকল আইপিএলের খবর আসার পর তারা দুই সপ্তাহ ধরে তদন্ত করে শোয়েব সহ চারজনকে গ্রেপ্তার করে। আসিফ রাশিয়ায় থাকায় তাকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।
প্রতিক্রিয়া
ধারাভাষ্যকার হর্য ভোগলে টুইট করে বলেছেন, ''খবরটা পড়ে শুধু হেসেছি। একবার ওই নকল আইপিএলের ধারাভাষ্য শুনতেই হবে।''
সামাজিক মাধ্যম এই খবর নিয়ে রীতিমতো আলোড়িত। অনেকে টুইট করছেন। কী করে রাশিয়ার মানুষ এই আইপিএলে টাকা ঢেলেছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন করছেন।
ভারতীয় ক্রিকেটে বেটিং বিতর্ক
১৯৯৯-২০০০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সিরিজ চলাকালীন বুকিদের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার সেসময়ের ক্রিকেট অধিনায়ক হ্যান্সি ক্রোনিয়ের কথপোকথন দিল্লি পুলিশের হাতে আসে। সেখানে অর্থের বিনিময়ে ম্যাচ ছেড়ে দেয়ার কথা বলেছিলেন ক্রোনিয়ে। তখন দুই ভারতীয় ক্রিকেটার আজহারউদ্দিন এবং অজয় জাদেজাও অভিযুক্ত হন।
হিন্দুস্তান টাইমস দোহাভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্পোর্টস সিকিউরিটির তথ্য তুলে ধরে জানাচ্ছে, ভারতে বছরে বেআইনি বেটিংয়ের পরিমাণ প্রায় দশ লাখ কোটি টাকা। এই রিপোর্ট ২০১৬ সালের। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান চেম্বারস অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ সরকারকে বেটিংকে আইনসম্মত ঘোষণার অনুরোধ করেছে। তাতে প্রতি বছর সরকারের ১২ থেকে ১৯ হাজার কোটি টাকা আয় হবে।
ভারতে ঘোড়দৌড় ছাড়া অন্য কোনো খেলায় বেটিং করা যায় না। ক্রিকেটেও বেটিং বেআইনি। তাসত্ত্বেও রাজস্থান, তেলেঙ্গানা, মুম্বই, গুজরাট সহ নানা রাজ্য থেকে বেটিং সিন্ডিকেটের খবর মাঝেমধ্যে সংবাদপত্রের পাতায় আসে। চলতি বছরের মে মাসে হায়দরাবাদ থেকে ১০ জনকে ক্রিকেটে বেটিং করার অপরাধে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আইপিএলে গুজরাট টাইটান্স ও কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের খেলায় একটি অ্যাপের মাধ্যমে বেটিং করার দায়ে আটজনকে গ্রেপ্তার করেছিল দিল্লি পুলিশ।
জিএইচ/কেএম(পিটিআই, টাইমস অফ ইন্ডিয়া)