বিশ্বে পরমাণু বর্জ্যের একমাত্র চূড়ান্ত গুদাম ফিনল্যান্ডেত
১৬ অক্টোবর ২০২৩গোটা বিশ্বজুড়ে প্রায় আড়াই লাখ টন অতি তেজস্ক্রিয় পরমাণু বর্জ্য মজুত রয়েছে৷ অনেক জায়গায় সেই বিষ পরিবেশও দূষিত করছে৷ তবে ফিনল্যান্ডে এমনটা ঘটছে না৷ বিশ্বের একমাত্র দেশ হিসেবে ফিনল্যান্ড পরমাণু বর্জ্যের চূড়ান্ত গুদাম নির্মাণ করছে৷
রাজধানী হেলসিংকি থেকে গাড়িতে মাত্র তিন ঘণ্টার দূরত্বে এউরাইয়োকি এলাকায় এক পরমাণু বিদ্যুত কেন্দ্রের পাশেই সেই স্থাপনা গড়ার কাজ চলছে৷ জায়গাটার নাম ‘ওকালো', ফিনিশ ভাষায় যার অর্থ গুহা৷ খনির প্রায় ৪৩০ মিটার গভীরে মাটির নীচে বর্জ্য রাখা হবে৷
আন্টি ইয়ুস্টেন সেখানকার প্রধান ভূতত্ত্ববিদ৷ বিশেষ ভূতাত্ত্বিক গঠনের কারণেই জায়গাটি বেছে নেওয়া হয়েছে৷ জায়গাটির বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘‘পাথুরে এই জমি প্রায় ২০০ কোটি বছর পুরানো৷ প্রায় কোনো ফাটল নেই এবং অত্যন্ত শুকনা৷ এখানে ভূগর্ভস্থ পানির সঞ্চালনও খুবই কম৷''
এউরাইয়োকি পৌর কর্তৃপক্ষ পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও বর্জ্যের চূড়ান্ত গুদামের মালিক কোম্পানির কাছ থেকে প্রতি বছর ভূমি কর বাবদ প্রায় দুই কোটি ইউরো পায়৷ সেখানে মাত্র কয়েক হাজার মানুষ বাস করেন৷ তা সত্ত্বেও নিজস্ব স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বৃদ্ধাশ্রম, লাইব্রেরি ও বেশ কয়েকটি ক্রীড়া কেন্দ্র রয়েছে৷ ৯০ লাখ ইউরো মূল্যের আরো একটি ক্রীড়াকেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে৷
ভেসা ইয়ালোনেন এক সময়ে শিক্ষকতা করতেন৷ ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি সেখানে বাস করছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘স্টুক নামের আমাদের পরমাণু তত্ত্বাবধায়ক কর্তৃপক্ষের প্রতি ফিনল্যান্ডের মানুষের আস্থা রয়েছে৷ মানুষ ইঞ্জিনিয়ারদের দক্ষতার উপর নির্ভর করে৷ তারা সব পরীক্ষা করে দেখেছেন৷ মোটকথা এখানে যা চলছে, সে বিষয়ে আমরা গর্ব বোধ করি৷''
অনেকের কাছে এমন মনোভাব বিস্ময়কর মনে হতে পারে৷ কারণ অতি তেজস্ক্রিয় পরমাণু বর্জ্য তো আর সাধারণ জঞ্জাল নয়৷ সেই বর্জ্যে মূলত ব্যবহৃত পারমাণবিক জ্বালানি রড থাকে৷ লাখ লাখ বছর ধরে তেজস্ক্রিয় থাকায় সেগুলি জীবন বিপন্ন করতে পারে৷
জ্বালানি রড থেকে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ লিক হওয়ার বিপদ এড়াতে সেগুলিকে কড়া নিয়ম মেনে মোড়কবন্দি করতে হয়৷ অনকালোয় সেই কাজ করা হয়৷ পাঁচ সেন্টিমিটার পুরু ও পাঁচ মিটার উচ্চতার তামার ক্যানিস্টারে সেটা ঘটে৷ তারপর সেই আধারগুলি ৪০০ মিটারেরও বেশি গভীরে নামিয়ে দেওয়া হয়৷
গর্তগুলি বেটোনাইট কাদামাটি দিয়ে ভরিয়ে দেওয়া হয়, যা ভূগর্ভস্থ পানি শুষে নিতে পারে৷ কারণ পানি প্রবেশ করলে তামার আধারগুলির ক্ষয় ঘটতে পারে৷ সব শেষে সুড়ঙ্গও একই মাটি দিয়ে ভরাট করা হয় এবং ছয় মিটার পুরু সিমেন্টের স্তর দিয়ে পুরো সিল করে দেওয়া হয়৷ আন্টি ইয়ুস্টেন বলেন, ‘‘এটা আমাদের বর্জ্য রাখার প্রথম সুড়ঙ্গ৷ সেটি সাড়ে তিনশো মিটার দীর্ঘ৷ আমরা এই সুড়ঙ্গে প্রায় ৪০টি ক্যাপসুল রাখতে পারি৷''
কত দ্রুত তামার ক্যানিস্টারে ক্ষয় ঘটতে পারে, সে বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে৷ পরমাণু সুরক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত ফিনল্যান্ডের কর্তৃপক্ষের সূত্র অনুযায়ী, এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো ঝুঁকি নেই৷ তাছাড়া সুরক্ষার অন্যান্য স্তরও রয়েছে৷ প্রধান ভূতত্ত্ববিদ হিসেবে ইয়ুস্টেন বলেন, ‘‘আমরা এত নিশ্ছিদ্রভাবে আমাদের কনসেপ্ট সৃষ্টি করেছি, যে হিসেবে কোনো ভুল থাকলে বা বাইরে থেকে বিঘ্ন ঘটলেও নিরাপত্তার একাধিক বলয় সেই বিপদ দূরে রাখবে৷''
পরমাণু বর্জ্যের চূড়ান্ত গুদাম প্রায় ১০০ বছর ধরে ধাপে ধাপে ভরে তোলা হবে৷ ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত সেটি সম্প্রসারণের ব্যবস্থাও রাখা হচ্ছে৷ তারপর চিরকালের জন্য সেটি সিল করে দেওয়া হবে৷
ইউরোপের অন্যান্য দেশে নিজেদের এলাকায় অতি তেজস্ক্রিয় পরমাণু বর্জ্যের চূড়ান্ত গুদাম গড়ে তোলার বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দেখা যায়৷ এউরাইয়োকিকে সেটা ঘটছে না কেন? উত্তরে আন্টি ইয়ুস্টেন বলেন, ‘‘আমাদের যে পরমাণু বর্জ্যের কোনো ব্যবস্থা করতে হবে, সে বিষয়ে ঐকমত্য রয়েছে৷ আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই সমস্যা ফেলে রাখতে চাই না৷''
এমন মনোভাব নিয়ে ফিনল্যান্ডই বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে অতি তেজস্ক্রিয় পরমাণু বর্জ্য স্থায়ীভাবে মজুত রাখার উদ্যোগ নিচ্ছে৷
কিয়ো ড্যোরার/এসবি