বিশ্বে নিষিদ্ধ ঘোষিত কয়েকটি রাজনৈতিক দল
জনপ্রিয়তা, রাজনৈতিক শক্তি বা শাসনক্ষমতায় ছিল বিশ্বের এমন অনেক মূল ধারার রাজনৈতিক দলই পরে নিষিদ্ধ হয়৷ এদের অনেকের বিরুদ্ধে চরমপন্থা, সহিংসতা, রাষ্ট্রবিরোধিতা, কিংবা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়৷
নাৎসি পার্টি (জার্মানি)
আডল্ফ হিটলারের নাৎসি পার্টি ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জার্মানিতে ক্ষমতায় ছিল৷ হিটলারের নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিস্ট পার্টি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়৷ এই দলটির বিরুদ্ধে হলোকাস্টের মাধ্যমে প্রায় ৬০ লাখ ইহুদি ও অন্যান্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়৷ যুদ্ধ শেষে মিত্র বাহিনী দলটিকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে এবং ১৯৪৫ সালে জার্মানির আইনে নাৎসি প্রতীক, স্লোগান ও কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়৷
জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টি
জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টি বা কেপিডি ছিল একটি প্রভাবশালী মার্কসবাদী দল৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিম জার্মানিতে দলটি সক্রিয় থাকলেও ১৯৫৬ সালে জার্মান কেন্দ্রীয় সাংবিধানিক আদালত দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে৷ নিষেধাজ্ঞার কারণ হিসেবে বলা হয়, দলটির আদর্শ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য হুমকি স্বরূপ এবং এটি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাবে রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতায় যুক্ত৷
ফ্যাসিস্ট পার্টি (ইটালি)
ফ্যাসিস্ট পার্টি ছিল বিশ্বের প্রথম সংগঠিত ফ্যাসিবাদী রাজনৈতিক দল, যার আদর্শ ছিল কট্টর জাতীয়তাবাদ৷ ইটালির স্বৈরশাসক মুসোলিনির শাসনে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ ও গণহত্যা চালানো হয়৷ ১৯৪৩ সালে মুসোলিনির পতনের পর তাকে হত্যা করা হয় এবং ইটালির নতুন সরকার ফ্যাসিস্ট পার্টিকে আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে৷
মুসলিম ব্রাদারহুড
মুসলিম ব্রাদারহুড একটি ইসলামপন্থি রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলন৷ ২০১২ সালের মিশরের গণতান্ত্রিক নির্বাচনে দলটির প্রার্থী মোহাম্মদ মোরসি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন৷ কিন্তু ২০১৩ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মোরসিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়ে দলটিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়৷ পরে ২০২১ সালে অস্ট্রিয়াও এই দলটিকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করে এবং ২০২৫ সালে জর্ডান এর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে৷
বাথ পার্টি (ইরাক)
সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের বাথ পার্টি ছিল আরব জাতীয়তাবাদী ও সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শে বিশ্বাসী একটি দল, যা ইরাকে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় ছিল৷ সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বে দলটি কুর্দি ও শিয়া জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যাপক নিপীড়ন ও গণহত্যার জন্য অভিযুক্ত৷ ২০০৩ সালে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনের পর দলটি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয় এবং সাদ্দাম সরকারের কর্মকর্তাদের রাষ্ট্রীয় পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়৷
ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি
পিকেআই বা ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি এক সময় বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম কমিউনিস্ট দল ছিল এবং ইন্দোনেশিয়ায় এর ব্যাপক গণভিত্তি ছিল৷ ১৯৬৫ সালে একটি ‘সামরিক অভ্যুত্থান চেষ্টার পর’ সরকার তাদেরকে দায়ী করে এবং ব্যাপক দমনপীড়ন চালায়৷ অনুমান করা হয়, এই সময় প্রায় ৫ থেকে ১০ লাখ কমিউনিস্ট সমর্থককে হত্যা করা হয়েছিল৷ পরবর্তীতে সরকার দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে৷
হিজবুত তাহরীর
হিজবুত তাহরীর একটি ইসলামপন্থি দল, যার লক্ষ্য বিশ্বব্যাপী ইসলামিক খেলাফত প্রতিষ্ঠা৷ দলটি নির্বাচন বা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না এবং অনেক দেশে এটিকে উগ্রপন্থার অভিযোগে নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ যুক্তরাজ্য, জার্মানি, রাশিয়া, বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশে দলটিকে নিষিদ্ধ করেছে, কারণ একে রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে বিবেচিত করা হয়৷
ইউক্রেনের কমিউনিস্ট পার্টি
সোভিয়েত যুগের শক্তিশালী দলটি ইউক্রেনের স্বাধীনতার পরেও বেশ জনপ্রিয় ছিল৷ তবে ২০১৪ সালে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর ইউক্রেন ‘ডিকমিউনাইজেশন আইন’ প্রণয়ন করে এবং ২০১৫ সালে দলটিকে নিষিদ্ধ করে৷ সরকার দাবি করে, দলটি রুশপন্থি এবং ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি৷
রেফাহ পার্টি (তুরস্ক)
তুরস্কে রেফাহ পার্টি ছিল একটি ইসলামপন্থি দল৷ তারা ১৯৯০-এর দশকে দেশটিতে উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয়তা অর্জন করে৷ দলের নেতা ছিলেন নেজমেত্তিন এরবাকান এবং পরবর্তীতে এরদোয়ানও এই দলের মাধ্যমে রাজনীতিতে আসেন৷ ১৯৯৮ সালে তুরস্কের সংবিধানিক আদালত দলটিকে নিষিদ্ধ করে কারণ এটি ধর্মীয় আইন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে বলে অভিযোগ আনা হয়৷
গোল্ডেন ডন (গ্রিস)
গোল্ডেন ডন ছিল একটি উগ্র-ডানপন্থি, জাতীয়তাবাদী দল৷ এটি শরণার্থী ও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক কার্যকলাপের জন্য কুখ্যাত৷ ২০১২ সালে দলটি গ্রিক পার্লামেন্টে জায়গা পায়৷ পরে এর নেতারা রাজনৈতিক সহিংসতা, খুন ও অপরাধ সংগঠনের জন্য অভিযুক্ত হন৷ ২০২০ সালে একটি ঐতিহাসিক রায়ে দলটিকে কার্যত নিষিদ্ধ করা হয়৷
জব্বিক (হাঙ্গেরি)
জব্বিক এক সময় হাঙ্গেরির একটি চরম ডানপন্থি দল ছিল, যার আদর্শ ছিল জাতিগত বিদ্বেষ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নবিরোধী অবস্থান৷ যদিও দলটি সরাসরি নিষিদ্ধ হয়নি, তবে ২০১৩-২০১৮ সালের মধ্যে এটি ব্যাপক আইনি ও সামাজিক চাপের মধ্যে পড়ে৷ পরে দলটি তাদের আদর্শ পরিবর্তন করে একটি মধ্যপন্থি দল হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলে৷
কাটালান স্বাধীনতাপন্থি দল (স্পেন)
স্পেনের কাটালুনিয়ার স্বাধীনতার দাবিতে আন্দোলনরত কয়েকটি দল, যেমন সিইউপি বা জুন্টস, ২০১৭ সালে স্পেনের সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে আইনি বাধার মুখে পড়ে৷ যদিও দলগুলো পুরোপুরি নিষিদ্ধ হয়নি, তবে স্বাধীনতা ঘোষণা ও গণভোট করার কারণে কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেফতার ও দলীয় কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়৷
আওয়ামী লীগ
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের৷ সেই অভ্যুত্থানকে রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে দমন করতে গেলে পুলিশের গুলিতে কয়েক শত মানুষ মারা যান৷ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার পরে ২০২৫ সালে এসব হতাহতের ঘটনার বিচার না হওয়া পর্যন্ত দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে৷