বিশ্ব পানি দিবস: নিরাপদ পানি পেতে প্রয়োজন পর্বতের সুরক্ষা
২২ মার্চ ২০২৫বিশ্ব পানি দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত জাতিসংঘের প্রতিবেদনে ক্রমবর্ধমান পানির সংকট, স্যানিটেশন চ্যালেঞ্জ এবং বাস্তুতন্ত্রের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের গভীর প্রভাবের একটি উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।
‘পর্বতমালা ও হিমবাহ: ওয়াটার টাওয়ার’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে পার্বত্য অঞ্চলগুলো আমাদের জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। অথচ এগুলো একেবারেই উপেক্ষিত।
অ্যান্টার্কটিকা বাদে বিশ্বের স্থলভাগের প্রায় ২৪ শতাংশ জুড়ে থাকা পর্বতমালা, বিশ্বব্যাপী বাৎসরিক মিঠা পানির ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ সরবরাহ করে। এগুলো বিশ্বের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নদীর উৎস, যা কৃষি, শিল্প ও গৃহস্থালী কাজে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় জল সরবরাহ করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ সেচের জমির পানি আসে পার্বত্য উৎস থেকে। বিংশ শতাব্দীতে পার্বত্য জলের উপর ১৮০ কোটি মানুষ নির্ভরশীল।
প্রতিবেদনটি পার্বত্য ক্রায়োস্ফিয়ারের (বরফ, তুষার এবং পারমাফ্রস্টের হিমায়িত অঞ্চল) মধ্যে ঘটে যাওয়া উদ্বেগজনক পরিবর্তনগুলোর উপর জোর দিয়েছে। বলা হচ্ছে, হিমবাহগুলো দ্রুত সংকুচিত হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী অধিকাংশ পার্বত্য হিমবাহ দ্রুত সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে এবং বর্তমান জলবায়ুর সাথে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, এখন গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস করা সত্ত্বেও এগুলি সংকুচিত হতে থাকবে।
বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রাকশিল্পযুগের চেয়ে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে বেড়ে চার ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিরিক্ত হয়ে পড়লে ২০২৫ সালের তুলনায় ২১০০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী পার্বত্য হিমবাহগুলো তাদের মোট ভরের ২৬ শতাংশ থেকে ৪১ শতাংশ হারাতে পারে। অনেক একক হিমবাহ একেবারেই অদৃশ্য হয়ে যাবে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাপী পানি ও স্যানিটেশন সংকটের দিকগুলোও তুলে ধরা হয়েছে।
দেখা গেছে, ২০০০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী মোট মিঠা পানির উত্তোলন ১৪ শতাংশ বেড়েছে। বিশ্বের জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ বা ২৫টি দেশ প্রতি বছর চরম পানি সংকটের মুখোমুখি হয়। বিশ্বের জনসংখ্যার অর্ধেক বা চারশ’ কোটি মানুষ বছরের অন্তত কিছু সময়ের জন্য তীব্র জলের অভাব অনুভব করেন।
২০২২ সাল পর্যন্ত, বিশ্বব্যাপী সাড়ে তিনশ’ কোটি মানুষের নিরাপদ স্যানিটেশনের অভাবে ভুগেছেন। সাব-সাহারান আফ্রিকাতে এই পরিস্থিতি বিশেষভাবে খারাপ ছিল, যেখানে জনসংখ্যার মাত্র ২৪% নিরাপদ স্যানিটেশন সেবা পান।
২০২৩ সালে ১২০টি দেশের ৯১,০০০ জলের উৎসের তথ্যে দেখা গেছে, ৫৬% জলের গুণমান ভাল ছিল।
প্রতিবেদনটি পার্বত্য জলের উপর নির্ভরশীলতা ও দুর্বলতার আঞ্চলিক ভিন্নতা তুলে ধরেছে। যেমন, সাব-সাহারান আফ্রিকায় ২৫ কোটি মানুষ পাহাড়ে বসবাস করেন। কেনিয়া পর্বত এবং রুয়েনজোরি পর্বতমালায় ২০৩০ সালের আগে এবং কিলিমাঞ্জারো পর্বতে ২০৪০ সালের মধ্যে হিমবাহ অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। ২০১৭ সালে প্রায় ২৫% বা ১৬.৭ কোটি মানুষ ল্যাটিন অ্যামেরিকা ও ক্যারিবীয় পাহাড়ে বাস করতেন।
এশিয়ায় প্রায় ২০০ কোটি মানুষের জীবনধারণ নির্ভরশীল তিব্বতীয় মালভূমি এবং পামির-হিন্দুকুশ হিমালয় পর্বতমালার ওপর। এখানকার অনেক হিমবাহ উদ্বেগজনক হারে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে।
জাতিসংঘ বলছে, বিশ্বের ১৫৩টি দেশ নিজেদের মধ্যে আন্তঃসীমান্ত নদী, হ্রদ ও জলাশয় ভাগাভাগি করে ব্যবহার করছে। এদের মধ্যে মাত্র ৪৩টি দেশের আন্তঃসীমান্ত জলাশয়ের ৯০ শতাংশ বা তার বেশি একটি কার্যকরী ব্যবস্থার আওতায় রয়েছে। এই ব্যবস্থা আরো কার্যকর করার পরামর্শ জাতিসংঘের।
একইসঙ্গে দেখা যাচ্ছে, দূষণ, বাঁধ, ভূমি রূপান্তর, অতিরিক্ত নিষ্কাশন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই জলাশয়গুলোর বাস্তুতন্ত্রের মান উল্লেখযোগ্য মাত্রায় অবনতি হচ্ছে।
জাতিসংঘ বলছে, পর্বতমালা ও হিমবাহ রক্ষা করা শুধু পরিবেশগত বিষয় নয়। এটি বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও মানুষের অস্তিত্বের বিষয়। এই সংকট অপ্রতিরোধ্য হবার আগে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।