বিরোধীকে মারাই পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতি
২০ জুন ২০২৫দিনকয়েক আগে সাংবাদিক বৈঠকে গণতন্ত্রের কথা বলছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর ঠিক তার পরদিনই বজবজে আহত এক দলীয় কর্মীকে দেখতে গিয়ে তৃণমূল সমর্থকদের হাতে আক্রান্ত হলেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার।
দেশের অন্য যে কোনো রাজ্যে এই ঘটনা ঘটলে তুমুল চাঞ্চল্য তৈরি হতো। কারণ, ভারতের অধিকাংশ রাজ্যের রাজনীতিতে এই অসহিষ্ণুতার ছবি ইদানীং আর সেভাবে ধরা পড়ে না। একেবারেই কি পড়ে না? মনে পড়ছে বছরকয়েক আগে লোকসভা নির্বাচনের সময় সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে উত্তরপ্রদেশের বারাণসীতে ভোটপ্রচারে গিয়েছিলেন স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বারাণসীর রাস্তায় তার গাড়ি আটকে তুমুল বিক্ষোভ দেখিয়েছিল গেরুয়া শিবিরের একাংশ। রাস্তায় নেমে বিক্ষোভকারীদের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন তৃণমূলনেত্রী। পড়ে তৃণমূলের তরফে বলা হয়েছিল, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর কেন্দ্রে গণতন্ত্র রসাতলে গেছে।
বিরোধী রাজনীতিকদের লক্ষ্য করে কালো পতাকা দেখানো, স্লোগান দেওয়ার ঘটনা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজ্যে ঘটেছে। কিন্তু এমন ঘটনা নিয়মিত ঘটে না। ভারতের অধিকাংশ রাজ্যে বিরোধীদের রাজনীতি করার একটি স্পেস বা জায়গা দেওয়া হয়। সেটিই গণতন্ত্রের নিয়ম। আশ্চর্য বিষয় হলো, যে দলই ক্ষমতায় থাকুক, পশ্চিমবঙ্গে বিরোধীদের সেই স্পেসটি দেওয়া হয় না। বাম আমলের শেষভাগে প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে বিরোধীদের রাস্তায় আটকে দেওয়া হতো। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে দিনের পর দিন বিরোধী নেতা-নেত্রীদের ঘটনাস্থলে যেতে দেওয়া হতো না। রাস্তা থেকে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে নিতো। যা নিয়ে শুধু বিরোধীরা নয়, রাজ্যের বিশিষ্টজনেরাও সরব হয়েছিলেন। ক্ষমতা বদলের পর কী পরিবর্তন হলো? লবডঙ্কা।
যত দিন যাচ্ছে বিরোধীদের তত টুটি চেপে ধরা হচ্ছে এই রাজ্যে। ভিন্ন রাজনীতি করার অপরাধে খুন হতে হচ্ছে গ্রামেগঞ্জের সাধারণ মানুষকে। মেরে গাছে ঝুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে লাশ। শাসকদলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বও ক্রমশ প্রকাশ্যে চলে আসছে। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে খুন হচ্ছেন শাসকদলের নেতাকর্মীরা। কোথাও বিরোধী নেতাদের গাড়ি ভাঙচুর করা হচ্ছে। কোথাও রাস্তা বন্ধ করে বিক্ষোভ দেখানো হচ্ছে। ফলে বৃহস্পতিবার বজবজে সুকান্ত মজুমদারের সঙ্গে যা ঘটেছে তা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এক ধারাবাহিক রাজনৈতিক হুলিগানিসমের অংশমাত্র।
মজা হলো, আজ বিজেপিতে যোগ দিয়ে যে নেতারা এই ঘটনার নিন্দা করছেন, একসময় তৃণমূলের রাজনীতি করার সময় তারাই এই সমস্ত ঘটনা ঘটাতেন। কখনো ক্ষমতায় এলে তারাও যে বিরোধীদের সঙ্গে এমন কাজ করবেন না, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। রাজ্যের বিরোধী দলনেতা প্রকাশ্যে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়কে নিয়ে যে সমস্ত মন্তব্য করেন, তা থেকে স্পষ্ট, সহিষ্ণুতার ছিঁটেমাত্র পাঠ তার নেই।
অথচ গণতন্ত্রের প্রথম এবং প্রধান পাঠ সহিষ্ণুতা। বিরোধীর প্রতি সহিষ্ণুতা। বিরোধী মতের প্রতি সহিষ্ণুতা। সমালোচনা শোনা। গঠনমূলক বিতর্কের পরিসর তৈরি করা। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি থেকে বহুকাল আগেই এই সমস্ত বিষয় উবে গেছে। এখানে আনুষ্ঠানিকভাবে ভোট হয় ঠিকই কিন্তু গণতন্ত্রের চর্চা হয় না। বিরোধী মতের উপর আক্রমণ শানানোই এখন এই রাজ্যের সংস্কৃতি।