বিধানসভা নির্বাচনে কী দেখে ভোট দেন দিল্লির মানুষ?
২৪ জানুয়ারি ২০২৫দিল্লিকে রাজ্য বলা হলেও আসলে তো এটা একটা বড় শহর। সেখানে ৭০ সদস্যের বিধানসভা রয়েছে। এক কোটি ৫৫ লাখ ভোটদাতা আছে। কিন্তু তারা রাজ্যে যে সরকারকে নির্বাচিত করে, তার ক্ষমতা একেবারেই সীমাবদ্ধ। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জল সরবরাহর মতো কয়েকটি ক্ষেত্রেই এই সরকারের হাতে ক্ষমতা আছে। আইন-শৃঙ্খলা থেকে শুরু করে বাকি সবই লেফটোন্যান্ট জেনারেল(এলজি)-র হাতে, তিনি হলেন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি। ফলে দিল্লির ঘরোয়া বিষয়েও কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা নির্বাচিত রাজ্য সরকারের তুলনায় ঢের বেশি। তা সত্ত্বেও দিল্লি বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে ভারতে আগ্রহের কোনো কমতি নেই, বরং অন্য রাজ্যের মানুষ ষোলোআনা আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকেন দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনের দিকে।
যার জন্য দিল্লির বিধানসভা নির্বাচন ঘিরে এত আগ্রহ, সেই মানুষটির নাম অরবিন্দ কেজরিওয়াল, সরকারি চাকুরে থেকে অ্যাক্টিভিস্ট, সেখান থেকে রাজনীতিক। প্রথমবার নির্বাচনে লড়েই কংগ্রেসের সমর্থনে মুখ্যমন্ত্রী। তারপর ২০১৫ ও ২০২০ সালে কেজরিওয়ালের অসাধারণ সাফল্য। প্রথমবার ৭০টির মধ্যে ৬৭টি আসন, ২০২০ সালে ৬২টি আসনে জিতে এসে এমন রেকর্ড তৈরি করেছেন, যা এখনো পর্যন্ত অন্য়দের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
গত ১০ বছরে প্রতিবারই লোকসভায় খুবই খারাপ ফল করে কেজরিওয়ালের আপ, তার এক বছর পর বিধানসভায় তারাই হইহই করে জেতে। ২০২৫-এ এসে কি সেটা আবার করে দেখাতে পারবেন কেজরিওয়াল? আর এর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অন্য প্রশ্নটা আসে, কী দেখে ভোট দেন দিল্লির মানুষ?
দিল্লির ভোটদাতারা কীসের ভিত্তিতে ভোট দেন?
রাজধানীর বাঙালিপ্রধান এলাকা চিত্তরঞ্জন পার্কের প্রবীণ বাসিন্দা ও নাট্যব্যক্তিত্ব সিদ্ধার্থ দাশগুপ্ত ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''আমি কাজ দেখে ভোট দিই। সীমিত ক্ষমতার মধ্যে থেকে দিল্লিতে কতটা কাজ করতে পেরেছে সরকার সেটা দেখি।'' সেই মাপকাঠিতে কি কেজরিওয়াল পাস করছেন? সিদ্ধার্থর জবাব, ''দিল্লিতে দুইটি সবচেয়ে অবহেলিত জায়গায় কেজরিওয়াল হাত দিয়েছিলেন। সরকারি স্তরে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা। আমার বাড়ির কাছে একটা মহল্লা ক্লিনিক আছে। সেখানে ডাক্তার থাকেন। বিনা পয়সায় চিকিৎসা করানো যায়। চিত্তরঞ্জন পার্কের সরকারি স্কুলের উন্নতিটাও চোখের সামনে দেখছি। আর কেজরিওয়ালের দেয়া ভর্তুকির সুবিধা সকলেই অল্পবিস্তর পান।''
তুঘলকাবাদে থাকেন মঞ্জু। একাধিক বাড়িতে রাঁধুনির কাজ করেন। ডিডাব্লিউকে তিনি বলেন, ‘‘দিল্লিতে মেয়েদের বাসে চড়তে পয়সা লাগে না। মাসে বিদ্যুতের খরচ দুইশ ইউনিটের মধ্যে থাকে বলে এক পয়সাও দিতে হয় না। জলের খরচ নেই। সাধারণ চিকিৎসা মহল্লা ক্লিনিকে হয়ে যায়। এবার তো সরকারের এলে মাসে দুই হাজার একশ টাকা দেবে বলছে। যে আমাদের সাহায্য করছে, তাকেই তো ভোটটা দেবো।'' কিন্তু বিজেপি ও কংগ্রেস তো মাসে আড়াই হাজার টাকা, কম দামে গ্যাস সিলিন্ডার-সহ আরো অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে? মঞ্জুর জবাব, ‘‘তা দিতেই পারে। কিন্তু কেজরিওয়াল তো আমাদের এতদিন ধরে অনেককিছু দিয়েছেন। তাই তিনি এলে কথা রাখবেন বলে আমি অন্তত বিশ্বাস করি।''
চিত্তরঞ্জন পার্কের পাশের এলাকা হলো গ্রেটার কৈলাশ, পার্ট টু। রাজধানীর অভিজাত এলাকা। মূলত, হিন্দু পাঞ্জাবিদের বাস। সেখানে গেলেই ছবিটা আবার কিছুটা বদলে যায়। সেখানে সুরেশ ভাটিয়ার দাবি, ‘‘আমরা বিজপি-কে বরাবর ভোট দিচ্ছি। কারণ, আমার মনে হয়, দিল্লির জন্য বিজেপি-কেই দরকার। তারা সব শ্রেণির স্বার্থরক্ষা করতে পারবে। আপের আমলে দিল্লির পরিকাঠামোর অবস্থা শোচনীয়। রাস্তাঘাট, পার্কের রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচ্ছন্নতা কোনো কিছুই ঠিকভাবে হয় না।''
আসলে এক দিল্লির মধ্যে রয়েছে অনেক দিল্লি। রয়েছে অনেক ভাগ, প্রায় সব রাজ্যের মানুষ, আর্থিক, সামাজিক সব স্তরের মানুষ থাকেন দিল্লিতে। তাদের চিন্তাভাবনা, প্রাথমিকতা সবই আলাদা। দিল্লির বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী আতিশির কেন্দ্র হলো কালকাজি। সেখানে প্রতিটি মহল্লার বাসিন্দাদের জন্য হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ করা আছে। কালকাজি কেন্দ্রের ভোটার প্রতীক গুপ্তা ডিডাব্লিউকে বলেছেন, ''আমরা কোনো সমস্যা সেই গ্রুপে বললেই, এক-দুইদনির মধ্যে জবাব এসে যায়। হয় সেই সমস্যার সমাধান করা হয়। না হলে, জানানো হয়, কোথায় বাধা রয়েছে।''
আতিশিও এবার কড়া প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে পড়েছেন। তার বিরুদ্ধে বিজেপি সাবেক সাংসদ রমেশ বিধুরীকে দাঁড় করিয়েছে। কংগ্রেস দাঁড় করিয়েছে যুব নেত্রী অলকা লাম্বাকে। রমেশ রীতিমতো প্রভাবশালী প্রার্থী। অলকা লাম্বারও পরিচিতি যথেষ্ট। তনবির সিং মনে করেন, ভোটের লড়াই সমসময়ই কঠিন। তবে আতিশির স্বচ্ছ্ব ও ঘরের মেয়ের ভাবমূর্তি আছে। সেই সঙ্গে তিনি কাজ করেন। তাই তার গ্রহণযোতা রয়েছে।
বিজেপি-র কর্মী সলিল নন্দী বলেন, ''ভুলে যাবেন না, দিল্লি বিধানসভায় বিজেপি মোটামুটি ৪০ শতাংশের কাছাকাছি ভোট পায়। আমরা যদি সাত শতাংশ বাড়তি ভোট নিজেদের দিকে নিয়ে আসতে পারি, তাহলে সরকার না বানানোর কোনো কারণ নেই। আর এখন দিল্লির মানুষ বিজেপি-কে ভোট দেন নরেন্দ্র মোদীকে দেখে। গত লোকসভাতেও দিয়েছেন। এই বিধানসভাতেও দেবেন। তবে লোকসভায় কেজরিওয়াল কোনো ফ্যাক্টর ছিলেন না। এবার তিনি নিঃসন্দেহে ফ্যাক্টর।''
কংগ্রেস কাদের ভোট পেতে পারে?
দিল্লিতে ২০২০ সালের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস পেয়েছিল চার দশমিক ২৩ শতাংশ ভোট। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস পায় ১৮ দশমিক ১৯ শতাংশ ভোট। তবে তখন তাদের সঙ্গে আপের জোট হয়েছিল। এই বিধানসভা নির্বাচনে কোনো জোট নেই। গত লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস মোট প্রাপ্ত ভোটের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৪ শতাংশ মুসলিম ভোট পেয়েছিল। এছাড়া দলিত ভোট ২০ শতাংশ, ওবিসি ১৯ শতাংশ ও উচ্চবর্ণের ভোট পেয়েছিল ১৪ শতাংশ।
এবার কালকাজি কেন্দ্রের ভোটদাতা জান মহম্মদ ডিডাব্লিউকে বলেছেন, তিনি কাজ দেখে ভোট দেবেন এবং তার মনে হয়, আপ-এর আসন কমতে পারে, কিন্তু সরকার তারাই গঠন করবে। এখানে আতিশি খুবই জনপ্রিয়। অলকা লাম্বা খাটছেন। ঘুরছেন। কিন্তু কালকাজি কেন্দ্রে কাজের জন্য আতিশি এগিয়ে থাকবেন।
জান মহম্মদ জানিয়েছেন, সংখ্যালঘুদের মধ্যে একটা আলোচনা চলছে, কংগ্রেস তো সরকার গঠন করতে পারবে না। তাই ভোটটা আপকে দেয়াই ভালো।
নিরুত্তাপ দিল্লি
তবে ভোট নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে দিল্লির মানুষদের খুব বেশি তাপ-উত্তাপ নেই। বাঙালি, বিহার ও উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা মানুষরা ভোট নিয়ে আলোচনা করতে ভালোবাসেন। কিন্তু উত্তেজিত তর্কবিতর্ক হয় না। মাঝেমধ্যে রাস্তা দিয়ে কিছু অটোতে মাইক বাজিয়ে প্রচার করে দলগুলি। সন্ধ্যায় প্রার্থী বা দলের লোকেরা ঘোরাঘুরি করেন। কিন্তু অন্য শহরের মতো ভেটের উত্তেজনা দিল্লিতে খুঁজে পাওয়া যায় না। অন্য অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তন হলেও দিল্লির এই চরিত্রের খুব বেশি বদল হয়নি। রাজনীতি নিয়ে নিরুত্তাপ দিল্লির মানুষ ভোটটা কাকে দিলেন তা জানা যাবে ৮ ফেব্রুয়ারি, ফলাফল প্রকাশের দিন।