বিদেশে পড়াশোনায় আগ্রহ কেন কমছে ভারতীয়দের?
২৫ মার্চ ২০২৫উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশের অনেক নামী প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে যান ভারতের ছাত্রছাত্রীরা। করোনা পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলেও পড়ুয়াদের বিদেশযাত্রার প্রবণতা কমছে।
কেন্দ্রের পরিসংখ্যান
ভারতীয় সংসদে শিক্ষা মন্ত্রক ২০২৪ সালে বিদেশে পড়তে যাওয়া ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা তুলে ধরেছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া-সহ কয়েকটি দেশে ২০২৩ সালের তুলনায় গত বছরে পড়ুয়ার সংখ্যা ১৫ শতাংশ কমেছে।
লোকসভায় এক সংসদের প্রশ্নের জবাবে কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার জানিয়েছেন, ২০২৩–এ ৮ লক্ষ ৯২ হাজার ৯৮৯ জন ভারতীয় পড়ুয়া অন্যান্য দেশে পড়াশোনা করেছেন। ২০২৪–এ ৭ লক্ষ ৫৯ হাজার ৬৪ জন পড়ুয়া উচ্চশিক্ষা নিতে গিয়েছেন ভিনদেশে। অর্থাৎ সওয়া লক্ষের বেশি ছাত্র-ছাত্রী এক বছরের মধ্যে কমে গিয়েছে।
সবচেয়ে বেশি ভারতীয় পড়ুয়া কমেছে ক্যানাডাতে। হ্রাসের হার ৪২ শতাংশ। ইংল্যান্ডে প্রায় ২৮ শতাংশ, আমেরিকায় প্রায় ১৩ শতাংশ ছাত্রছাত্রী কম পড়তে গিয়েছেন।
ভারতীয় পড়ুয়াদের কাছে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ক্যানাডার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বরাবরই খুব আকর্ষণীয়। তবে অন্যান্য দেশেও পড়ার ঝোঁক রয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, অন্য কয়েকটি দেশে বিপরীতমুখী প্রবণতা দেখা গিয়েছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রাশিয়া ও ফ্রান্স। ২০২৩ এর তুলনায় ২০২৪ সালে রাশিয়ায় ভারতীয় পড়ুয়া বেড়েছে ৩৪ শতাংশ, ফ্রান্সের ক্ষেত্রে ১৪ শতাংশ।
রাশিয়ার ক্ষেত্রে মেডিক্যাল পড়তে যাওয়ার ঝোঁক বেশি। হাজার হাজার পড়ুয়া সে দেশে যাচ্ছেন ডাক্তারি পড়তে। সেখানে পড়াশোনার খরচ যেমন কম, তেমনি মেডিক্যালের পাঠ নেয়ার জন্য কঠিন প্রবেশিকা পরীক্ষার মুখে পড়তে হয় না। এছাড়া পড়ুয়াদের বৃত্তি থেকে বসবাসের ব্যবস্থা, বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সুবিধা দেয়া হয়। শুধু এমবিবিএস নয়, পিএইচডি করতে অনেকে রাশিয়ায় যাচ্ছেন।
ছাত্র কমার কারণ
বিদেশে ভারতীয়দের পড়তে যাওয়ার প্রবণতা কমার পিছনে অনেকগুলি কারণ রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে অন্যতম রাজনৈতিক কারণ। বিভিন্ন দেশে দক্ষিণপন্থি দলের উত্থান হয়েছে। এর ফলে কঠোর হয়েছে অভিবাসন নীতি। ভিসা পাওয়ার অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই কারণে গন্তব্য হিসেবে আমেরিকা, ইউরোপের একাধিক দেশ আগের মতো আর অনুকূল নয় বলে তাঁদের মত।
বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ও পররাষ্ট্রনীতি ছাত্র সংখ্যা কমার পিছনে কিছুটা দায়ী বলে অনেকে মনে করেন। এক্ষেত্রে ক্যানাডার প্রসঙ্গ বিশেষভাবে উল্লেখ্য। এ দেশেই সবচেয়ে বেশি কমেছে ভারতীয় পড়ুয়ার সংখ্যা। বিশেষজ্ঞদের মতে, শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী হরদীপ সিং নিজ্জরের হত্যা নিয়ে দু'দেশের সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছিল। তার প্রভাব পড়েছে ভিসার ক্ষেত্রে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী ডিডাব্লিউকে বলেন, "ডনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকার যে নীতি, তা কোনো ভিনদেশির পক্ষে সুবিধাজনক নয়। ক্যানাডার সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়ে গিয়েছে। ফলে এই দুটি দেশে পড়তে যাওয়া ভারতীয়রা অন্য দিকে ঝুঁকেছেন। ইউক্রেন, রাশিয়ায় অনেক মেডিক্যাল ছাত্র পড়তে যেতেন, সেখানে যুদ্ধ হলেও যাচ্ছেন। আমেরিকা বা ক্যানাডার মতো সেখানে পড়তে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা নেই, পড়াশোনার খরচও কম।"
বিদেশে না যাওয়ার ক্ষেত্রে বড় হয়ে উঠেছে অর্থনৈতিক কারণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, সার্বিক মন্দা, শিল্প উৎপাদনে ঘাটতি, কর্মসংকোচন নিয়োগের ক্ষেত্রকে অনিশ্চিতকরে তুলেছে। অতীতে ভারতীয়রা বিদেশে পড়তে যেতেন যে লক্ষ্য নিয়ে, সেখানে কোথাও নিয়োগ খুঁজে নেয়া, তেমন পরিস্থিতি আর নেই। বড় বহুজাতিক সংস্থায় কর্মী ছাঁটাইয়ের খবর পাওয়া যায় মাঝেমধ্যে।
অসম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য তপোধীর ভট্টাচার্য ডিডব্লিউকে বলেন, "দক্ষিণপন্থি রাজনীতির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে জনকল্যাণের ধারণাটা ফিকে হয়ে আসছে। যে উদারনৈতিক নীতির ফলে অন্য দেশের ছাত্রছাত্রীরা স্বাগত ছিল, সেখানে আজ বাধা তৈরি হয়েছে। ফলে আমেরিকা-সহ অন্যান্য দেশে তাদের নিজেদের রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। ভারতীয় ছাত্রদের যে মেধা ও পরিশ্রম, তার গুরুত্ব কমে যাচ্ছে। এই প্রবণতা আগামী দিনেও বজায় থাকবে।'
শুধু বিদেশযাত্রা নয়, দেশের সার্বিক শিক্ষাচিত্রের সঙ্গে বিষয়টিকে জুড়তে চাইছেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, "আমাদের দেশে শিক্ষার গুরুত্ব কমছে। বাজেট কমছে, নিয়োগের সম্ভাবনা কমছে। তাই কলেজে ছাত্র ভর্তি কমে গিয়েছে। বিদেশে পড়ার ক্ষেত্রে সম্ভবত সেই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। বাইরের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ার উৎসাহ কমে যাচ্ছে অথবা যোগ্যতাতেও ঘাটতি হচ্ছে।"